মায়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সম্প্রতি বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) নায়েক আবদুর রাজ্জাককে অপহরণ করেছে। প্রকাশিত খবর অনুসারে, নায়েক রাজ্জাকের নেতৃত্বে বিজিবির ছয় সদস্যের একটি দল ১৬ জুন সকালে নাফ নদীতে টহল দিচ্ছিল।
রাজ্জাক তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন। কারণ সীমান্ত দিয়ে অবৈধ প্রবেশ এবং বিভিন্ন চোরাচালান ঠেকানো বিজিবির দায়িত্বের আওতাভুক্ত কাজ। দায়িত্ব প্রাপ্ত কোন সৈনিক দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে কিংবা উদাসীনতা প্রদর্শন করলে তাকেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। মায়ানমারের বিজিপির ট্রলারটি জলসীমা আইন লংঘন করে বাংলাদেশ জলসীমায় প্রবেশ করলেও বিজিবি তাদেরকে কোন ধরনের আক্রমণ করেনি। কেবল জলসীমা ছেড়ে যেতে বলেছে। এটুকু দায়িত্ব তো নায়েক হিসেবে রাজ্জাককে পালন করতে হবে। এবং তিনি তাই করেছেন। এতটুকুতেই তাকে অপহরণ করা হল। এটা তো মায়ানমারের বাড়াবাড়ি পর্যায়ের আচরণ। মায়ানমার বাংলাদেশের কেবল সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র নয়, বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রও বটে। বন্ধুর সাথে বন্ধুর এমন আচরণ অশোভনীয় এবং কখনো কাম্য নয়। এটা আন্তর্জাতিক আইনেরও পরিপন্থি।
রাজ্জাককে ফেরত না দিয়ে বিজিপির ফেসবুকে তিনটি ছবি প্রকাশ করা হয়। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রাজ্জাকের নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে আর তার পেছনে বিজিপির একজন সদস্য দাঁড়ানো। দ্বিতীয় ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রাজ্জাকের সামনে তার অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী রেখে তাঁকে আসামির মতো করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। আরেকটি ছবিতে তাকে হাতকড়া পরা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে।
বিজিপি সদস্যরা জেনে শুনে বাংলাদেশ জলসীমায় প্রবেশ করেছেন এটা তাদের প্রথম অপরাধ। নায়েক রাজ্জাককে অপহরণ করেছেন এটা দ্বিতীয় অপরাধ। অপহরণের পর তাঁকে শারীরিক নির্যাতন করা তৃতীয় অপরাধ। ঘটনা পরবর্তী দফায় দফায় বিজিবির পাঠানো পতাকা বৈঠকের অনুরোধে সাড়া না দেওয়ায় এটা চতুর্থ অপরাধ। আমাদের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে-বিজিপি আসলে কি চায়? পঞ্চম ভুলটা করার সুযোগ যাতে বিজিপি না পায় সেজন্য রাজ্জাককে ফেরত আনতে কূটনৈতিক জোর প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখতে হবে। কেবল ফেরত নয়, আমরা রাজ্জাককে সুস্থ অবস্থায় জীবিত এবং সৈনিকের প্রাপ্য মর্যাদা সহকারে ফেরত চাই।
গত বছর ২৮ মে বান্দরবানের পাইনছড়ি সীমান্ত এলাকায় বিজিপির সদস্যরা বিনা উসকানিতে বিজিবির সদস্যদের উপর গুলি চালায়। ওই সময়ে বিজিবির সদস্য নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমানকে একইভাবে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে তাকে হত্যা করা হয়। দুই দিন পরে অনেক টালবাহানা করে মিজানুরের লাশ ফেরত দিতে সম্মত হয় বিজিপি। বিজিবির প্রতিনিধিদল মিজানুরের লাশ নিতে গেলে উল্টো তাঁদের ওপর আবারও গুলি চালায় বিজিপি। মিজানুরের হত্যার এক বছর পেরুতেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। নাগরিক হিসেবে বিজিপির এমন নীতি বিরুদ্ধ আচরণে আমরা হতবাক এবং গভীর মর্মাহত। কেননা দেশের পতাকা রাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতীক হলে, দেশের সৈনিক সেই স্বাধীনতা রক্ষার মূর্ত প্রতীক। তাই রাষ্ট্রের পতাকা এবং সৈনিক অপমানিত হলে পুরো রাষ্ট্র এবং জাতি অপমানিত হন। এদেশের ১৬ কোটি মানুষকে অপমানিত করার অধিকার বাংলাদেশ কাউকে দেয়নি।
আমরা এও দেখতে পাচ্ছি যে, বাংলাদেশ অত্যন্ত ঠাণ্ডা মেজাজে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবেলা করার আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা ভীরুতা কিংবা দুর্বলতার লক্ষণ নয়, এটা এক বন্ধুর প্রতি আরেক বন্ধুর সর্বোচ্চ সহনশীলতা এবং বীরত্বের লক্ষণ। মায়ানমারের উচিত বাংলাদেশের এই নমনীয়তাকে সম্মান করা।
মায়ানমার এবং বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা দুইটি রাষ্ট্র্। ভারত তো বটেই। এই তিন রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিবেশীর সুসম্পর্ক বজায় না থাকলে এই তিন রাষ্ট্রই সমানে সমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সবক্ষেত্রে দেশগুলোর ওপর বিরুপ প্রভাব পড়বে সন্দেহ নেই। এই কথাটা কেবল বাংলাদেশ একা বুঝলে হবে না, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকেও এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে মর্মে মর্মে। এমন কোন কিছু করা উচিত হবে না যাতে প্রতিবেশীর সুসম্পর্ক নষ্ট হয়।
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১২০৭ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০১৫
জেডএম