১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী আদিবাসী রাজাকারদের কথা আমাদের নতুন প্রজন্ম জানেই না। আর এই সুযোগে আদিবাসী রাজাকাররা বহাল তবিয়তেই আছে।
ব্রিটিশরা ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করে নেয় এবং ১৮৮১ সালে সমগ্র জেলাকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিন সার্কেলে তিন রাজা ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়, বোমাং রাজা অং শৈ প্র“ চৌধুরী এবং মানিকছড়ির মং রাজা মং প্রু চাঁই চৌধুরী বা (মং প্রু সাইন )। মানিকছড়ির রাজা ছাড়া অন্য দুই রাজাই ছিলেন যুদ্ধাপরাধী।
চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের সহযোগিতায় রাঙামাটিতে গণহত্যা চলে। এই সময়ে রাঙামাটি মুক্ত করতে যাওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র এবং এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ইফতেখারসহ ৮-১০ জনের একদল মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়।
চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় তার বির্তকিত বই The Departed Melody-তে লেখেন, ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল সকালে তিনি (রাজা ত্রিদিব রায়) তার ভগ্নিপতি কর্নেল হিউম, ম্যাজিট্রেট মোনায়েম চৌধুরী, মোঃ হজরত আলী এবং আরো কয়েকজন বাঙালি মুসলিম লীগ নেতাসহ চট্টগ্রামের নতুন পাড়ায় অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেন্টার-এর পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী এবং রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে আসা আরো কয়েকজন বাঙালি ঢাকা থেকে আসা জুনিয়র অফিসারকে সঙ্গে করে কাপ্তাইয়ে যাবেন। ঠিক সেদিনই বিকেলে কাপ্তাই থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল কয়েকটি লঞ্চ এবং স্পিডবোট নিয়ে রাঙামাটি আসে এবং বিনা প্রতিরোধে দখল করে নেয়।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত (ফেব্রু-২০১১) ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস’ বইয়ে জামালউদ্দিন লেখেন, ‘...অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাক দালাল খ্যাত চিহ্নিত এক উপজাতীয় নেতার (রাজা ত্রিদিব রায়) বিশ্বাসঘাতকতায় ঐ দিনই পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী রাঙামাটিতে এসে চুপিসারে অবস্থান নেয়, যা মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না। ভারত প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছার সাথে সাথে সেখানে ওৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি সৈনিকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ফেলে। এই দলের মধ্যে ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইফতেখার। ’ [পৃষ্ঠা ৩৭৯-৩৮০]
এর আগে রাঙামাটি মহকুমা সদরের এসডিও আবদুল আলী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে দুটি স্পিডবোটে করে মহালছড়ি থেকে রাঙামাটি আসেন। স্পিডবোটে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এস এম কালাম, আবদুল শুকুর, শফিকুল ইসলাম, মামুন, সামসুল হক মাস্টার এবং রাঙামাটি হাইস্কুলের তদানীন্তন হেডমাস্টার রহমান আলীর ছেলে ইফতেখার। এর মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার জন্য আবদুল আলীকে রাঙামাটিতে পুলিশ লাইনের এক ব্যারাকে আটক করে রেখে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্লেড দিয়ে আঁচড় দেয়া হয়েছিল। এরপর সেসব জায়গায় লবণ দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া তাকে একটি জিপের পিছনে বেঁধে টেনে রাঙামাটির বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়েছিল। সূত্র : ‘মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শরবিন্দু শেখর চাকমা, (অঙ্কুর প্রকাশনী, জানু-২০০৬ পৃষ্ঠা ২৫]।
ইফতেখার ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র এবং এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রথমব্যাচের সদস্য ছিলেন তিনি। তার বাবা যেহেতু রাঙামাটি স্কুলের হেডমাস্টার, তাই রাঙামাটি গিয়ে বাড়ির সবাইকে দেখবেন এবং যুদ্ধ করে তাদের মুক্ত করে আনবেন এমন ইচ্ছায় সে টগবগ করছিলেন তিনি। নিজের ছাত্র ইফতেখার সম্পর্কে ‘আমার একাত্তর’ (সাহিত্য প্রকাশন, ফেব্র“ ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ৪৮) বইতে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন এই কথা।
রাজা ত্রিদিব রায় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বের হওয়া হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র’ (সশস্ত্র সংগ্রাম-১) নবম খ-ের (জুন ২০০৯) ৯৩ পৃষ্ঠায় মে. জে. মীর শওকত আলী (বীর উত্তম) লেখেন : ‘চাকমা উপজাতিদের হয়ত আমাদের সাহায্যে পেতাম। কিন্তু রাজা ত্রিদিব রায়ের বিরোধিতার জন্য তারা আমাদের বিপক্ষে চলে যায়। ’ অন্যদিকে ১৯৭১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক বর্তমান উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম তার বই ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’-এর (মার্চ ২০০৪) ২৬০ পৃষ্ঠায় লেখেন : ‘চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় প্রথম থেকেই নির্লিপ্ত এবং গোপনে পাকিস্তানিদের সাথে যোগাগোগ রাখছেন। ’
চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের স্বাধীনতাবিরোধিতার আরো নমুনা আমরা পাই বাংলা একাডেমী থেকে বের হওয়া লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহিরের (বীর প্রতীক) বই ‘মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের বীরউত্তম’-এ (ডিসে. ২০০৮)। বইটির ৬৩ পৃষ্ঠায় তিনি লেখেন : ‘মার্চ মাসের প্রথম থেকেই রাজা ত্রিদিব রায় এবং মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কোনো কারণে মুক্তিকামী বাঙালিদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। ’ আফসান চৌধুরী তার বই ‘বাংলাদেশ ১৯৭১ : প্রথম খ-’-এর ৪১৩ পৃষ্ঠায় (ফেব্র“. ২০০৭, মাওলা ব্রাদার্স) লেখেন : ‘পূর্বপাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহের একটি আসন ছাড়া বাকি ১৬০টি আসনই লাভ করে। ময়মনসিংহ-৮ আসনে পিডিপি নেতা নুরুল আমিন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বতন্ত্র প্রার্থী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। ’
‘ত্রিদিব রায় জাতীয় পরিষদ র্নিবাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী চারু বিকাশ চাকমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, যে আসনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়’ বলছেন মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক তার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতি মূল্যায়ন’ বইয়ের (ফেব্র“. ২০০১, মাওলা ব্রাদার্স) ৭৭ পৃষ্ঠায়।
‘বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ বইয়ে ডা. মাহফুজুর রহমান (মার্চ ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ৪৬৭) লেখেন, ‘রাজা ত্রিদিব রায়, এস টি হোসেন প্রমুখের নেতৃত্বে রাঙামাটি মুসলিম লীগ তার রাজনীতি চালিয়ে যায়। ’ তপন কুমার দে সম্পাদিত ‘আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা’ (ফেব্র“. ২০১০, অন্বেষা প্রকাশন) বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে রাজা ত্রিদিব রায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষ নেন। অন্যদিকে আইয়ুব হোসেন এবং চারু হক-এর বই ‘মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী’র (ফেব্র“ ২০০৮, ঐতিহ্য) ৮২ পৃষ্ঠায়ও রাজা ত্রিদিব রায়ের স্বাধীনতা-বিরোধিতায় প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে।
রাজা ত্রিদিব রায় মনে করতেন পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হবে না, যদি ভারত পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে না পারে। আর ভারত পাকিস্তানকে পরাস্ত করতে পারবে না, কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে চীন এবং আমেরিকা রয়েছে। তারা কোনোদিন পাকিস্তানকে ভারতের কাছে পরাজিত হতে দেবে না। সূত্র : ‘মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম’, শরবিন্দু শেখর চাকমা (জানু. ২০০৬, অঙ্কুর প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৩১)।
এছাড়া চাকমা রাজপরিবার চিরদিনই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির বিরুদ্ধে থেকেছে। বিচারপতি সায়েম দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং রাষ্ট্রপতি হবার পর তিনি রাজা ত্রিদিব রায়ের মা বিনীতা রায়কে তার অন্যতম উপদেষ্টা করেন। সূত্র : ‘মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম’, শরবিন্দু শেখর চাকমা (জানু. ২০০৬, অঙ্কুর প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৩৫)।
রাজা ত্রিদিব রায় মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানে চলে যান এবং বাংলাদেশে স্বাধীন হলে আর দেশে ফিরে আসেননি। তিনি এখনও পাকিস্তানে আছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে নিয়ে মাঝেমধ্যে লেখালেখি করেন। করাচি থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ‘ডন’ (DAWN) পত্রিকার ৮ অক্টোবর ২০০০ সংখ্যায় তিনি ‘চিটাগাং হিল ট্র্যাক্ট : লেট জাস্টিস বি ডান’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। (ইব্রাহিম, পৃষ্ঠা-৭৮)। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে নভেম্বর মাসের ১২ তারিখ তাকে ইসলামাবাদ নিয়ে যাওয়া হয় এবং কয়েক দিন পর তাকে পাক সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে প্রথম শ্রীলংকা, পরে বার্মা (এখন মায়ানমার), থাইল্যান্ড প্রভৃতি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য পাঠানো হয়। (শরবিন্দু শেখর চাকমা, পৃষ্ঠা ৪১)।
উইকিপিডিয়ার সূত্র মতে, বাংলাদেশের অধিবাসী কিন্তু পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে গোলাম আযমের পরই আছেন রাজা ত্রিদিব রায়। তিনি বর্তমানে ফেডারেল মন্ত্রী হিসেবে ইসলামাবাদে বাস করছেন এবং সেখানকার বুড্ডিস্ট সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি আর্জেটিনা ও শ্রীলংকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও কাজ করেছেন।
অন্য যুদ্ধাপরাধী বোমাং সার্কেলের রাজা অং শৈ প্র“ চৌধুরীও ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও মন্ত্রী এই রাজা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেন এবং হানাদার বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৬৫ সালে মুসলিম লীগের টিকিটে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিসভায়ও যোগ দিয়েছিলেন। তার পরিবারের লোকজনও পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। তবে বোমাং রাজা অং শৈ প্র“ চৌধুরী স্বাধীনতার পর জেলে বন্দি হন। (ইব্রাহিম পৃ. ৭৮)। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র’, সপ্তম খ-ের (জুন ২০০৯) ৫৪০ পৃষ্ঠায় আছে, ‘পাকিস্তান সরকারের তৎকালীন মন্ত্রিসভায় একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত হন বোমাং রাজা অং শৈ প্র“ চৌধুরী । প্রদেশের মনোনীত সংখ্যালঘু মন্ত্রী অং শৈ প্র“ অন্য সবার সাথে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। কারণ তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার জন্য নির্দিষ্ট বিমানে আরোহণ করতে পারেননি। ’ ‘তাকে বন, সমবায় ও মৎস্য দফতরের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি সংখ্যালঘু বিষয়ও দেখাশোনা করেছেন। ’
চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় এবং বোমাং রাজা অং শৈ প্র“ র নাম বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে তৈরি যুদ্ধপরাধীর তালিকায় রয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রর বই ‘যুদ্ধাপরাধ’-এর (ফেব্রু ২০০৮) ৮১ পৃষ্ঠায় এই দুই রাজার নাম জ্বলজ্বল করছে তাদের সেই সময়ের সহযোগী গোলাম আযম, আলী আহসান মুজাহিদ বা ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামের পাশে। অন্যদিকে ডা. এম এ হাসানের বই ‘যুদ্ধাপরাধীর তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গ’তেও (ফেব্র“. ২০০৯, তাম্রলিপি, পৃষ্ঠা ১৫২) আছে দুই রাজাকার রাজার নাম। তাদের রাজাকার নম্বর ৯৪৮ এবং ৯৫২ :
948. Mr. Raja Tridiv Roy, Father Late Raja Nalinakhya Roy, Village Rajbari Rangamati, Thana Kotwali, Chittagong.
952. Mr. Aung Shwe Prue Chowdhury, Father Thwi Aung Prue, Village Bandarban, Bandarban, Bandarban.
শুধু রাজা নয়, চাকমা যুবকেরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেন এবং সিভিল আর্মড ফোর্স (বা সিএএফ) অথবা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। চাকমা যুবকদের রাজাকার বাহিনীতে প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রসঙ্গে মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক তার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতি মূল্যায়ন’ বইয়ের ৭৭ পৃষ্ঠায় লেখেন : ‘উপজাতীয় যুবকদের কিছুসংখ্যক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও অধিকাংশই পকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত সিভিল আর্মড ফোর্স বা সিএএফ (রাজাকার বাহিনী হিসেবে পরিচিত)-এ যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় অংশ নেয়। তৎকালীন রাজাকার বাহিনীতে চাকমাদের সংখ্যাই বেশি ছিল। অনেকেই বেতন এবং অস্ত্রের লোভে সিএএফে যোগ দেয়। রাজা ত্রিদিব রায় তার সার্কেলে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গিয়ে জনগণকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য প্রচারণা চালাতে থাকেন। চাকমা যুককেরা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, পানছড়ি প্রভৃতি এলাকায় স্থাপিত পাকিস্তানি ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। উপজাতিদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন রাজশাহী বিভাগ থেকে পালিয়ে আসা ইপিআরের হাবিলদার মি. নলিনী রঞ্জন চাকমা এবং হাবিলদার মি. অমৃতলাল চাকমা। এরা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দোভাষীর কাজও করতেন। উপজাতি যুবকেরা টেনিং ক্যাম্প ৩০৩ রাইফেল, কারবাইন, স্টেনগান, এল এম জি চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতেন। ’ আফসান চৌধুরী লিখেছেন (বাংলাদেশ ১৯৭১ : প্রথম খণ্ড, ফব্রে“. ২০০৭, মাওলা ব্রাদার্স, পৃষ্ঠা ৪৩২) : ‘আদিবাসী অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে মিজো এবং চাকমা আদিবাসী পাকসৈন্যদের সাহায্য করে’।
তবে আদিবাসী চাকমা রাজাকারদের নিয়ে সবচেয়ে মজার দুটি উদাহরণ পাওয়া যায়। তপন কুমার দে সম্পাদিত বই ‘আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা’ (ফেব্র“-২০১০, পৃষ্ঠা ৫৩) এবং তার দু বছর আগে প্রকাশিত আইয়ুব হোসেন ও চারু হকরে বই ‘মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী’তে (ফেব্র“. ২০০৮ পৃষ্ঠা ৮৩) লেখক-সম্পাদক তনিজন একটি শব্দও পরিবর্তন না করে লেখেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়ে পরবর্তীকালে এদের (চাকমাদের ) মধ্যে কেউ কেউ হতাশাগ্রস্ত হয়ে ও পাকসেনার ইন্ধনে সিভিল আর্মড ফোর্স অথবা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। ’
কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশ স্বাধীন করতে আসা কোনো মুক্তিসেনা কি হতাশ হয়ে শক্রপক্ষের থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ দলের উপর সশস্ত্র হামলা চালাতে পারে বা প্রশিক্ষণও কি নিতে পারে? যদি পারেও তাহলে তাদের সবারই কি স্বাধীন বাংলাদেশ বিচার হওয়া বাধ্যতামূলক নয়?
এই যুদ্ধাপরাধীদের বংশধররা বংশপরম্পরায় বাংলাদেশের বিরোধিতা করে আসছে। বর্তমান আমরা তাদেরই আবার দেশের প্রতিনিধি বানিয়েছি বিশ্বদরবারে, জাতিসংঘে। যুদ্ধাপরাধী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় এবং বিচারপতি সায়েমের উপদেষ্টা ত্রিদিব রায়ের মা বিনীতা রায়ের বংশধর এবং উত্তরাধিকারী দেবাশীষ রায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজামী ও মুজাহিদের মতো তার গাড়িতেও বাংলাদেশের পতাকা উড়েছে। তিনি সম্প্রতি মেক্সিকোর কানকুনে শেষ হয়ে যাওয়া জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের পক্ষে কাজ করেছেন। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংগঠন ইউএনএফসিসিসি (UNFCCC) এবং ইউ এন পার্মানেন্ট ফোরাম অন ইনডিজিনাস ইস্যুর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। (সূত্র : প্রথম আলো, ০২ জানুয়ারি ২০১১)
রাজাকার ফজলুল কাদের চৌধুরীর পুত্র হিসেবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী যদি ওআইসির (ঙওঈ) মহাসচিব পদের জন্য নির্বাচন করে দেশের ভাবর্মূতি নষ্ট করতে পারে তাহলে কেন ত্রিদিব রায়ের মতো প্রমাণিত রাজাকারের পুত্র বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে? এখন তো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত সরকার। তাদের অপরাধের কেন বিচার হবে না?
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র সরাসরি অংশগ্রহণকারী মানিকছড়ির মং সার্কেলের রাজা মং প্রু চাঁই চৌধুরী বা (মং প্রু সাইন) মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে তিনি প্রায় সর্বস্বান্ত হন। স্বাধীন দেশে এ রাজার কোনো উপাধি মিলেনি। তিনি বা তার উত্তরাধিকারীরা দেশের উপদেষ্টা বা বিশ্বের দরবারে দেশের প্রতিনিধি হতে পারেননি। জাতিসংঘে কোনো বিষয়ে প্রতিনিধি হতে পারেনি। অথবা জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হতে পারেনি স্বাধীনতাযুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধে অংশগ্রহণকারী কোনো আদিবাসী যোদ্ধা।
হায় সেলুকাস! সত্যিই বিচিত্র এ দেশ।
লেখক : শিক্ষার্থী, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]