অফিস থেকে ফিরে আজ অনেক দিন পর বিকেলে কারওয়ানবাজারে পুরনো কিছু সহকর্মীর সাথে আড্ডা শেষে রাত ৮টার দিকে বাসায় ফিরলাম। এনটিভির ‘গীতিময়’ শীর্ষক গানের অনুষ্ঠান দেখছিলাম অলসভাবে।
স্ক্রলটি দেখেই অজান্তে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে পড়ল ঢাকা সিটি মেয়র ও জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা হানিফ সাহেবের কথা। ঢাকার মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশে বক্তৃতা করার মাঝেই হঠাৎ ঢলে পড়লেন। আমরা যারা সেই নিউজ কাভার করছিলাম, দ্রুত টেলিভিশনের মাইক্রোফোন টেনে হিচড়ে নিয়ে দ্রুত হানিফ সাহেবকে বহন করা অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে পেছনে শাহবাগের বারডেম হাসপাতালে গিয়ে হাজির। ভাবিনি মেয়র হানিফ সাহেব মারা যাবেন। কিন্তু কিছু সময় পরেই শুনলাম তিনি আর নেই।
অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে টাঙ্গাইলের এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার সময় তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমেদও এমনিভাবে বক্তৃতা দিতে দিতে ঢলে পড়েন। কিন্তু আল্লাহর অসীম কৃপায় বেঁচে আছেন তিনি। তাৎক্ষণিকের এলোমেলো ভাবনায় সত্যিই ভাবিনি উপমহাদেশের এমন বড় মাপের একজন মানুষের চলে যাওয়ার খবর আসবে এত দ্রুত। কিন্তু মহান স্রষ্টার নিয়তি, মানতে তো হবেই। চলে গেলেন রাজনীতি, সমাজনীতিরও অনেক উপরের মানবনীতির এক প্রিয় মানুষ এপিজে আবদুল কালাম।
বেশ কয়েক বছর আগে এপিজে আবদুল কালামের উইংস অব ফায়ার শিরোনামে তার আত্মজীবনী পড়েছিলাম। যা পড়ে মনে হয়েছে প্রতিটি বিখ্যাত মানুষ যদি তার আত্মজীবনী লিখে যেতেন তা হলে পৃথিবী আর সব নবপ্রজন্ম পেত অনেক সহজ সহজ সব দিশা।
ভারতের মাদ্রাজের দ্বীপ শহর রামেশ্বরমের মধ্যবিত্ত তামিল পরিবারে জন্ম নেয়া এপিজে আবদুল কালামের বাবার ধনসম্পদ বিশেষ ছিল না, ছিল না প্রথাগত শিক্ষাও। তবে তার মায়ের বংশের লোকজন ছিল বেশ মর্যাদা সম্পন্ন।
বই পড়ার পাগল আবদুল কালামের শৈশবে বেড়ে ওঠা রামেশ্বরম দ্বীপে বই পড়া, বই সংগ্রহ করা ছিল অনেকটাই দুষ্কর। তারপরেও সেই ছোট বেলায় তার বাবার আধ্যাত্মিক তত্ত্ব তাকে এগিয়ে নিয়েছে প্রত্যাশার উঁচু প্রাচীরে, যা-ই এক সময়ে তাকে তুলে ধরে সাফল্যে স্বর্ণ মন্দিরে।
তার বাবা জইনুল আবেদিনের আধ্যাত্মিক তত্ত্বের এক উপলব্ধি লিখতে গিয়ে আবদুল কালাম বলেছেন, প্রত্যেকটি মানুষ তার নিজের কালে নিজের স্থানে যা হয়েছে, যে অবস্থায় পৌছেছে, তাতে সমগ্র ঐশ্বরিক সত্তার এক বিশিষ্ট অংশ। তাই বাধা-বিঘ্ন, দু:খ কষ্ট, সমস্যা এলে ভয় পাবে কেন? দুঃখ কষ্ট এলে তোমার দুঃখ কষ্ট বোঝার প্রয়োজনিয়তা বুঝার চেষ্টা করো। দুঃসময় এলেই সুযোগ আসে আত্মসমীক্ষার।
সত্যিই দারুণ এক উপলব্ধি শিখিয়েছিলেন কালামের বাবা। তাই হয়ত, সকল দুঃখ কষ্টকে জয় করেই বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হওয়ার বিজয় মুকুটে তাকেই মানিয়েছিল।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মাত্র আট বছর বয়সে যুদ্ধের খবর জানার আগ্রহ থেকে তেতুলের বিচি সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে পত্রিকা কিনে পড়তেন এপিজে আবদুল কালাম।
আসলে লক্ষ্য যার গগণভেদি সে কি আর পড়ে রয়। তৎকালীন সমাজের উঁচু-নিচুর দেয়াল ভেদ করে স্কুল শিক্ষকদের বাড়ি যাওয়া আসা আর গুরুস্নেহ অর্জনে মুসলিম ছাত্র কালামের জুড়ি ছিল না। আর সে কারণেই তার বিজ্ঞান শিক্ষক শিবসুব্রক্ষ্রণ্য আয়ার তাকে একদিন বলেছিলেন, কালাম, আমি চাই তুমি এমন ভাবে বেড়ে ওঠ, যাতে বড় বড় শহরের উচ্চ-শিক্ষিত লোকদের সমকক্ষ হতে পার তুমি। শিক্ষক আয়ার মহাশয় কালামের প্রতিভার তেজের বিকিরণ তখনই দেখতে পেয়েছিলেন।
এপিজে আবদুল কালামের গণিত শিক্ষকের একদিনের বেত খাওয়ার স্মৃতি বলতে গিয়ে লিখেছিলেন, ভুলে গণিত শিক্ষক রামকৃষ্ণ আয়ারের এক অংকের ক্লাসে ঢুকে পড়ায় স্কুলের সমস্ত ছেলেদের সামনে বেত দিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিল স্যার। তার পর আর ঐ স্যারের সামনে পারত পক্ষে যেতাম না। কিন্তু এরপরে গনিতে একশ’র মধ্যে একশ’ পেয়ে স্যার যে প্রশংসা করেছেন তাতে সব কষ্ট আমার ভুলে গিয়েছিল। গণিত শিক্ষক রামকৃষ্ণ কালামকে নিয়ে বলেছিলেন, যাকে আমি বেত দিয়ে বেধড়ক পেটাই, সে-ই জীবনে অনেক বড় কিছু হয়। দেখবি এই কালাম একদিন অনেক বড় হবে, স্কুল আর দেশের মান বাড়াবে এরাই। সত্যি আগেকার মাস্টারমশাইরা আসলে ছাত্র-ছাত্রীদের অন্তরকে পড়তে পারতেন। দেখতে প্রতিভার বিচ্ছুরণ কতটা কিভাবে জ্বলে।
এপিজে আবদুল কালামের আত্মজীবনী আর তার কর্মময় জীবনের রয়েছে নানা দিক। তবে তার আত্মউপলব্ধিগুলো সত্যিই আমাদের প্রত্যেকের জন্য জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বড় সঞ্জিবনী নিয়ামক।
তার এক স্কুল শিক্ষক ইয়াদুরাই সলোমন সম্পর্কে এপিজে আবদুল কালাম বইয়ের এক যায়গায় লিখেছিলেন, (শিক্ষক ইয়াদুরাই) তিনি ছেলে মেয়েদের মধ্যে তাদের মূল্য সম্পর্কে একটা ধারণা জন্ম দিতেন। আমার নিজের মূল্যের বোধ আমার নিজের মধ্যে তিনি অনেক উচুঁতে তুলে দিয়েছিলেন। আমি যাদের সন্তান তাঁদের যদিও শিক্ষার সুযোগ হয়নি, তবুও আমিও যা হতে চাই তাই হতে পারবো।
এই বিশ্বাসও তিনি গড়ে দিয়েছিলেন এপিজে আবদুল কালামের মনে।
তাই তো আবদুল কালাম বলেছেন, বিশ্বাস থাকলে তুমিও নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে, গড়তেও পারবে।
আসলে শিক্ষকরা যে কত বড় কারিগর, একেকজন বিখ্যাত মানব তৈরিতে তাদের যে কতটা অবদান তা এপিজে আবদুল কালামের আত্মজীবনীই বলে দেয়।
একজন ভাল শিক্ষকের দিগদর্শনই তৈরি করতে পারে এমন একেকজন এপিজে আবদুল কালাম।
একসময়ে সারা পৃথিবীর হাতে গোনা দুএকটি রাষ্ট্র ক্ষেপনাস্ত্র প্রযুক্তিতে বিশেষ দক্ষতার নিদর্শন করায়ত্ত করে রেখেছিল। সেই যায়গাতে এপিজে আবদুল কালামের হাত ধরে এসেছে বিজয়। উড়েছে ‘পৃথ্বী’ ‘ত্রিশূল’ ‘অগ্নি’। সবই কর্মপ্রচেষ্টা আর প্রত্যাশার প্রাপ্তি।
স্বল্পসময়ে একজন মহানায়ক এক স্বপ্ন দ্রষ্টার ছিঁটেফোটা স্তুতি স্মরণ মাত্র। তবুও এই মানুষটির অন্তঃস্তিত ঐশ্বরিক অগ্নি”র ডানা মেলে আকাশের বুকে উড়ে যাওয়ার আশ্চর্য বৃত্তান্ত আমাদের সকল প্রজন্মের সুখ সাফল্যের হোক নিয়ামক শক্তি।
লেখক : সাংবাদিক, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৫
জেডএম/
** মৃত্যুর আগেই মারার দায় নীরার!
** অন্তিমযাত্রার আগে জীবনের শেষ ছবি
** একজন আবদুল কালাম: পরশ পাথর, শিক্ষক এবং পথপ্রদর্শক
** আবদুল কালামের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বৃহস্পতিবার
** ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে হাইকমিশনে শোকবই
** বাসভবনে আবদুল কালামের মরদেহ
** দিল্লি পৌঁছেছে আবদুল কালামের মরদেহ
** আবদুল কালামের সম্মানে বিহার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন
** আবদুল কালামের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া তামিলনাড়ুতে
** লন্ডনে নৈশভোজ-বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান বাতিল মমতার
** ‘পারলে একদিন অতিরিক্ত কাজ করবে’
** আবদুল কালামের স্মরণে ভারতীয় সংসদে নিরবতা
** আবদুল কালামের শেষ টুইট
** দুপুরে দিল্লি পৌঁছুবে আবদুল কালামের মরদেহ
** আবদুল কালামের সেরা ১০ উক্তি
** দিল্লি নেওয়া হচ্ছে আবদুল কালামের মরদেহ
** আবদুল কালামের যে ইচ্ছা অপূর্ণই রয়ে গেলো
** টুইটারে আবদুল কালামকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ
** এপিজে আবদুল কালাম আর নেই