এপিজে আবদুল কালাম ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও পরমাণুবিজ্ঞানী। তিনি ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরত্ন’ ছাড়াও ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) ১১০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে তিনি বাংলাদেশে আসেন ২০১৪ সালের অক্টোবরে। ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় এপিজে আবদুল কালাম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সময় কাটান। সারগর্ভ বক্তৃতা আর কথা বলা বেশি পছন্দ ছিল তাঁর। শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা দিতে দিতেই গত ২৭ জুলাই পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে।
তিনি নিরন্তর তরুণদের মাঝে উদ্ভাবনের স্বপ্ন ও কর্মপ্রেরণার বীজ বুনে গিয়েছেন। শিশুসুলভ সরলতা তাঁকে সর্বজনপ্রিয় করে তুলেছে। তিনি বলেছেন, অন্য রকমভাবে চিন্তা করো। নতুন কিছু সৃষ্টি করার সাহস রাখো। সাফল্যের পথে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করো, একসঙ্গে কাজ করার জন্য এগুলোই বড় গুণ।
তাঁর মতে, ‘স্বপ্ন না দেখলে তো তা সত্যি হবে না। স্বপ্ন দেখতে হবে। কারণ স্বপ্নটা চিন্তায় পরিণত হয়। আর চিন্তা মানুষকে কর্মে অনুপ্রাণিত করে। তিনি বলেন, স্বপ্ন সেটা নয় যেটা তুমি ঘুমিয়ে দেখো। স্বপ্ন সেটা যেটা তোমায় ঘুমাতে দেয় না। সূর্যের মতো দীপ্তিমান হতে হলে প্রথমে তোমাকে সূর্যের মতোই পুড়তে হবে যদি তুমি তোমার কাজকে স্যালুট করো, দেখো তোমায় আর কাউকে স্যালুট করতে হবে না। কিন্তু তুমি যদি তোমার কাজকে অসম্মান করো, অমর্যাদা করো, ফাঁকি দাও, তাহলে তোমার সবাইকে স্যালুট করতে হবে। যারা হৃদয় দিয়ে কাজ করতে পারে না, তাদের অর্জন অন্তঃসারশূন্য, উত্সাহহীন সাফল্য চারদিকে তিক্ততার উদ্ভব ঘটায়। প্রতিদিন সকালে এই পাঁচটা লাইন বলো,
১. আমি সেরা
২. আমি করতে পারি
৩. সৃষ্টিকর্তা সবসময় আমার সঙ্গে আছেন
৪. আমি জয়ী
৫. আজ দিনটা আমার
ভিন্নভাবে চিন্তা করার ও উদ্ভাবনের সাহস থাকতে হবে এবং সমস্যাকে জয় করে সফল হতে হবে। আকাশের দিকে তাকাও আমরা একা নই। পুরো মহাবিশ্ব আমাদের প্রতি বন্ধুত্বসুলভ। যারা স্বপ্ন দেখে এবং কাজ করে শুধুমাত্র তাদেরকেই শ্রেষ্ঠটা দেওয়ার জন্য চক্রান্তে লিপ্ত এ বিশ্ব। উত্কর্ষতা একটা চলমান প্রক্রিয়া এবং এটি কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। যদি একটি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত এবং সুন্দর মনের মানুষের জাতি হতে হয়, তাহলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এক্ষেত্রে তিনজন সামাজিক সদস্য পার্থক্য এনে দিতে পারেন। তারা হলেন বাবা মা এবং শিক্ষক।
এপিজে আবদুল কালাম বিমান প্রকৌশলে পড়াশোনা করে ভারতের প্রথম মহাকাশযান তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন। ওই মহাকাশযান দিয়েই ১৯৮০ সালে ভারতের পোখরান-২ পারমানবিক অস্ত্রের পরীক্ষার পেছনেও প্রধান ভূমিকায় ছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালে মূল পরীক্ষা চালানোর পর দীর্ঘ ২৪ বছরে ভারতের এটাই ছিল প্রথম সফল পারমানবিক পরীক্ষা। তিনি পরিচিতি পান ভারতের মিসাইলম্যান হিসেবে।
পৃথিবীর নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০৩০ সালে পৃথিবীর চেহারা কেমন হবে, তিনি তার একটি রূপকল্প তৈরি করেছিলেন। সেটি এমন একটি পৃথিবী হবে যেখানে ১. গ্রাম ও শহর, ধনী ও গরীব, উন্নত ও উন্নয়নশীলের পার্থক্য কমে আসবে। ২. জ্বালানি ও সুপেয় পানির সুষম বন্টন নিশ্চিত হবে এবং সে অনুসারে যৌথ মিশনে কাজ করার মাধ্যমে সবার অর্থনৈতিক সুবিধা ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। ৪. শিক্ষার্থীরা এমন শিক্ষা গ্রহণ করবে, যা তাদের মূল্যবোধকে জাগিয়ে তুলবে। ৫. সবার জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে। ৬. স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। ৭. নারী ও শিশুদের ওপর সব ধরনের অন্যায়ের অবসান ঘটবে এবং সমাজে অবহেলিত বলে কেউ থাকবে না। ৮. প্রত্যেক নাগরিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাস করতে পারবেন। ৯. সব দেশ সন্ত্রাসবাদের ভয়ভীতি থেকে মুক্ত হয়ে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। ১০. সৃজনশীল নেতৃত্ব দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব অনতিবিলম্বে দূর করে বিশ্বকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
পৃথিবীর প্রায় ৩০০ কোটির বেশি মানুষ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে, যাদের ক্ষমতায়নের বিষয়টি একটি চ্যালেঞ্জ, যার চারটি দিক রয়েছে। প্রথমত, নতুন পণ্য ও সেবার সুবিধাভোগের ব্যবস্থা করা। অনুমান করা হয় যে, উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর জনগণের মধ্যে ভোগের পরিমাণ এমনভাবে বাড়ছে যে ২০০৯ সালে জন্মগ্রহণকারী কোনো শিশু ১৯৭৯ সালে জন্মগ্রহণকারী কোনো ব্যক্তির তুলনায় ৩৫গুণ বেশি পণ্য ও সেবা ভোগ করছে। এর ফলে স্থানীয় চাহিদার সঙ্গে মানানসই নতুন নতুন জিনিসপত্রের প্রয়োজন হবে। ৩০০ কোটি মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য তাই স্থানীয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম উদ্ভাবন প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, জ্বালানি ও শক্তির সয়বরাহ নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। এখন উন্নত সমাজে জীবনযাপনের যে ধারা প্রচলিত রয়েছে, তা গোটা পৃথিবীর পরিবেশের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যদি পৃথিবীর সুবিধাবঞ্চিত মানুষ উন্নত সমাজের মানুষের মতো বসবাস করে, তাহলে যে পরিমাণ সম্পদ প্রয়োজন হবে, তার জোগান দিতে এবং উত্পাদিত বর্জ্য নিষ্কাশন করতে আরও ছয়টি পৃথিবীর দরকার পড়বে। তাই ক্ষমতায়নের সঙ্গে সঙ্গে শক্তির চাহিদা যে আকাশচুম্বী হয়ে উঠবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। চতুর্থত, বিশ্বব্যাপী সংঘাত ও সংঘর্ষের ইতি টানা।
ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতাসহ নানা কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পৃথিবীতে নানা দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বেড়েই চলেছে। সবার জন্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে সমান সুযোগ সৃষ্টি করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে সংঘাতের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। তরুণদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী জাগিয়ে তুলতে হবে এবং তাদের আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তবেই পৃথিবীর মানুষের জীবনে টেকসই উন্নয়নের সুফল বয়ে আনা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২২ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১৫