বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও বেপরোয়া চালক বিপদজনক গতিতেই চালাতে থাকেন বাস। যাত্রীদের অনুরোধ-নিষেধ কানেই তুলছিলেন না তিনি।
কোনো বাসচালক যে এত বেপরোয়া হতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাই কঠিন হতো।
ঢাকা-সিলেট রুটে চলাচলকারী এনা পরিবহনের ওই বাসটির সুপারভাইজার হারুন অর রশিদ যাত্রীদের আশ্বস্ত করে জানান, মালিকের নির্দেশ রয়েছে দেরি হোক ক্ষতি নেই, যাত্রীদের নিরাপত্তাই তাদের কাছে প্রাধান্য পায়।
প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় খবরে আতঙ্কিত থাকতে হয়। তাই বাসযাত্রা শুরু করে সুপারভাইজারের কথায় প্রাণে কিছুটা স্বস্তিও পেলাম। সুপারভাইজারের কথা আশ্বস্ত হয়ে এক যাত্রী তাকে ডেকে বলেন, আমার পক্ষ থেকে তোমার মালিককে ধন্যবাদ।
তবে সব যাত্রীই তো আর একরকম নয়। আমাদের বাসের দ্বিতীয় সারিতে থাকা এক যাত্রীর সুপারভাইজারের সাথে কথাকাটাকাটি শুরু হয়। জানা গেলো বাসচালক মানিককে ওই যাত্রী জোরে চালাতে বলছেন। একথা জেনেই বাসের বেশিরভাগ লোক ড্রাইভার এবং সুপারভাইজারের পক্ষ নিয়ে সেই যাত্রীর সঙ্গে বিবাদে জড়ান। কেউ কেউ তাকে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার কথাও বলেন। পরে ওই যাত্রী দুঃখ প্রকাশ করে রেহাই পান।
ঝামেলা শেষ মনে হয়েছিল অনেকের কাছে। এবার নিশ্চিন্তে হয়ত ঢাকায় পৌঁছানো যাবে। কিন্তু কে জানতো ভয়ানক এক বেপরোয়া চালকের খপ্পরে পড়েছেন যাত্রীরা।
যাত্রা বিরতির পরে গাড়ি ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় তার বেপরোয়া খেলা। হবিগঞ্জ, আশুগঞ্জ হাইওয়েতে পরপর চারটি গাড়িকে মারাত্মকভাবে অভারটেক করেন তিনি। এরপর সাপের মতো হেলে দুলে চলতে থাকে বাসটি বেপরোয়া গতিতে।
বাসের সব যাত্রীর প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত প্রায়। আতঙ্কিত যাত্রীরা চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘এই ড্রাইভার থামাও, এই ড্রাইভার থামা বলছি’।
বাসে থাকা এক শিশু যাত্রী বলে ওঠে, ‘আমার পেটের মধ্যে কেমন উল্টাপাল্টা লাগছে’। শিশুটি ভয়ে বলতে থাকে, জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে চলে যাবে সে।
যাত্রীদের অনেকেই হয়তো ওই বাচ্চাটির মতোই জানালা দিয়ে লাফ দেওয়ার কথা ভাবছেন। আমার মনে হচ্ছিল জীবনের শেষদিন আজ। কোনো যাত্রী ভয়ে উঠে যাচ্ছে না ড্রাইভারের দিকে। চোখ খুলতেও ভয় লাগছে, শক্ত হাতে গাড়ির সিট ধরে আছি।
ভাগ্যিস, এ সময় সম্মুখ থেকে কোনো গাড়ি আসছিল না। এক পর্যায়ে সাহসী এক যাত্রী ড্রাইভারের কাছে এগিয়ে যান। কড়া ধমক দিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বাধ্য করেন তিনি।
এ গাড়িতে আর যাবো না বলে উঠে পড়ি। একথা আমার একার না প্রায় সব যাত্রীরও। নেমে দেখি ক্ষিপ্ত সেই যাত্রীর হাতে লাঠি। তাকে থামানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ, কেউ আবার ড্রাইভারকে ঘিরে ধরেছেন মারবেন বলে। হঠাৎ দেখি ক্ষিপ্ত ওই যাত্রী আশুগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশ ভ্যান থামিয়ে ফেলেছেন।
পুলিশ সমস্ত শুনে আশুগঞ্জের সোনাপুরের রাজমনি হোটেলের সামনে গাড়িসহ ড্রাইভারকে আটকে রাখে এবং ড্রাইভার চেঞ্জের ব্যবস্থা করে দেয়ার কথা বলে।
আশুগঞ্জ থানার সহকারী উপপরিদর্শক মোশারফ যাত্রীদের বলেন, আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, এনা কর্তৃপক্ষকে ঘটনা জানানো হয়েছে।
এরপর যাত্রীদের পারস্পরিক আলাপ কানে আসে। সবাই ভয় ও আতঙ্কের কথা শেয়ার করছিলেন। কারও কারও ধারণা, ‘ড্রাইভার নিশ্চয়ই মাতাল ছিল’।
বাসের আরেক যাত্রী হবিগঞ্জের লেখিকা সৈয়দ শওকত আরা জানান, ১০ বছর আগেও তিনি এমন অবস্থায় পড়েছিলেন। এক পর্যায়ে গাড়ি খাদে পড়ছে দেখে ড্রাইভার জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে যান। আর বাস গিয়ে পড়ে খাদের মধ্যে। এই ড্রাইভারও একই কাজ করতো বলেই ধারণা শওকত আরার।
গাড়ি থামলো কিভাবে সেটা জানার জন্য ছটফট করছিলাম আমি। শেষে জানলাম সেই কথাও। মহিউদ্দিন নামে ত্রিশোর্ধ্ব এক যুবক চালকের কাছে যেয়ে তাকে গাড়ি থামাতে নির্দেশ দেন। কিন্তু একরোখা চালক গাড়ি থামায় না। শেষে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ওই যুবক চালকের বুক বরাবর পা তুলে দিয়ে বলেন, মরলে তুইও মরবি। এখনই থামা। এরপর থেমে যায় গাড়ি।
ঘটনার প্রায় ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পুলিশের সহায়তায় বাসচালক বদলে ঢাকায় পৌঁছে যাই প্রাণ নিয়ে।
এরপর এনা পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানা গেছে ড্রাইভার মানিককে বরখাস্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৫
এমজেএফ