ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শিশু রাজন হত্যা, ভার্চুয়াল ও সামাজিক বাস্তবতা!

আমিনুল ইসলাম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৫
শিশু রাজন হত্যা, ভার্চুয়াল ও সামাজিক বাস্তবতা!

রাজন নামে এক কিশোরকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে তার ভিডিও-দৃশ্য ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ভিডিও’তে দেখা গেছে, কী পৈশাচিক আনন্দই না পাচ্ছে শিশুহত্যাকারী পাষণ্ডরা!

এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি হয়তো চার পাঁচ জন জড়িত ছিল, কিন্তু এই দৃশ্য দেখেছেন অনেকেই।

কারণ ঘটনাটি প্রকাশ্য দিবালোকেই ঘটেছে এবং ভিডিও দেখে বোঝা গেছে, আশপাশে হয়তো আরো অনেক মানুষই ছিল! কিন্তু ভিডিওর কোথাও কি বোঝা গেছে, এই ঘটনার প্রতিবাদ কেউ করছে? কিংবা কেউ কি এগিয়ে এসেছিল ছেলেটাকে বাঁচাতে? না, তেমনটা দেখা যায়নি; এবং ধরেই নেয়া যায় কেউ এগিয়েও আসেনি, কারণ ছেলেটি শেষ পর্যন্ত মারা গেছে!

সেই একই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার পর এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন সবাই, এর প্রতিবাদে সমাবেশ আয়োজন করা হয়েছে, ঘটনার বিচার চাওয়া হচ্ছে! তাহলে বাস্তবে যখন ঘটনা ঘটলো সেই সময় কেউ কেন প্রতিবাদ করলো না? বাস্তবের মানুষগুলো কি তাহলে ভিনগ্রহের প্রাণি? তাঁরা কি এই সমাজে বসবাস করে না?

এই দেশে "গণপিটুনি" বলে একটা শব্দ প্রচলিত আছে! এর চাইতেও অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, আপনি চাইলেই যে কাউকে "গণপিটুনি" দিয়ে হত্যা করে ফেলতে পারবেন। এর জন্য আপনার কোনো বিচার হবে না; কারণ সেটি "গণপিটুনি!" কারণ এতো মানুষের ভিড়ে কাকে আপনি হত্যাকারী বলে সাব্যস্ত করবেন কিংবা করলেও কয়জনকে করবেন? এই দেশে চলতিপথে গণপিটুনি কিংবা একজন আরেকজনকে চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি মারছে এই ধরনের দৃশ্য দেখেনি এইরকম মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভিড়ের মাঝে এক দুটো চড়-থাপ্পড় বসিয়ে দেয়া যেন খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। ওই এক দুটো চড়-থাপ্পড় যখন হাজার মানুষের এক দুটো চড় থাপ্পড়ে পরিণত হয় তখন যে কোনো একজন মানুষ আর বেঁচে থাকতে পারে না; সেটা এই দেশের অনেক মানুষেরই আর মনে থাকে না! এছাড়া শিক্ষিত, সভ্য বলতে আমরা যেসব মানুষকে বুঝিয়ে থাকি তাদের ভাষার ব্যাবহার থেকেও এই সমাজের একটা বাস্তব চিত্র পাওয়া সম্ভব।

কেউ একজন মানুষের সাথে হয়তো আপনার মতের মিল নেই, কিংবা কোনো কারণে তাঁর সাথে আপনার মেলে না, তো সেই মানুষটি সম্পর্কে কোনো আড্ডায় কথা বলার সময় হয়তো আমরা বলে ফেলি-“শালাকে বাইন্দা পেটানো দরকার!” এই বাক্যটি কিন্তু খুব অপরিচিত বাক্য নয় এই সমাজে। অনেকেই কথার ছলে এই ধরনের অনেক বাক্যই ব্যাবহার করে থাকে! আপনি হয়তো কথার ছলে ব্যবহার করছেন, কিন্তু আপনার চারপাশে যে বাচ্চা ছেলেগুলো বড় হচ্ছে তাঁরা কিন্তু এই বাক্যটিকে তাদের মনে গেঁথে ফেলছে। আর সেই বাচ্চাটি যখন বড় হবে তখন তাঁর মধ্যে এর প্রভাব পড়বে এবং সে হয়তো কেউকে বেঁধে পেটানোর মতো বিষয়টিকে খুব স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখবে! কারণ ছোটবেলা থেকে সে এই ধরনের বাক্য শুনে এসছে! একটা মিথ্যা যেমন অনেকবার বললে সেটি সত্যর মতো শোনায়, ঠিক তেমনি এইসব বাক্যও সব সময় ব্যবহার করলে সেটি মনের উপর প্রভাব ফেলে এবং বাস্তবে এর প্রভাব পড়ে। ভাষার ব্যবহার আসলে যেকোনো সমাজেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। একটা সমাজ কতোটা সভ্য সেটা সেই সমাজের মানুষগুলোর ভাষার ব্যবহার থেকেও বোঝা যায়! এটি তো কেবল একটা উদাহরণ, এই রকম হাজারটা উদাহরণ দেয়া যাবে আমাদের ভাষার ব্যবহারে ক্ষেত্রে। এই ধরনের অনেক বাক্যই আসলে আমরা বাস্তব জীবনে চলতে ফিরতে ব্যবহার করছি, যেটি কোনোভাবেই একটি সভ্য সমাজে কাম্য নয়। তাই এই ধরনের বাক্য ব্যবহার করা থেকে সকলের সতর্ক থাকা উচিত, নইলে এর কিছুটা সামাজিক দায় আসলে আপনার উপর এসেও বর্তায়।

এখন যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে পত্রপত্রিকায় রাজন হত্যার বিচার চাইছেন, তাঁরা কি সবাই বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন বাস্তবে যখন তাদের সামনে এই ধরনের বিচার বহির্ভূত মারামারি, হাতাহাতি(এইগুলো বলার কারণ হচ্ছে এভাবেই আসলে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়), হয়েছে তখন তাঁরা এর প্রতিবাদ করেছেন?কিংবা যে কোনো ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে কোনো প্রকার শারীরিক আঘাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন এবং এই ধরনের বাক্য ব্যবহার করা থেকে বিরত থেকেছেন বা থাকছেন?

নিজেদের সভ্য দাবি করার জন্য হলেও মনে হয় এখন সময় এসেছে সবার প্রতিজ্ঞা করার, এইসব শারীরিক আঘাত করা সম্পর্কিত কোনো ধরনের মন্তব্য করা থেকে বাস্তব জীবনে বিরত থাকবো; কারণ এর একটা সামাজিক প্রভাব রয়েছে এবং এই ধরনের কোনো ঘটনা চোখের সামনে ঘটলে তার প্রতিবাদ করবো। আর সেটা যদি আমরা না করি, তাহলে এই ধরনের ঘটনা বাস্তবে ঘটতেই থাকবে। আর ঘটনা ঘটার পর ভার্চুয়াল জগতে এর প্রতিবাদ হবে কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিকার হয়তো হবে না।

আমিনুল ইসলাম: শিক্ষক ও গবেষক, [email protected]  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৫
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।