ঢাকা: এ বছর উচ্চমাধ্যমিক থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭ লাখ ২১ হাজার ৯৭৯, এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬১ হাজার ১৬২ জন। এই শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশের আশা থাকে কোন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল বিষয়ে লেখাপড়া করার।
বাকি থাকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন কলেজ। সেই সুযোগও প্র্রায় সাড়ে ৩ লাখের মত। সব মিলিয়ে মোটামুটি ৫ লাখ শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার সুযোগ হলেও বাকি ২ লাখের কোন গতি নেই!
এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই আকাঙ্ক্ষা থাকে কোন পাবলিক কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। কিন্তু অপর্যাপ্ত প্রতিষ্ঠান, আসনের সীমাবদ্ধতা, পছন্দের বিষয় না পাওয়া ও ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পারার কারণে এক প্রকার বাধ্য হয়েই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে যায় তারা। উদ্দেশ্য, এই সব বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান লেখাপড়া করে চাকরির বাজারে নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।
কিন্তু তাদের সবাই কি ধনী, উচ্চবিত্ত পরিবারের? এখানে ধনী-উচ্চবিত্তদের ছেলেমেয়েরা যেমন লেখাপড়া করে তেমনি নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরাও লেখাপড়া করে। এখানে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় ৬০-৭০ শতাংশই মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত। সেক্ষেত্রে তাদের অভিভাবকদের অনেক কষ্ট করেই সেই অর্থের সংস্থান করতে হয়।
সরকারের সামর্থের সীমাবদ্ধতার কারণে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারলো না, তাদের প্রতি কর্তৃপক্ষের সহানুভূতি তো দূরের কথা উল্টা তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হলো ভ্যাট নামক এক উদ্ভট করের বোঝা।
বাংলাদেশের ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী দেশে এখন কোটিপতি একাউন্টের সংখ্যা ৫১ হাজার ৫৫০। বাস্তবে এর সংখ্যা অনেক বেশি হলেও তাদের কত জনের ছেলেমেয়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ে? তাহলে সরকারের এই আর্থিক মানদণ্ডের বিবেচনা কতটা যুক্তিসঙ্গত? শিক্ষার্থীদের আর্থিক সঙ্গতি কতটুকু এই বাড়তি খরচ মেটানোর? এই বিষয়ে সরকারের কোন জরিপ ও পরিসংখ্যান আমার চোখে পড়েনি।
এই সিদ্ধান্ত শিক্ষাক্ষেত্রে যুক্ত করল আরেকটি বৈষম্য
এর মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে আরেকটি বৈষম্যের মাত্রা যুক্ত করা হলো। কেবল আর্থিক মানদণ্ডই যদি হয় ভ্যাট আদায়ের শর্ত- তাহলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ধনী ও উচ্চবিত্তের সন্তানেরা পড়ে না? পরিসংখ্যান বলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী উচ্চবিত্ত ও ধনী ঘরের ছেলেমেয়ে। তাহলে তারা কেন ভ্যাট আওতার বাইরে থাকবে? তারা কেন ভ্যাট না দিয়ে পড়বে? এর কি জবাব দেবেন অর্থমন্ত্রী? নাকি সেই অংক কষছেন পরের বছরের জন্য!
এক দেশের এক সরকারের আওতায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই ব্যবস্থার প্রবর্তন নিঃসন্দেহে একটি বৈষম্যমুলক দ্বিমুখী নীতি। একজন ছাত্রের পরিচয় সে ছাত্র এবং তাদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে অভিন্ন। সবাই রাষ্ট্রের সন্তান। কিন্তু অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রের এই বিমাতাসুলভ আচরণ তরুণ শিক্ষার্থীদের মনোভাব বিরূপ করবে।
কারণ এমনিতেই শিক্ষায় তাদের বিনিয়োগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। তার উপর আবার সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট সত্যিই হতাশাজনক। আর এই ক্ষোভ তরুণ শিক্ষার্থীদের বয়ে বেড়াতে হবে বাকি জীবন জুড়ে।
সংবিধানে শিক্ষার অধিকার সকলের জন্য সমান হিসেবে স্বীকৃত। এমন কি ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশেও স্পষ্ট উল্লেখ আছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হবে অলাভজনক ও সেবামূলক।
২০১০ সালে মালিকদের স্বার্থে বেসরকারি অধ্যাদেশের বিভিন্ন ধারার শব্দ ও ভাষার কৌশলগত পরিবর্তন এনে এর খরচ এবং মালিকদের মুনাফা শিক্ষার্থীর ফি’র উপর নির্ভরশীল করা হয়। সরকারও নিজেকে সেই বাণিজ্যে শরীক করে তার শাইলকের চরিত্র প্রকাশ করলো।
ভ্যাটের আওতা হবে অধিক বিস্তৃত, এটা তার মহড়া
সরকার যদি শিক্ষা থেকে উপার্জন করতে চায় তাহলে ‘শিক্ষা কর’ নামক আরেকটি কর ধনী ও উচ্চবিত্তদের উপর চালু করতে পারে। রাজনীতিক, এমপি, মন্ত্রী, আমলা, উচ্চবিত্ত ও ধনীদের সন্তানের বিদেশে লেখাপড়া করে। কানাডার ২টি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এই সব ব্যক্তিদের পরিবারদের জন্য প্রবাসে কিছু কিছু এলাকাই গড়ে উঠেছে। যা নিয়ে পত্রিকায়ও সংবাদ এসেছে। কারণ তাদের পরিবারের অর্ধেক সেখানে থাকে এবং ছেলেমেয়ে সেখানে লেখাপড়া করে। যাদের সামর্থ্য ও সুযোগ হয় না দেশের বাইরে যাবার তাদের প্রধান অংশই দেশের এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। যারা শিক্ষার পেছনে নিজেদের অর্থ দেশেই বিনিয়োগ করছে এখন তাদেরকেই দিতে হচ্ছে ভ্যাট নামের এই বাড়তি কর!
সরকার যদি শিক্ষার উপর ভ্যাট বসাতেই চায় তাহলে তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের উপর ভ্যাট না বসিয়ে বরং সমাজের ধনী ও উচ্চবিত্তদের উপর “শিক্ষাকর” আরোপ করুক। তাতে করে উচ্চবিত্তের সন্তান পাবলিক-প্রাইভেট যেখানেই পড়ুক সরকার কর পাবে সব ধনীদের থেকেই। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বিষয়ক বৈষম্য অন্তত থাকবে না।
শিক্ষার বিনিয়োগই সুদূরপ্রসারী ও বহুমাত্রিক
শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও শিক্ষার সাথে ব্যক্তির উন্নয়নের সম্পর্ক ও সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে বোধকরি কেউ বিতর্ক করবে না। একই সাথে নির্দিষ্ট স্তর অবধি শিক্ষার আর্থিক দায় রাষ্ট্র ও সরকারের তাও বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এমন কি পুঁজিবাদী সমাজও এই বাস্তবতা গ্রহণ করছে এবং শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছে। সীমিত সম্পদের জনসংখ্যাভিত্তিক দেশ বাংলাদেশের জন্য এই সত্যের উপলব্ধি অতি জরুরি। শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি উন্নয়নের গতি অনেক গুণ বাড়ানোর প্রধান উপায়। কিন্তু আমাদের দেশ যেন সেই বিষয়টিকে অবজ্ঞা করছে। যার প্রমাণ দেখছি শিক্ষায় সরকারের বিনিয়োগের প্রবণতায়। বর্তমান সরকারের ৭ বছরে শিক্ষায় বিনিয়োগ কমেছে ৪.১ শতাংশ। বিনিয়োগ টাকার অংকে বাড়লেও শতাংশের হারে নিম্নমুখী। কিন্তু ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি, বেতন-ভাতা অন্যান্য বাড়তি খরচ, টাকার অবমূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয় যোগ করলে যে বাড়তি অংকের কথা বলা হচ্ছে তা আসলে ফাঁকি।
সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্যে কারণে শিক্ষা বিস্তার-প্রসারে সরকারের পাশাপাশি উদ্যোগী হয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি-গোষ্ঠীও। যে কারণে দেশে শিক্ষার বিকাশ ও প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হচ্ছে। পর্যাপ্ত সরকারি বিনিয়োগ ও প্রতিষ্ঠানের ঘাটতির জায়গাটি পূরণ করছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। এখানে সবাই উঁচু নৈতিকতা ও মান বজায় রাখতে পারছে এমনটা নয়। কিন্তু এর দায় নিশ্চয় শিক্ষার্থীদের নয়। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন দুর্বলতা থাকলে তা তদারকির দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। উচ্চশিক্ষার গুণ-মান নিয়ে আলোচনা নতুন নয়, অনেক দিনের এবং তা ধারাবাহিক। ইউজিসিসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে এই ধারার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গুরু
তর অভিযোগ আছে। যে কারণে শিক্ষার্থীরা নানা ভাবে ক্ষতির স্বীকার ও ভুক্তভোগী। সেগুলোর সমাধান না করে তাদের উপর আবার চাপানো হলো করের বোঝা!
(ড. মঞ্জুরে খোদা, প্রাবন্ধিক, গবেষক)
বাংলাদেশ সময়: ০৪০১ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৫
আরআই