সমুদ্র আমার খুব প্রিয়। উত্তরাধিকার সূত্রে আমার সন্তান পার্থিব এবং পূর্ণতাও এই সমুদ্র প্রিয়তাটুকু পেয়েছে।
আমার যখন খুব মন খারাপ হয় তখনো আমি সমুদ্রে যাই। হঠাৎ কাজ ফেলে সমুদ্র পাড়ে গিয়ে বসে থাকা আমার অনেক দিনের পুরোনো একটা অসুখ। সমুদ্র পাড়ে একা বসে থাকি, সৈকতের কোমল বালিতে পা রেখে হাঁটি কিংবা পানিতে পা ভেজাই। মন ভাল হয়ে যায়। কোন কোন ভোরে সূর্যোদয়ের মায়াবী আলোয় ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলায় মগ্ন হই। সারা পৃথিবীকে তখন কী যে পবিত্র লাগে! সমুদ্রের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালে তার বিশালতার কাছে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়। কী তুচ্ছ এই মানুষ জীবন! সমুদ্রের কাছ থেকে আমি প্রতিবার নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা পাই।
গত কয়েক দিন হল আমি সমুদ্রের মুখোমুখি হবার মত সাহস অর্জন করতে পারছি না। যতবার ভাবছি সমুদ্রে যাব ততো বারই চোখের সামনে সিনেমার দৃশ্যেও মত বারবার ভেসে উঠছে উত্তাল ঢেউয়ে দোদুল্য মান কাঠের তৈরি কতগুলো নৌকার ছবি। প্রতিটি নৌকা ক্ষুধার্ত-অসহায় শতশত শিশু-নারী-পুরুষে ঠাসা।
নিজ মাতৃভূমি থেকে উৎপাটিত রোহিঙ্গারা কিংবা পরিবারের সামান্য স্বচ্ছলতার আশায় সংগ্রামরত বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষেরা ছোট ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকায় সমুদ্র পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। কিন্তু নিজস্ব জলসীমা থেকে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে স্ব স্ব দেশের পুলিশ। পত্রিকায় দেখলাম কোন এক দেশের পুলিশ ইঞ্জিন নষ্ট করে বিকল নৌকাগুলোকে ফের সমুদ্রে ঠেলে দিয়েছে। দালালের খপ্পরে পড়ে, প্রতারিত হয়ে এসব ভাগ্যান্বেষী মানুষের সবশেষ ঠিকানা হয়েছে সমুদ্র।
চরম অনিশ্চয়তার মুখে কেউ কেউ সমুদ্রের বুকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতি হয়েছে, পিপাসায় পান করেছে নিজের মুত্র। নিজেদের মধ্যে হানাহানিতেও মারা গেছে কয়েক জন। কোন দেশ শুরুতে তাদের গ্রহণ করতে চায়নি, ব্যতিক্রম ছিলফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়ার জেলে সম্প্রদায়। নিজেদের শত সমস্যা থাকতেও ফিলিপাইন এসব নৌকার মানুষদের নিজেদেও ভুখণ্ডে আশ্রয় দিতে চেয়েছে। আর সমুদ্র থেকে ইন্দোনেশিয়ার জেলেরা অনেককে উদ্ধার করেছে।
এখনো হাজার হাজার মানুষ সমুদ্রে ভাসছে। তারা জানে না তাদের গন্তব্য কোথায়? এদিকে রোগে-শোকে-ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে অনেকেই। সমুদ্রের বুকে নৌকাগুলো যেন এক একটা ভাসমান কফিন!
এমতাবস্থায় ফিলিপাইনের পাশাপাশি মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড আর ইন্দোনেশিয়া নিজ নিজ দেশের মাটিতে এইসব উদ্বাস্তুকে সাময়িকভাবে আশ্রয় দিতে রাজী হয়েছে। নিজ ভূখণ্ডে জায়গা দিতে রাজী না হলেও অস্ট্রেলিয়ার সরকার এই সমস্যা সমাধানে বিশেষ ভুমিকা পালন করবার আগ্রহ দেখিয়েছে। এদিকে অস্ট্রেলিয়ার সিভিল সোসাইটির একাংশ এইসব বিপদাপন্ন মানুষদের উদ্ধার ও পুনর্বাসনের পক্ষে সোচ্চার।
মানবপাচারের এই সমস্যাটা জরুরি ভিত্তিতে সমাধানের লক্ষ্যে জাতিসংঘের ভূমিকাও প্রশংসনীয়।
আপাত দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, সমুদ্র পথে মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের মত দেশগুলো এই উদ্বাস্তুদের সাময়িকভাবে ঠাঁই দিতে রাজী হয়েছে। কিন্তু তারপর এদের কী হবে তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। পাশাপাশি অবৈধ পথে মানবপাচার রোধে বাংলাদেশ সরকারকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।
যারা সমুদ্র পথে মানবপাচারে জড়িত, তাদের গ্রেফতার করে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনতে হবে। অবৈধ মানবপাচার রোধে ব্যাপক গণসচেতনতা বাড়াতে হবে।
ভবিষ্যতে যেন আর কেউ প্রতারিত হয়ে মানবপাচারকারীদের খপ্পরে না পড়ে।
আর যারা এখনো সমুদ্রের বুকে ভাসছে, তাদের জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার করতে হবে।
এভাবে অসংখ্য মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারি না। আমাদের নিজস্ব বা গোষ্ঠীগত অবস্থান থেকে যার যা সামর্থ আছে তাই নিয়ে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
সম্মিলিতভাবেই আজ বিপন্ন মানুষের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। মানবতা পরাজিত হলে আমাদের বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে যাবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কোন মুখে দাবি করব, মানুষই সৃষ্টির সেরা জীব?
ডঃ আবুল হাসনাৎ মিল্টন: কবি ও চিকিৎসক, বর্তমানে নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত
বাংলাদেশ সময়: ২২২৭ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৫
জেডএম