আগামী ৬ জুন বাংলাদেশ সফরে আসছেন প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দু’দিনের এ সফর দুই বন্ধুদেশের মধ্যকার যোগাযোগ, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদারে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তিস্তা জলবণ্টন চুক্তির পাশাপাশি দু’দেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৫৪টি নদীর জলবণ্টন নিয়েও দ্রুত সমঝোতায় আসার কথা ভাবছে বাংলাদেশ। সীমান্ত সমস্যাও এতদিন অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে ভারত-বাংলাদেশকে বিব্রত করে এসেছে। ইন্দিরা-মুজিবের যৌথ সমঝোতা সূত্রও এতদিন হিমঘরে বন্দি ছিল নানান অস্বস্তিকর রাজনৈতিক কারণেই। পশ্চিমবঙ্গের কোনো মুখ্যমন্ত্রী ও ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী এই অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটি সমাধানের পথ খুঁজে পাননি!
ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত গভীরতর দুঃসময়ের মধ্যে যাপনকাল পেরিয়ে অবশেষে মানবিক জীবন যাপনের সঠিক মানচিত্রের অধিকার পেতে চলেছেন হাজার হাজার ঠিকানা, দেশ ও নিরাপত্তাহীন মানুষ! স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়োজনীয় ইতিবাচক ভূমিকাই স্থল সীমান্ত চুক্তি রূপায়ণকে গতি দিতে সক্ষম হয়েছে। ইতিবাচক ভূমিকা ছিল ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়, সর্বক্ষেত্রেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করার বাস্তবোচিত পদক্ষেপ নিতে তার ভূমিকা বরাবরই ঐতিহাসিক বাক নির্মাণের সহায়ক হয়েছে। অন্ততঃ ইতিহাস তাই বলছে। বৃহত্তম প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য কতটা প্রয়োজনীয় ও জরুরি, সেটা পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো কন্যা শেখ হাসিনাও বুঝতে ভুল করেননি। তার সঠিক কূটনৈতিক (বৈদেশিক) অভিমুখ বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বার্থেই খুব বেশি দিকভ্রান্ত হয়নি বলেই মোদি বাংলাদেশকে এই উপমহাদেশে ভারতের প্রতিবেশী হিসেবে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার কথা ভাবছেন।
মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রধান উদ্দেশ্য স্থল সীমান্ত চুক্তি সম্পন্ন করা। আন্তরিক ইচ্ছা ছিল তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি নিয়েও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর। কিন্তু বিষয়টা পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সার্বিক সম্মতি ছাড়া তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি এ যাত্রায় বাস্তবায়িত হচ্ছে না। শেখ হাসিনার সঙ্গে তার এ ব্যাপারে ‘সদর্থক’ আলোচনা হবে, এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। ভারতের পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যেই মমতাকে নিয়ে ঢাকা যেতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশ নিশ্চিত ছিল, মনমোহন-মমতার সম্মতিতেই তিস্তাচুক্তি সম্পন্ন হবে। কিন্তু শেষমুহূর্তে মমতা তার ঢাকা সফর বাতিল করে বাংলাদেশের প্রত্যাশাকে ‘অপ্রত্যাশিত আঘাত’ করেছেন বলেই সেদেশের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস জন্মে গিয়েছে। চলতি বছরের গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরে গিয়ে হাসিনার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের চেষ্টার পাশাপাশি তিনি ভাষাশহীদদের উদ্দেশ্যে গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলে এসেছিলেন, তিস্তার ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন, আমি বিষয়টা দেখছি।
তার ওই আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে এবং মোদির সঙ্গে মমতা ঢাকায় এলে অমীমাংসিত তিস্তা সমস্যার সমাধান হবে, এমনটাই নানাভাবে আলোচিত হচ্ছিল। কিন্তু সে আলোচনাও থমকে গেল মমতারই সিদ্ধান্তের কারণে। তিস্তা নিয়ে এবারে আলোচনা হবে না, এই শর্তেই মমতা ঢাকা যাচ্ছেন! সুতরাং বাংলাদেশে ফের হতাশা!
কিন্তু তিস্তা-নৈরাশ্যটুকু বাদ দিলে আশারও রয়েছে অনেক কিছুই। সীমান্ত সন্ত্রাসের অভিযোগে অস্থির ছিল ভারত-বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্তজুড়ে। এখন স্থিতি আসবে অনেকটাই। কথায় কথায় রক্তাক্ত হবে না সীমান্ত। মোদি ও হাসিনা সম্মত হলে সীমান্ত হাটের সংখ্যাও বাড়বে। ছিটমহল সমস্যার সমাধান হলে দাপট কমবে জঙ্গি দুর্বৃত্তদের।
মূলতঃ এপার বাংলার পাশাপাশি উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলোর স্বার্থই জড়িত রয়েছে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ সিদ্ধান্তের সঙ্গে। তা সে বাণিজ্যই হোক অথবা সংস্কৃতি। ফলে দু’দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার কাঁটাগুলো তুলে ফেলা অত্যন্ত জরুরি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশ হয়ে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে যাতায়াতের সুযোগ বাড়তে পারে। বাড়তে পারে বন্দর বাণিজ্যের সুযোগও। ভারত-বাংলাদেশ-ভুটান-নেপালকে নিয়ে সার্ক অঞ্চলের মধ্যেই একটি উপঅঞ্চল গড়ে তোলার ভাবনা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে পর্যটনের প্রভূত উন্নতি সম্ভব। মোদি-হাসিনার আলোচনায় এসব প্রাধান্য পাবে বলেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আশা করছেন।
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ভাষা-সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির মধ্যে যে আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে, তা মৌলবাদী অপচ্ছায়ায় প্রায়শই ঢাকা পড়ে যায়। এই সাংস্কৃতিক অপচ্ছায়ার হাত থেকে দুই বাংলার সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিল্প, বিশেষ করে ভাষাকে রক্ষার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ যদি দুই প্রধানমন্ত্রী নিতে পারেন, তাহলে লাভ উভয় পক্ষেরই। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো যাতে এদেশেও দেখা যায় সে ব্যাপারেও দু’দেশ সদর্থক ভাবনা ভাববে, এমনটা আমরা আশা করতেই পারি।
একজন ভারতীয় বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে আশা করতে পারি, তিস্তা নিয়ে মমতা অযথা কালক্ষেপণ করবেন না। ২০১৬ সালে বিধানসভার নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটা তার রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা। পশ্চিমবঙ্গ তথা উত্তরবঙ্গের স্বার্থ রক্ষা করেই তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। সুতরাং তিস্তা সমস্যা যতটা গভীর ততটাই কঠিন, মমতার পক্ষে সঠিক সমাধান খুঁজে বের করা। মমতার সিদ্ধান্ত এক কথায় শেখ হাসিনা তথা বাংলাদেশ সরকার মেনে নেবেন, এমনটাও আশা করা ভুল হবে। সেক্ষেত্রে দ্রুত সমাধান হবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। এ ব্যাপারে আলোচনা দীর্ঘমেয়াদী হওয়াই সম্ভব। তবু সব মিলিয়ে মোদির এই ঢাকা সফর যে অনেক আশাব্যঞ্জক, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই!
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
সম্পাদক, মানসাই টাইমস (পাক্ষিক সংবাদপত্র) ও সাহিত্য ভগীরথ (সাহিত্য পত্রিকা)
পশ্চিমবঙ্গ।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২০ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০১৫
এসএস/এমজেএফ
** আমি আশাবাদী | মনিশংকর রায়
** দুই পারের রাজনীতি ও মোদির বাংলাদেশ সফর | সৌরাংশু সিনহা
** ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী এক নতুন যুগের ভোরে | রাসবিহারী দত্ত
** ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস ওরে মন হবেই হবে’ | গোপাল বিশ্বাস
** মোদি-মমতার বাংলাদেশ সফর | স্রোতস্বিনী চট্টোপাধ্যায়
** মোদির বাংলাদেশ সফর হোক বিশ্বের দৃষ্টান্ত | নৃপেন চক্রবর্তী
** সফর যেন আমাদের না বদলায় | সরোজ দরবার
** মোদি-মমতার যৌথ সফর | অরুণ চক্রবর্তী
** মোদির বাংলাদেশ সফরে ভারতীয় হিসেবে আশা | অভীক দত্ত
** মোদির বাংলাদেশ সফর: কিছু ভাবনা | পরিচয় পাত্র
** অনেক কিছুই পাওয়ার আশা | ড. অমিতাভ চক্রবর্তী
মুক্তমত
মোদির দেশের মুক্তমত
সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক মেলবন্ধনের স্বপ্ন দেখছে পশ্চিমবঙ্গ | বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
মুক্তবিশ্লেষণ/মুক্তমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।