ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

অবরোধে পেট্রোল বোমা ও নির্বাচন বর্জন ২০ দলীয় জোটের দুর্বলতা!!

আশরাফ সিদ্দিকী বিটু, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪২ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৫
অবরোধে পেট্রোল বোমা ও নির্বাচন বর্জন ২০ দলীয় জোটের দুর্বলতা!! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম (ফাইল ফটো)

বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধের ১১১তম দিনে ২৬ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে খালদা জিয়া বললেন অবরোধ আর সক্রিয় নয়, এ কমূসূচী ২০ দল ঘোষণা করেছে, প্রত্যাহারের ব্যাপারে তাদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবেন। যদিও ৫ এপ্রিল খালেদা জিয়া জামিন নিয়ে বাড়ি যাওয়ার পর থেকে অবরোধের তেমন কার্যকারিতা নেই।

অবরোধ হরতালে ৯০/৯২ দিন অনেক সহিংসতা হয়েছে। মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়েছে, অন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশু, বাস চালক, সিএনজি চালক, মুক্তিযোদ্ধা ড্রাইভারকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ৫০০-এর বেশি মানুষ আগুনে পুড়েছে, যাদের অনেকে আর স্বাভাবিক জীবন পাবে না। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে অবরোধ হরতালের মধ্যে। বিশ্ব এজতেমা, স্বরসতী পূজা, এমনকী পহেলা বৈশাখেও অবরোধ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে অবরোধ-এ দুই দিন বিএনপি নেত্রী শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনার ও জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাননি। খালেদা জিয়া বাড়ি ফেরার পর তার সাথে দেখা করে ব্যারিস্টার জমির উদ্দীন সরকার কয়েকদিন আগে বললেন— স্ট্রাইক নেই, পরে অবরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন—স্ট্রাইক বলতে তিনি হরতালকে বুঝিয়েছিলেন, সে ধোয়াশা খালেদা জিয়া ২৬ এপ্রিল নিজে পরিষ্কার করলেন।

দেশে অবরোধে ক্ষতির পরিমাণ সবাই জানেন, সবচেয়ে বেশি জানেন গরীব অসহায় নিরীহ মানুষ। কারণ তাদের উপরই এর নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়ে। কিন্তু বিএনপি কোন দায় স্বীকার করেনি। বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা দিয়েছিলেন, যৌক্তিক পরিণতি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে, কিন্তু উনি বাড়ি চলে যাবার পর থেকে আর কোন আন্দোলনে নেই বিএনপি। বিএনপি-জামায়াত জোট যা করেছে, তা হল সহিংসতা-সন্ত্রাস। বিদেশি কূটনীতিকরা এই সহিংসতা বন্ধের আহবান জানিয়েছেন বারবার। মানুষ পুড়িয়ে তো সরকারকে নামাতে পারলেন না। বিএনপি পেট্রোল বোমা, আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানো নিয়ে দায় স্বীকার না করলেও গণমাধ্যম ও আইনশৃ্ঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কল্যাণে দেশের মানুষ জেনেছে ও দেখেছে, বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা পেট্রোল বোমাসহ কিংবা বোমা হামলার সময় ধরা পড়েছে, গণপিটুনী খেয়েছে, নিজেদের বোমায় নিজেরাই মৃত্যুবরণ করেছে। অবরোধে সহিংসতা কমে আসছেও এখনো মজুদকৃত পেট্রোল বোমাসহ বিএনপি জামায়াতেই নেতারাই ধরা পড়ছে। তাই কোনভাবেই এই পেট্রোল বোমার সন্ত্রাসের দায় বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট এড়াতে পারে না।

২ মে বিবিসিকে বিএনপি নেতা হান্নান শাহ বললেন, হরতাল অবরোধের চিন্তা বিএনপির নেই। (দৈনিক ইত্তেফাক, পৃষ্ঠা-২, ৩ মে ২০১৫)। বিএনপি নেতার এ বক্তব্যের মানে এই নয় যে, ভবিষ্যতে আর অবরোধের নামে সহিংসতা করবে না। বিএনপি ও জামায়াতের চরিত্র আমাদের সবার জানা। কারণ কোন প্রকার জনসমর্থন না থাকার পরও যে দল রাতের আঁধারে চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে পারে, মানুষ পুড়িয়ে মারতে পারে, মুরগী-আলু-সবজিবাহী ট্রাকে আগুন দেয়া, বইবাহী ট্রাকে আগুন দিতে পারে, তাদের সাময়িক পিছুটানে বিশ্বাস রাখা যায় না। বিএনপির এখন সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল যা স্মরণ অতীতে সবচেয়ে ভয়াবহ। বিএনপি জামায়াত যে আবার সহিংস হয়ে উঠবে না, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় বিএনপি জামায়াত ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিন হতে অর্থাৎ যেদিন যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর রায় হয় তার পর থেকেই সারাদেশে সহিংসতা শুরু করে। সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে, এই বলে মিথ্যে প্রচারণা চালিয়ে পুরো বছর জুড়ে সহিংসতা অব্যাহত রাখে। ২০১৩-এর শেষ দিকে আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদের শেষ সময়ে আবারো সহিংসতা করে, সে সময় ৩৪ দিনের অবরোধে ১৩৫ জনকে হত্যা করা হয়, ২৬ জনকে পুড়িয়ে মারা হয়, পরিবহণ খাতের ৫৫ জনকে হত্যা করা হয়। ২০১৩-এর ৫ মে ঢাকার মতিঝিলে হেফাজত সহিংসতা করে, তাণ্ডব করে বায়তুল মোকাররম মসজিদে আগুন দেয়, হাজার হাজার কোরআন শরীফ পুড়িয়ে দেয় । সেই বিএনপি-জামায়াত আবারো ২০১৫-এর ৩ জানুয়ারি থেকে দেশে সহিংসতা, সন্ত্রাস তাণ্ডব শুরু করে। ফলে বিএনপি জামায়াতের ওপর এ আস্থা কোনভাবেই রাখা যায় না যে, ভবিষ্যতে তারা আর কোন সন্ত্রাস সহিংসতা করবে না।

তিন মাসের সহিংসতা থেকে বিএনপির অর্জন নিয়ে বিএনপির সদুত্তর নেই সেটা নিশ্চিত। বিএনপি নেত্রী কয়েকবার বলেছেন দল পুর্নগঠন করবেন; কিন্তু ব্যর্থ হলেন। আন্দোলন করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন। নিষ্ক্রিয় কর্মীদের সক্রিয় হতে বললেন, তারা বোমা বানাতে গিয়ে ধরা পড়তে থাকল, গণপিটুনী খেল। ব্যর্থতার প্রতিশোধ কি মানুষ পোড়ানো, গরীবের আয়ে লাথি মারা, বার্ন ইউনিটের আর্তনাদ? এ কেমন রাজনীতি বিএনপির? জনআস্থা না থাকলে কোন কর্মসূচী সফল হয় না। এমনকী ভবিষ্যতেও হবে না। বিএনপি অবরোধ হরতাল দিয়ে অশ্বডিম্ব পেল, মানুষের কাছে দলের অবস্থা, দলের শীর্ষস্থানীয়দের সিদ্ধান্তহীনতা এবং সাংগঠনিক দুর্বলতাই নগ্নভাবে প্রকাশ করল।

উল্লেখ যে সংসদে ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর যখন ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এ দুই ভাগ করা হয়, তখন বিএনপি প্রতিবাদ করেছিল। ২০১১-এর ৩০ নভেম্বর সাদেক হোসেন খোকা আদালতে রীট করেন, যা পরে খারিজ হয়ে যায়। ২০১১-এর ৪ ডিসেম্বর সিটি কর্পোরেশন ভাগের প্রতিবাদে ঢাকায় হরতাল ডাকে, বিএনপির উস্কানিতে নগর ভবনে মারামারি করে বিএনপিপন্থী লোকজন। অথচ ভাগ হওয়া সেই দুটি সিটি নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। আওয়ামী লীগ সরকারকে অবৈধ বললেও এই সরকারের অধীনেই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে এই কমিশনের অধীনেই তারা নির্বাচনে আসে। আর নির্বাচনকে বির্তকিত করতে পরিকল্পনা করেই বর্জন করে। বিএনপি নানা অভিযোগ তুলে পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে নির্বাচন বর্জন করলেও সাধারণ ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরসহ মোট ১৭৯টি ওয়ার্ডে বিএনপির কাউন্সিলর জয়ী হয় ১৮টিতে, জামায়াত ৩টিতে আর জাতীয় পার্টি ১টিতে, ৩ ওয়ার্ডে ফলাফল স্থগিত করা হয়। ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটিতে মোট ভোট পড়েছে ৪৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ।   ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রামের ৬০ লাখ ২০ হাজার ৯৫২ ভোটারের মধ্যে ২৬ লাখ ৪৮ হাজার ৭২৮ জন ভোট দিয়েছেন এবং বিএনপির ৩ মেয়র প্রার্থীগণ মোট প্রাপ্ত ভোটের ৩৫.৫ ভাগ ভোট পেয়েছেন।

বলা বাহুল্য যে, ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ ৩টি সিটি কর্পোরেশনে মোট কেন্দ্র ২৭০১ যার মধ্যে অনিয়ম বা সহিংতায় হয় সর্বোচ্চ ৫৫টিতে যা মোট ভোট কেন্দ্রের শতকার ২ ভাগ মাত্র। ঢাকার দুই সিটির এক হাজার ৯৮২টি কেন্দ্রের মধ্যে গোলযোগ হয়েছে অর্ধশত কেন্দ্রে। ঢাকার দুই সিটিতে মোট ভোটার ৪২ লাখের বেশি। বিপরীতে হাঙ্গামা হওয়া কেন্দ্রগুলোতে মোট ভোটার এক লাখের বেশি নয়। অথচ বাতিল হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার পাঁচ ভোট, যা মোট ভোটের ৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোন কেন্দ্রেই ভোট গ্রহণ বন্ধ হয়নি। এখানে মোট ভোটার ১৮ লাখ ১৩ হাজার আর মোট কেন্দ্র ৭১৯টি। বিপরীতে দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ঘটেছে ৫-৭টি কেন্দ্রে যেখানে ভোটার সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ হাজার।

আমাদের ভোটের ইতিহাস তেমন সুখকর নয়। কারণ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর সামরিক শাসকরা ক্ষমতায় এসে মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে এবং এদেশে ভোট কারচুপি ও জালিয়াতির ইতিহাস সৃষ্টি করে। আমরা সবাই জানি, জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৭ সালের হ্যাঁ-না ভোট, ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন-সবই হয় জালিয়াতি ও কারচুপির নির্বাচন। এরশাদ সাহেবও একইধারা বজায় রাখেন। ব্যতিক্রম হয়নি খালেদা জিয়ার আমলেও, কেননা বেগম জিয়ার সময় ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত মাগুরা-২ আসনের উপ-নির্বাচনে ভোট কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারানো হয়। ১৯৯৪ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ জয়ী হলেও তারপরেই লালবাগে আওয়ামী লীগের ৭ জনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। ১৯৯৩ সালে ২ ফেব্রুয়ারি মিরপুর উপনির্বাচনে জালিয়াতি করা হয়। বেগম জিয়া ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটার বিহীন নির্বাচন করেন। জোট সরকারের আমলে ২০০৪-এর ১ জুলাই ঢাকা ১০ উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে ভয়াবহ কারচুপির মাধ্যমে জয়ী করা হয় এবং ‎ঢাকা ১০ উপ-নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের কথা থাকলেও খালেদা জিয়ার সরকার সেনা মোতায়েন করেনি। পরবর্তীতে ২০০৬ এর শেষদিকে জোট সরকার জাতিকে ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটারও উপহার দিয়েছিল যা পরে সংশোধন করে ২০০৮ এর ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। ২৮ এপ্রিলে অনেকের সাথে আমিও একমত যে ভোট প্রদান হার কম, তবে বিএনপি যদি বর্জন না করতো তবে ভোট প্রদান হার বেশী হত। তবে ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল  এবং তখন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মাঠেই নামতে দেয়া হয়নি কিন্তু বিএনপি নিজেরাই এজেন্ট না দিয়ে পরে অন্য কথা বলছে-যা রাজনৈতিক কূটকৌশলের অংশমাত্র। বিএনপির করা অভিযোগ বা সমালোচনা তাদের মুখে মানায় না কারণ বিএনপির অতীত কিন্তু ভোট জালিয়াতি ও কারচুপির ইতিহাস।

লেখক: পরিচালক, সিআরআই ও রাজনৈতিক কর্মী

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪২ ঘণ্টা, ১৩ মে, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।