মানুষের জমি কেড়ে নিয়ে আবাসন, কবরস্থান ভেঙে বহুতল ভবন, জলাশয় ভরাট করে শিল্পায়ন। সীমাহীন লোভে প্রকৃতির ওপর আগ্রাসনে বাংলাদেশ পরিণত হচ্ছে পরিবেশ-ঘাতকদের অভয়ারণ্যে।
পরিবেশ আইনের প্রয়োগহীনতায় জড়িয়ে আছে অসহায় মানুষের কান্না ও দীর্ঘশ্বাস। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময়ে তীব্র মর্মবেদনা নিয়ে এ বাস্তবতা উপলব্ধি করেছি।
রাজধানী ঢাকার অদূরেই দক্ষিণখান। ‘আশিয়ান সিটি’ নামে প্রসিদ্ধ এক আবাসন প্রতিষ্ঠানের হাতে ঘটেছে ভয়ানক পরিবেশ সন্ত্রাস। সাড়ে ৫ কাঠা জমি হারিয়ে আমেনা বেগম বিলাপ করছেন, ৮ কাঠা জমি হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন মাজেদা বেগম।
মৃত রমজান বেপারীর কবর বুলডোজার দিয়ে উল্টে দেওয়া হয়েছে। বুলডোজারে ঘরবাড়ি উচ্ছেদ এবং পানি ও বিদ্যুৎ-লাইন বিচ্ছিন্ন করায় বাসিন্দাদের বিনিদ্র রজনী কাটাতে হয়েছে।
বিশাল জলাভূমি ভরাট করে ধূ-ধূ মরুভূমি করা হয়েছে। বাপ-দাদার ভিটা মাটি হারিয়ে উদভ্রান্ত মানুষ জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে যেয়ে প্রতিকার পায়নি।
অবশেষে পরিবেশ অধিদপ্তরের শরনাপন্ন হলে মানবিক ব্রত নিয়ে জনগনের পাশে দাঁড়াই।
২০১১ সালের ১৬ নভেম্বর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে আকস্মিক অভিযান চালিয়ে এ ধ্বংস যজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললাম।
অভিযানের সময় শতশত নারী-পুরুষ কান্না জড়িত কন্ঠে এর বিচার চেয়েছেন। ধ্বংসযজ্ঞে ব্যবহৃত বুলডোজার ও ট্রাকগুলো অকেজো ও জব্দ করলাম। ভূমিদস্যুতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জনগণকে সংগঠিতও করলাম।
অভিযান বন্ধে উচ্চ পর্যায় থেকে টর্নেডোর গতিতে চাপ এলেও তা উপেক্ষা করে অবৈধ এ বিশাল প্রকল্প বন্ধ করে পরিবেশ আইনে ভূমিদস্যুদের দণ্ডিত করা হয়।
অসহায় জনগণের কাছে অভিযানটি ছিল চাতক পাখির কাছে এক ফোঁটা বৃষ্টির মতো।
আমাকে ‘ত্রাণকর্তা’ হিসেবে পেয়ে মানুষ আনন্দে-আবেগে আপ্লুত হলো।
পরের দিন পত্রিকায় অভিযানের খবর ছাপা হলে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। অনলাইনে খবর জেনে উদ্বিগ্ন প্রবাসীরা তাদের অর্থ ফেরত চান, যারা এখানে প্লট কেনার জন্য অর্থ দিয়েছেন।
রুদ্রমূর্তিতে ভূমিদস্যুরা বলে, এ অভিযানে কোম্পানির আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৫০ কোটি টাকা এবং অভিযানের সংবাদ প্রকাশে প্রাতিষ্ঠানিক সুনামের ক্ষতি অপরিমেয়।
তাদের ভাষ্যমতে,‘অন্যদের টাকা দিয়ে কেনা গেলে মুনীর চৌধুরীকে কেনা যাবেনা কেন?”।
অভিযানের পর পরিবেশ আন্দোলনে সক্রিয় একটি সংগঠনকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানালে তারা উচ্চ আদালতে মামলা করে। ওই সংগঠনকে সবধরনের কাগজপত্র দিয়ে মামলার অবস্থানকে সুদৃঢ় করি।
দীর্ঘ শুনানির পর গত বছরের মার্চে মহামান্য হাইকোর্ট অবৈধ এ আবাসনের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এভাবেই মানবাধিকার ও পরিবেশ রক্ষার মহৎ অভিযানটির সফল পরিণতি ঘটে আদালতে।
সিলেটে টিলা উজার:
প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের আধার সিলেট, চারপাশ সবুজ-শ্যামল পাহাড়-টিলা। ঘটনাস্থল খাদিমপাড়ার মলাইটিলা। কিন্তু তাতে পড়েছে হিংসার শকুনরূপী এক পরিবেশ ঘাতকের লোলুপ দৃষ্টি।
মলাইটিলা পাহাড়ের চূড়ায় গোপনে বিশাল পুকুর খনন করেন এক হাউজিং কোম্পানির মালিক। তার পরিকল্পনা ছিল, ভারী বৃষ্টিপাতে পুকুরে পানি জমে আপনা-আপনিই পাহাড়টি ধসে পড়লে সমতল ভূমিতে গড়বে তার স্বপ্নের আবাসন প্রকল্প।
এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে ২০১১ সালের ২১ জুন ঢাকা থেকে প্লেনে করে সিলেট নেমে ঘটনাস্থলে অভিযান চালাই। গ্রেফতার হন ওই আবাসন প্রতিষ্ঠানের মালিক।
মুহূর্তের মধ্যে এলাকার জনগণকে অভিযানে সম্পৃক্ত করি। তাৎক্ষণিক ৬০/৭০ জন শ্রমিক দিয়ে সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৭০ ফুট উচ্চতায় মাটি তুলে পাহাড়টি পুনরায় ভরাট করা হয়।
কয়েক ঘণ্টা চলে পাহাড় জোড়া লাগানোর কাজ। সেখানে ১০০ বনজ গাছের চারাও রোপন করা হয়।
আর আবাসন প্রতিষ্ঠানের মালিককে পরিবেশ ধ্বংসের দায়ে ১০ লাখ ৬৮ হাজার টাকা জরিমানা করে তাৎক্ষণিক আদায় করি ৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। বাকি অর্থ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়টি পরবর্তী এক মাসের মধ্যে পুনঃভরাট করে প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিই।
ঘটনাটি যেন রোগীর ক্ষতস্থানে অপারেশন এবং সেলাই। এভাবে রক্ষা পেল মলাইটিলা পাহাড়।
বিরল এ উদ্যোগ পরিবেশ রক্ষা কার্যক্রমকে শক্তিশালী করে। পরিবেশ মন্ত্রী এটাকে সাফল্য গাঁথা হিসেবে প্রচার করেন দেশে-বিদেশে।
চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা:
পাহাড়-নদী-সমুদ্র বেষ্টিত সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। দৃশ্যপট প্রকৃতির স্বর্গকানন জেলার আনোয়ারা উপজেলার কোরিয়ান ইপিজেড। কারখানা স্থাপনের নামে সেখানে চলছে পাহাড় ধ্বংসের উন্মত্ততা।
২০১২ সালের ২৪ মার্চ সকালে পুলিশ, র্যাব এবং দশটি লংট্রেইলারের বহর নিয়ে সেখানে আকস্মিক অভিযান চালাই। অনেকগুলো শক্তিশালী বুলডোজার গগনবিদারী আওয়াজে রুদ্রমূর্তিতে ৪০ থেকে ৭০ ফুট উচ্চতার পাহাড় ধূলিসাৎ করছে।
যেন এক ভয়ংকর সুনামী! আমাদের দেখে সবাই বিদ্যুৎ গতিতে পালালো। ঘটনাস্থলে বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থানরত একে একে ১০টি ভারী বুলডোজার টেনে টেনে কী নিদারুন কষ্টে ট্রেইলারে একের পর এক তুলে ফেলি।
এভাবে দুপুর পর্যন্ত জব্দ করা বুলডোজারগুলো সরিয়ে ফেলি অনেক দূরে। অনেকটা কমান্ডো অভিযানের মতো শক্র পক্ষের সাজসরঞ্জাম দখল করে বিজয় কেতন উড়ানো!
ঘটনায় সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের বড় বড় কর্মকর্তারা তখন আত্মগোপনে। অভিযানের পর কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ছাড়পত্র বাতিল করে দেওয়া হয়। এ অভিযানের সংবাদে পুরো চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার ঘটনা বন্ধ হয়ে যায়।
এভাবে দু’বছর সহস্রাধিক অভিযানের মাধ্যমে সারাদেশে কৃষি জমি, নদ-নদী, জলাশয়, পাহাড়-পর্বত রক্ষার নিরবচ্ছিন্ন এক যুদ্ধ প্রকৃতি ও পরিবেশ-রক্ষায় জাতিকে প্রেরণা যুগিয়েছে।
দেশে পরিবেশ দূষণবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্তরা যত সভা-সেমিনার আয়োজন করেন, মাঠে নেমে ঘাম ঝরিয়ে যুদ্ধ করার তৎপরতা ততোটা নেই। বছরের কয়েকটি দিন ব্যানার নিয়ে মানববন্ধন কিংবা স্মারকলিপি প্রদানেই কী পরিবেশ রক্ষা হয়?
প্রয়োজন প্রতিনিয়ত দূষণের কাছে যাওয়া, দূষণ প্রতিরোধে কাজ করা, দূষণকারীদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা, দূষণবিরোধী অভিযানে পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশে থাকা এবং ক্ষতিগ্রস্থ মানুষকে আইনী সহায়তা দেওয়া।
সবুজ বাংলাদেশকে দূষিত পানি, বিষাক্ত বাতাস ও তপ্ত মাটির আধারে পরিণত করেছে দূষণকারীরা। শ্বাস নেবার বিশুদ্ধ বাতাস এবং প্রাণভরে তৃষ্ণা মেটানোর নির্মল পানি দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই নিপীড়িত নিসর্গ ও দূষণে জর্জরিত মানুষকে রক্ষায় চাই অদম্য মনোবল, দৃঢ় চেতনা, অক্লান্ত পরিশ্রম।
সততা ও সাহসের শক্তিতে বৈরী স্রোতেও ভূমিদস্যু এবং পরিবেশ ঘাতকদের প্রভাব-বলয় চূর্ণবিচূর্ণ করা সম্ভব। মানুষ ও পরিবেশের প্রতি বৈরীতা নয়, চাই সম্প্রীতি ও ভালোবাসা। সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক: সাবেক পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট), পরিবেশ অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৬ ঘণ্টা, জুলাই ০৭, ২০১৫
এমএ