[ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসে সবচে বড় ও নিরঙ্কুশ জয় পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করা নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী গত ২ মে ২০১৫ রাজধানী নয়াদিল্লিতে নিজের সরকারি বাসভবনে টাইম ম্যাগাজিনকে এক একান্ত সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন টাইম সম্পাদক ন্যান্সি গিব্স, (Nancy Gibbs) টাইম এশিয়া অঞ্চলের সম্পাদক জোহার আবদুল করিম ( Zoher Abdoolcarim) এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ব্যুরোপ্রধান নিখিল কুমার (Nikhil Kumar)।
ভারতরাষ্ট্র চালাতে গিয়ে কি কি জিনিস শেখা হলো তার, এ-প্রসঙ্গে—
কেন্দ্রীয় সরকারের কাঠামোটা ছিল আমার কাছে নতুন এক ব্যাপার। এটাই ছিল আমার জন্য সবচে’ বড় এক চ্যালেঞ্জ। এখানে প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট একেকটা নিজস্ব গুমোট গর্তে বসে কাজ করতে চায়---প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট নিজেই যেন একটা সরকার সেজে বসে আছে। আমি চেষ্টা করেছি এইসব বদ্ধ কুঠুরি ভেঙে ফেলতে যাতে সবাই কোনো একটা সমস্যাকে যৌথভাবে দেখতে
পারে। আমি ফেডারেল সরকারকে অনেক কিছুর মিশেলের জগাখিচুড়ি হিসেবে দেখতে চাই না, দেখতে চাই এক প্রাণময় সত্তা হিসেবে।
যুক্তরাষ্ট্রকে কোন দৃষ্টিতে দেখেন সে প্রসঙ্গে—
আমরা পরস্পরের সহজাত মিত্র... ভারত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কী করবে তা নয়, বরং হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের জন্য কী কী করতে পারে সেটাই দেখার বিষয়। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র মিলেমিশে দুনিয়ার জন্য কী কী করতে পারে সেদিকেই--- দুনিয়াজুড়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জোরদার করার দিকে--আমাদের নজর দেওয়া উচিত।
মাঝেমাঝে চীনের সাথে ভারতের উত্তেজনাকর সম্পর্ক প্রসঙ্গে—
প্রায় তিন দশক ধরে ভারত-চীন সীমান্তে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ-উত্তেজনাহীন অবস্থাই বিরাজ করছে। গত সিকি শতাব্দীর বেশি সময়ে একটিও বুলেট ছোড়া হয়নি। উভয় দেশই দারুণ পরিপক্কতা আর অর্থনৈতিক সহযোগিতার মনোভাব দেখিয়ে আসছে।
আফগানিস্তানে আবারও তালেবানের ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা প্রসঙ্গে—
আফগানিস্তান ছেড়ে মার্কিন বাহিনির চলে যাওয়াটা অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্বাধীন সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে আফগানিস্তানে একটি স্থিতিশীল সরকার থাকার স্বার্থেই মার্কিন বাহিনি চলে যাওয়ার পর দেশটির নিরাপত্তার প্রয়োজনের দিকটি নিয়ে আফগান সরকারের সাথে কথা বলাটা জরুরি।
সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবেলা করা প্রসঙ্গে—
কেবল নামফলকের উপর ভিত্তি করে সন্ত্রাসবাদকে দেখা আমাদের উচিত নয়—তারা কোনো গোষ্ঠির, তারা কোন বৌগোলিক এলাকার লোক, কারা সন্ত্রাসের শিকার ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব গোষ্ঠি বা নামগুলো ক্রমাগত বদলে যেতে থাকবে। আজ আপনারা দেখছেন তালেবান বা আইসিসকে। কাল আপনাদের নজর দিতে হবে অন্য কোনো নামের দিকে।
আমাদের উচিত হবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের উপর জাতিসংঘের মাধ্যমে ব্যাপকভিত্তিক এক কনভেনসন পাস করা। এটা করা সম্ভব হলে এটা অন্তত প্রতিষ্ঠিত হবে যে, কাদেরকে আপনারা সন্ত্রাসবাদী হিসেবে গণ্য করবেন আর কাদেরকে নয়। আমাদের যেটা করা দরকার তা হলো ধর্মকে সন্ত্রাসবাদ থেকে বিযুক্ত করা। যারা ধর্ম ও সন্ত্রাসবাদের মধ্যকার সম্পর্ককে নিজেদের স্বার্থে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করার মওকাটা লুফে নেয়। কিছু কিছু দেশ আছে যারা সন্ত্রাসবাদকে স্রেফ কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি হিসেবে দেখতে অভ্যস্থ। এটিকে একে আমাদের দেখতে হবে বরং মানবিক মূল্যবোধের জন্য লড়াই হিসেবে।
অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি অনেক দূর বা যথেষ্ট এগিয়েছে কিনা প্রসঙ্গে—
গত বছর সরকারের ভেতর কিছুই ঘটছে না বলে মনে হচ্ছিল। রীতিমতো ‘পলিসি প্যারালাইসিস’ বলে মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা। ...নেতৃত্ব বলতে কিছুই ছিল না তখন। বিগত সরকারের সময় কি কি ঘটেছিল আর আমার ১০ মাস বয়সী (সাক্ষাৎকার দেবার সময় তার সরকারের বয়স) সরকারের সময় কি কি ঘটেছে, তার নিরিখেই আমার সরকারের ক্ষমতায় আসাকে দেখতে হবে। ...গোটা দুনিয়া, আবারও, ভারতকে নিয়ে এবং ভারত যেসব সুযোগের প্রতিনিধিত্ব করে সেসব নিয়ে উল্লসিত-উদ্দীপ্ত। হোক তা আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক বা মুডিস (Moody’s) বা অন্য কোনো ঋণদাতা সংস্থা। তারা সবাবই একবাক্যে বলছে, ভারতের সামনে পড়ে আছে দারুণ উজ্জ্বল এক ভবিষ্যৎ।
চীনের নেতা (প্রেসিডেন্ট) যেমন কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন তিনিও সে-রকম ক্ষমতা ভোগ করতে চান কিনা প্রসঙ্গে-
ভারত একটা গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্র আমাদের অস্থি-মজ্জায়। অন্যসব রাজনৈতিক দলের প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলবো, আমি একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি দেশের জন্য যেটা সবচে’ ভালো হবে সেদিকে লক্ষ্য রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিপক্কতা ও প্রজ্ঞা তাদের রয়েছে। অতএব আপনারা যদি আমার কাছে জানতে চান ভারতকে চালাতে স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থা দরকার কিনা তাহলে আমি বলবো ‘না, দরকার নেই’। যদি জানতে চান এমন লোক দরকার কিনা যে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায় তাহলে আমি বলবো, ‘না, এমন লোকের দরকার নেই’। আমাকে যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সম্পদ, ক্ষমতা, সমৃদ্ধি ও খ্যাতি ---এসবের কোনো একটাকে বেছে নিতে বলা হয় তাহলে সহজেই এবং দ্বিধাহীন চিত্তে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকেই বেছে নেব।
ভারতের ধর্মীয় বৈচিত্র্য, যা এখন হুমকির মুখে পড়েছে বলে অনেকে মনে করছেন---সে প্রসঙ্গে
আমার নিজের দর্শন, আমার দলের দর্শন এবং আমার সরকারের দর্শন হচ্ছে ‘‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’’—সবাইকে সাথে নিয়ে, সবার ভাগ্যের উন্নয়ন’’। মানে, সবাইকে সাথে নিয়ে অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলা। সংখ্যালঘুদের ধর্মের ব্যাপারে যখনই কেউ কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে, তখনই আমরা তা নাকচ করেছি। সরকারের কাছে পবিত্র গ্রন্থ বলতে একটাই; আর তা হচ্ছে ভারতের (ধর্মনিরপেক্ষ) সংবিধান। আমাদের কাছে সবচে বড় অগ্রাধিকার হচ্ছে দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতা। সকল ধর্ম ও সকল সম্প্রদায়েরই অধিকার সমান, এবং আমার দায়িত্ব হচ্ছে সবার পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ সুরক্ষা নিশ্চিত করা। ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের ভিত্তিতে কোনো ধরনের বৈষম্য আমার সরকার মেনে নেবে না বা সহ্য করবে না।
কি তার প্রেরণার উৎস, সে প্রসঙ্গে—
(প্রসঙ্গটা তুলতেই গলা ধরে এলো তার, চোখ ভরে উঠলো জলে) আমার হৃদয়ের গভীরে গিয়ে বাজলো আপনাদের কথা। খুবই গরিবঘরে জন্ম আমার। যখন খুব ছোটোটি ছিলাম ট্রেনের কামরায় কামরায় চা- বিক্রি করতাম। আমার মা ছিলেন কাজের মাসি। সংসার চালানোর জন্য মা আমার মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতেন, বাসন পেয়ালা ঘটিবাটি পরিষ্কার করতেন। দারিদ্র্যকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। দারিদ্র্যের মধ্যেই আমার বসবাস, বেড়ে ওঠা। আমার পুরোটা শৈশব ছিল দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। এক দিক থেকে আমার জন্য বরং দারিদ্র্যই ছিল প্রথম প্রেরণা--- গরিব মানুষের জন্য কিছু করবার সংকল্প ও অঙ্গীকারের জন্ম দারিদ্র্যই দিয়েছে আমার মধ্যে। ...তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি আর নিজের জন্য বাঁচবো না, বাঁচবো অন্যদের জন্য। ’’
বাংলাদেশ সময়: ১১০৩ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৫
** নরেন্দ্র মোদী: ভারতের নেতা থেকে বিশ্বনেতা
মুক্তমত
টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোদী
‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’
... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।