ঢাকা, শনিবার, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১১ মে ২০২৪, ০২ জিলকদ ১৪৪৫

মুক্তমত

একটু গল্প করি

জসির আহমদ, ম্যানিটোবা, কানাডা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১০ ঘণ্টা, জুন ১, ২০১৫
একটু গল্প করি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লেখার অভ্যাস আমার নেই বললেই চলে। মাঝেমধ্যে কোনো নোট লিখলে আমার কাছে মনে হয়, পাশে বসা কারো সাথে গল্প করছি।

ভাবছিলাম আজকে একটু গল্প করি। এস.এস. সি পরীক্ষার ফল প্রকাশ দেখে পরীক্ষা নিয়ে ছোটবেলার অদ্ভুত কিছু স্মৃতি মনে আসছে। আমার বন্ধুরাও এখনো জানে না, আমি প্রায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষার আগের রাতে ভীষণ কান্নাকাটি করতাম, ভয়ে। বলতে পারেন আমার একটা বাজে অভ্যাস ছিল, কখনো কমার্শিয়াল পড়া পড়তে পারতাম না। সাজেশন্স দেখে পড়াকে আমি কমার্শিয়াল পড়াই বলি। সব পড়তে গিয়ে যখন দেখতাম কিছু অংশ বাকি থেকে যাচ্ছে তখনই কান্না শুরু। বোনেরা বোঝাতে এলে আমার একটাই কথা, যেটা পড়ি নি যদি সেটাই চলে আসে! কান্না দেখে সম্ভবত আশ্বস্ত করতেন, না এখান থেকে আসবে না। কিন্তু কে শুনে কার কথা, যদি চলে আসে! সবশেষে বাবা-মায়ের লাইসেন্স প্রদান -“পরীক্ষায় এলে আসবে, না পারলে দেবে না, রেজাল্ট ভালো না হলেও তো তোমাকে কেউ কিছু বলবে না”। আস্তে আস্তে কান্নাও থেমে যায়। মজার বিষয় হচ্ছে, বোনরা যেগুলো বলতো আসবে না সেগুলো আসলেই আসত না। আমার কাছে এখনো বিষয়টা রহস্য, কিভাবে বুঝতেন আসবে না! জিগ্যেস করা হয় নি কখনো। বাবা মায়ের এমন লাইসেন্স দেয়ার পরেও যদি ভালো কিছু করতে না পারি তা হবে নিঃসন্দেহে আমার ব্যর্থতা, তবে বিশ্বাস করুন ভালো ফলাফলের জন্য বাবা মায়ের এমন ভূমিকা খুবই জরুরি।
 
আমি জানি, যারা এস.এস.সি পরীক্ষায় মাত্র-উত্তীর্ণ হয়েছে তারা কোন কলেজে ভর্তি হবে বলে পরিকল্পনা করছে, ঠিক তেমনি ভাবছে কোন কোন স্যারের বাসায় ব্যাচে ভর্তি হবে, বাসায় কয়জন স্যার রাখবে। অনেকে আবার অগ্রিম ব্যাচে পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছে নিশ্চয়। পড়াশুনার প্রতি এই আগ্রহের জন্য প্রশংসা করতেই হবে। তবে আমি বিষয়টার সাথে ভিন্নমত পোষণ করি। বাসায় স্যার রেখে বা স্যারের বাসায় কোচিংয়ে গিয়ে পড়া বিষয়টাই আমার পছন্দের না। আমি পাশ করে আসার বেশি দিন হয় নি তাই বলছি, প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে না পড়ে নিজে নিজে ভালো ফল করা সম্ভব এবং এই তৃপ্তি অন্য কিছুতে নেই। এই বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে অনেকের অনেক যুক্তি থাকবে। অনেকে কলেজের জীর্ণদশাকে দায়ী করবেন, শিক্ষকদের পাঠদান নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন, আরো অনেক কিছু। যার কোনোটা নিয়েই আজ আমি লিখছি না। আমি খুঁজছি সেই সাহসী ছেলে বা মেয়েকে যে নিজে নিজে পড়ে শেখার এই চ্যালেঞ্জটা নিতে পারবে।
 
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় সবচেয়ে পছন্দের তালিকায় ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিক্যাল থাকলেও প্রাইভেট টিউটর হিসাবে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং গণিতের ছাত্রদের কদর একটু বেশিই। সম্ভবত সে কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কিছুদিনের মধ্যেই ছাত্র পড়ানোর বেশকিছু অফার পাই। কিন্তু বিষয়টা আমার জন্য ছিল দ্বৈত নীতির মত। যেহেতু আমি কখনো কোনো স্যারের বাসায় গিয়ে বা বাসায় স্যার রেখে পড়ি নি তাই বিষয়টা আমার নীতি বিরোধীই মনে হচ্ছিলো। অবশ্য একেবারে যাইনি বললে ভুল বলা হবে। এস এস সি পরীক্ষার সময় চ্যালেঞ্জ নিতে পারলেও এইচ এস সি’র সময় সাহস হারাই, বন্ধুদের সাথে মডেল টেস্ট দেয়ার জন্য একটা কোচিংয়ে ভর্তি হই। কিন্তু আল্লাহ্‌ সম্ভবত চাননি আমি কোচিংয়ে পড়ি। ভর্তির কিছুদিনের মধ্যে সেই কোচিং সেন্টারটাই বন্ধ হয়ে গেল! এরও আগে পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে স্কুলের আয়োজনে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য বিশেষ ব্যাচ অবশ্য বন্ধ হয়নি। সে যাই হোক, খেয়াল করলাম আমি না পড়ালে কি হবে, স্যারের তো আর অভাব নাই। অভিভাবকেরা ঠিকই শিক্ষক পাচ্ছেন। তাই কৌশল পরিবর্তন, পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।   প্রথম যেদিন দুইটা ছাত্রকে পড়ানো শুরু করি, কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। তাই প্রথমেই বললাম, আমি সবচেয়ে খুশী হব সেদিন যেদিন তোমরা এসে আমাকে বলবে, স্যার আপনাকে আর আমাদের দরকার নেই, আমরা এখন নিজেদের পড়া নিজেরাই পড়তে পারি। জানি না তাদের আত্মবিশ্বাস দিতে পেরেছিলাম কি না। তবে বেশিদিন পড়াতে হয় নি। এরপর আরো কয়েকজনকে পড়িয়েছি। পড়াতে গিয়ে আমার শুধু এই মনে হয় নি যে এরা নিজেদের পড়া নিজেরাই করতে পারবে; আমার মনে হয়েছে এরা প্রত্যেকেই বড় হয়ে সমাজ বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। অন্তত ওদের দুষ্টুমির ধরন দেখলে তাদের সৃজনশীলতা আঁচ করা যায়। আমি দুষ্টুমি বলেছি, বেয়াদবি বলি নি। অনেককে বলতে শুনি আজকালকার ছাত্রদের নাকি গুরুভক্তি নেই। আমি এখানেও দ্বিমত করি। শ্রদ্ধা দেখানোর জন্য পা ছোঁয়ার দরকার হয় না, চোখ দেখলেই বোঝা যায়। আমার ছাত্রদের কারো চোখই তাদের প্রতি আমার স্নেহ একটুও কমায় নি। একটি কলেজে কিছুদিনসহ সব মিলিয়ে শ’খানেক শিক্ষার্থীকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। পরিসংখ্যানের ভাষায় এদেরকে যদি স্যাম্পল হিসাবে নিই তাহলে আমাকে বলতেই হবে আমাদের দেশের একশতভাগ শিক্ষার্থীই যথেষ্ট ভদ্র।
 
খেয়াল করলাম, অনেকে ‘আজকালকার এ-প্লাস’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। আমি মানি, প্রশ্ন ফাঁস হওয়াসহ আরো খুঁটিনাটি অনেক কিছু নিয়েই প্রশ্ন আছে। সেটা আমাদের দায়িত্বশীলদের দায়িত্বশীলতার অভাব। তাই বলে হাজারো মেধাবী শিক্ষার্থীর অর্জনকে তুচ্ছ করে, তাদের আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানার, খাটো করার  অধিকার আমাদের কারো নেই। আমি মনে করি, যে শিক্ষার্থীদেরকে কাছে থেকে দেখেছি এরা সবাই অন্তত আমার থেকে অনেকগুণ বেশি মেধাবী। ছোটবেলা আমি এবং বন্ধুদের সবার কাছেই অসম্ভব কৌতূহলের একটা বিষয় ছিল। শীতের কুয়াশাঘেরা সকালে হাঁ করে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করা। বিদেশি বাচ্চাদের কাছে পুলিশকে বিশেষ আগ্রহের বিষয় মনে হলেও আমাদের দেশের বাচ্চাদের সেই আগ্রহের জায়গাটুকু দখল করে নিয়েছে পাড়ার সব থেকে মাস্তান ভাইয়েরা। বুঝতেই পারছেন শীতের সকালে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করাটা কেন কৌতূহল এবং রোমাঞ্চকর মনে হত। কিন্তু আমি কত বোকাই না ছিলাম, জানতাম না কেন শীতের দিনেই ধোঁয়াটা আসে। গরমের দিনে এটা হয় না কিন্তু শীতের দিনে হয় এতটুকু চিন্তা করেই আমি ক্লান্ত হয়ে যাই, আর ভাবি নি। আসলে মানুষ কখনো জানে না সে সাফল্যের কত কাছ থেকে ফিরে আসছে। আরেকটু ভাবলেই উত্তরটা তখনই পেয়ে যেতাম। এই একই প্রশ্ন একবার ক্লাস এইটের কিছু ছাত্রকে জিগ্যেস করলাম। চমৎকার বিষয় হচ্ছে, ছাত্ররা কিছুক্ষণ ভাবল এবং অনেকেই প্রায় সঠিক উত্তরটাই দিয়ে দিল। এদের নিয়ে আমরা আশাবাদী তো হতেই পারি। আমরা যা পারছি না তা তারা নিশ্চয় পারবে। আমার মত যারা উত্তরটা জানেন না তাদের জন্য সংক্ষেপে বলি। ধোঁয়া আসলে আমাদের মুখ থেকে আসে না। আমরা যে কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করি তা যথেষ্ট পরিমাণ তাপশক্তি আমাদের ভিতর থেকে নিয়ে আসে যা বাতাসে উপস্থিত পানি কণাকে (কুয়াশাকে) বাষ্পে পরিণত করে; সেটাই আমাদের কাছে ধোঁয়া মনে হয়। গরমের দিনে কুয়াশা থাকে না তাই ধোঁয়াও দেখি না।
 
যে কথা বলছিলাম, আমি সব থেকে অবাক হই যখন দেখি ক্লাস ফোর বা ফাইভের বাচ্চাদের জন্য বাসায় অনেকে শিক্ষক রাখেন। এবং এই বিষয়টা শহরের শিক্ষিত পরিবারগুলোতে আরো বেশি দেখা যায়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয়টা আমরা খেয়ালও করি না। এই ছোট্ট বাচ্চাদের জন্য বাসায় শিক্ষক রেখে আমরা তাদের অবচেতন মনে ঢুকিয়ে দিচ্ছি, জীবনে চলতে গেলে লাঠিতে ভর দিতে হয়। তাদেরকে নির্ভরশীল করে তুলছি। যারা এরকম করছেন তারা সন্তানের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল দেখতে পারেন, তবে সাথে ভবিষ্যতের জন্য কিছু মামা-চাচা খোঁজার কাজটা আগে থেকেই করে রাখতে পারেন। সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ভালো ফলাফল করেও কারো সাহায্য ছাড়া চাকরি হচ্ছে না দেখে যদি ভেঙে পড়ে তাহলে সে দায় আপনার। কোনো কঠিন মুহুর্তে কারো দিকে না চেয়ে নিজে নিজে চেষ্টা করে যাওয়ার মনোবলটুকু অজান্তেই হয়ত আপনি নষ্ট করে দিচ্ছেন, কচি বয়সে প্রাইভেট শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে। তার চেয়েও বড় বিষয়, একটা শিশুকে নিজের মত করে চিন্তা করার কিছু সময় দিন। সারাক্ষণ শিক্ষকের আদেশ (হোম ওয়ার্ক) পালনে ব্যস্ত রাখাটা আমার কাছে যথেষ্ট বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয় না। বলতে পারেন, সময় পেলে তারা তো সেটাকে কাজে লাগায় না, নষ্ট করে। আমার মত হচ্ছে, নষ্ট করতে দিন। একটা শিশুকে প্রথম যেদিন নিজ হাতে খেতে বলা হয়, সে মুখে যে ভাতটুকু নেয় তার দু’একটা খায়, বাকিটুকু নষ্টই হয়। কিন্তু তাই বলে আজীবন নষ্ট করতে থাকে না।   আমি জানি, পাশের বাসার ভাবির ছেলের তুলনামূলক ভালো ফলাফল দেখলে নিজেকে ছোট মনে হয়। কিন্তু আমার বিনীত অনুরোধ, আপনার ছেলে বা মেয়েকে আরেকজনের সাথে তুলনা করার কোনো দরকার নেই। আপনার সন্তান যদি আব্দুর রহমান হয় তাহলে বড়জোর গতকালকের আব্দুর রহমানকে আজকের আব্দুর রহমানের সাথে তুলনা করুন। দেখুন, সে উন্নতি করছে কি না, এই টুকুই।
 
এত কথা বললাম, কিন্তু যাদের উদ্দেশ্যে লিখতে বসছি তাদেরকে অভিনন্দন জানানোই হয় নি। এইবারের সকল কৃতকার্য এস এস সি পরীক্ষার্থীকে অভিনন্দন এবং শুভ কামনা। সবাই হয়ত নিতে নাও পারো, অন্তত দু’একজনও যদি সাহস করে চ্যালেঞ্জটা নাও এবং স্যারের বাসায় বা কোচিংয়ে দৌড়াদৌড়ি না করে নিজের পড়া নিজেই গুছিয়ে নিতে পারো, আমি খুশী। কারণ, আত্মবিশ্বাসী দু’একজনই চাইলে একটা সমাজ, দেশ বদলে দিতে পারে। "

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অব ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রনমি, ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, উইনিপেগ, ম্যানিটোবা, কানাডা। ইমেইল: ([email protected])

বাংলাদেশ সময়: ২১১১ ঘণ্টা, জুন ১, ২০১৫
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।