শিক্ষা আমাদের অধিকার। ‘বাল্যশিক্ষা’য় পড়েছি শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড।
কিন্তু উচ্চশিক্ষার চৌকাঠ মাড়ানো এখন আর আগের মতো সহজ নয়। ক্রমবর্ধমান কোর্স ফি, বিভিন্ন খাতে অর্থ আদায়, নতুন নতুন তহবিল সৃষ্টি করে ছাত্রদের কাছ থেকে বাড়তি পয়সা কামাই যেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত ঘটনা। এসব কিছুর পর আবার মরার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে জারি হয়েছে ‘ভ্যাট’।
নাগরিকদের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা বা পড়াশোনা ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকার রাষ্ট্রের পক্ষে এ দায়িত্বটি পালন করে মাত্র। রাষ্ট্র একটি সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান। সরকার যায় আসে, কিন্তু রাষ্ট্র জনগণকে শিক্ষিত করার মধ্য দিয়ে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। তাই রাষ্ট্র শিক্ষিত নাগরিক চায় না অশিক্ষিত নাগরিক চায়-এটি রাষ্ট্রের নীতিগত সিদ্ধান্ত বা অবস্থান। কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়।
সন্দেহ নেই, শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা উদার ও কল্যাণমূলক রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ করেছি। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধানেও শিক্ষার গুরুত্ব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিধৃত আছে।
সম্প্রতি ভ্যাট নিয়ে যে বিতর্ক তার সমাধান খুঁজতে হলে আমাদের সংবিধান, বিভিন্ন সময়ে প্রণীত শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন ও সর্বোপরি বিদ্যমান আইন ও বিধি-বিধানের পর্যালোচনা জরুরি। শুধু ‘ভ্যাট আইন’র আলোকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ‘ভ্যাট’ বসিয়ে সংকটের সমাধান করা যাবে না।
সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের মতো রাষ্ট্রের পক্ষে এ দায়িত্ব পালন করা কঠিন। আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিলো উচ্চ শিক্ষার সুতিকাগার। কিন্তু চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের সীমিত সংখ্যক আসন ও অবকাঠামো দিয়ে দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রদান দু:সাধ্য।
লক্ষ্যণীয় যে, উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা সরকারেরই দায়িত্ব। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই এ দায়িত্ব পালন করে আসছিল। কিন্তু তারা চাহিদা পুরণ করতে না পারায় ’৮০ এর দশকের মধ্যভাগ থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষা প্রসারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সহযোগী ভূমিকা দেশে উচ্চশিক্ষায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অথচ তাদের ওপরই ভ্যাট আরোপ করা কতোটা যৌক্তিক তা পুন:বিবেচনার দাবি রাখে।
যদি ভ্যাট আরোপ করতেই হয়, তবে কেন শুধু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর? ভ্যাট আরোপের মানদণ্ডতো ‘পাবলিক’ ‘প্রাইভেট’ হতে পারে না। সরকার যদি চায় ‘পাবলিক’ ‘প্রাইভেট’ নির্বিশেষে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরই ভ্যাট আরোপ করতে পারে। এমনকি যেসব বেসরকারি কলেজ উচ্চশিক্ষা দিচ্ছে তাদের ওপরও ভ্যাট আরোপ করুক। পণ্য বা সেবা কে প্রদান করছে সেটি বড় কথা নয়। পণ্য বা সেবাটি ভ্যাটযোগ্য কিনা সেটিই বিবেচ্য হওয়ার কথা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে উচ্চশিক্ষা পণ্য কিনা। যদি পণ্য হয়েও থাকে তবে তার ওপর ভাট আরোপ করা যৌক্তিক কিনা।
উচ্চ শিক্ষার ওপর ভ্যাট আরোপ করা হবে কিনা সেটি নিছক একটি ঘোষণার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। কারণ, প্রথমেই বলা হয়েছে-এর সাথে রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানের সম্পর্ক আছে। এ সিদ্ধান্ত নিতে হলে সংশ্লিষ্ট সবার মতামত প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতামত জরুরি। সেই সাথে শিক্ষাবিদ ও নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করে একটি সর্বজনবিদিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংসদেও এ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। শুধু বাজেট অধিবেশনের একটি ঘোষণার মাধ্যমে শিক্ষা খাতে ভ্যাট আরোপ করার মতো গুরুত্বহীন বিষয় এটি নয়।
একথা সত্যি যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উচ্চ বেতনে পড়ছে। এ অযুহাতে তাদের ওপর বাড়তি ভ্যাটের বোঝা চাপানোর কি কারণ থাকতে পারে? বরং বেতনের হার নিয়ন্ত্রণের জন্য মঞ্জুরি কমিশনের কাজ করা প্রয়োজন।
একসময় ধারণা করা হতো, কেবল বিত্তবানদের সন্তানরাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কিন্তু সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির চাপ দেখলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার বোঝা যায়। আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলেই প্রাইভেটের পথে পা বাড়াতো। এখন অনেকের কাছে প্রাইভেটই থাকে প্রথম টার্গেট। কিছু কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার ফলে অনেকে প্রাইভেটের দিকে ঝুঁকছে। বর্তমানে উচ্চবিত্তদের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্তদের ছেলেমেয়েরাও প্রাইভেটে ভর্তি হচ্ছে।
ভ্যাট আরোপের আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন ও সরকারি নজরদারি প্রতিষ্ঠা করার আরো অনেক ক্ষেত্র আছে। একেক বিশ্ববিদ্যালয় একই কোর্সের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কোর্স ফি আদায় করছে। কেউ আদায় করছে দুই লাখ, আবার কেউ চার লাখ। শিক্ষার মান, অবকাঠামো ও অন্যান্য সেবার কোনো রকমফের নেই। আছে শুধু বাড়তি টিউশন ফি আদায়ের দৌড়। অশুভ এ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে মঞ্জুরি কমিশনের কোনো কার্যক্রম আমরা লক্ষ্য করি না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক মান বিবেচনা করে শ্রেণীকরণ করে সে অনুযায়ী টিউশন ফি’ নির্ধারণ বা টিউশন ফি’র একটা সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। কিন্তু এরকম কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। শুধু কিল মারার গোঁসাই হয়ে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়, উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যমাত্রা নয়।
ভ্যাট আরোপ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে লাভজনক প্রতিষ্ঠান এটা মেনে নেয়া হয়। যদি ধরেও নিই যে এগুলো লাভজনক প্রতিষ্ঠান, সেক্ষেত্রে কেবল যারা লাভ করছে তাদের ওপরই ভ্যাট আরোপ করার কথা উঠতে পারে। গড়পড়তায় সবার ওপর ভ্যাটের বোঝা চাপানো অযৌক্তিক বলেই মনে হয়।
আর লাভ লোকসানের ভিত্তিতে ভ্যাট আরোপ করতে চাইলে সরকারের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাবও থাকতে হবে। শুধু হিসাব গ্রহণ করা নয়, তা পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। আইনের ৪৪ ধারার বিধান আরো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা জরুরি।
ভ্যাট কে দেবে? শিক্ষার্থী না বিশ্ববিদ্যালয় তা নিয়েও দুই ধরনের কথা শোনা গেছে। অর্থমন্ত্রী একবার বলেছেন ভ্যাট দেবে বিশ্ববিদ্যালয়, আরেকবার বলেছেন শিক্ষার্থীরা। তবে ভ্যাট যাদের ওপরই আরোপ করা হোক না কেন, দিনশেষে তা ছাত্রদের ঘাড়েই বর্তাবে।
সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য ১৯৯২ সালে প্রথম আইন করে। ২০০৮ সালে ঐ আইন বাতিল করে নতুন অধ্যাদেশ জারি করে। এ অধ্যাদেশের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ‘উচ্চশিক্ষার মান উন্নীতকরণসহ উচ্চশিক্ষার দ্রুত ও ক্রমবর্ধমান বহুমুখী চাহিদা পূরণে বিদ্যমান আইন (১৯৯২ সালের আইন) অপর্যাপ্ত’। তাই শিক্ষার মান ‘উন্নীতকরণসহ উচ্চশিক্ষার দ্রুত ও বহুমুখি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে’ নতুন অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
অধ্যাদেশের ৩(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীনে স্থাপিত প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মুনাফার জন্য নহে (Not for Profit) এইরূপ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হইবে’। এ বিধানটি নিছক একটি আইনি বিধান নয়। এটি উচ্চশিক্ষা বিষয়ে রাষ্ট্রের অবস্থানকেও নির্দেশ করে। রাষ্ট্র উচ্চশিক্ষাকে পণ্য মনে করে না তা এ ধারায় পরিষ্কার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকার লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করবে না তাও স্পষ্ট। আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, সেক্ষেত্রে বরং সরকারের খবরদারি করার কথা। তা না করে উল্টো ভ্যাট আরোপ করা এ বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।
বিদ্যমান ভ্যাট আইনটির প্রাসঙ্গিক ধারাও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। কারণ, ভ্যাট আইনানুযায়ী সরকার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর ভ্যাট আরোপ করতে পারে। ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনের তফশিল-২ এর ২(গ) অনুযায়ী কেবল সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাটের আওতামুক্ত। এরকম বৈষম্যমূলক ভ্যাট নীতি সংবিধান ও আইনের সাথেও সাংঘর্ষিক।
আরো লক্ষ্যণীয়, একই তফশিলের ২(খ)তে বেসরকারি স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা খাতকে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। আর বেসরকারি শিক্ষা খাতকে রাখা হয়েছে ভ্যাটের আওতাভুক্ত। অথচ আমাদের সংবিধান শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে একইভাবে গুরুত্ব প্রদান করেছে (রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি)।
এমনকি ২০০৮ সালের আইনেও (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ) এর ওপর ভ্যাট আরোপের কোনো বিধান নেই। তাই নতুন করে ভ্যাট নিয়ে বিভ্রাট সৃষ্টি না করাই শ্রেয়।
মন্ত্রিসভা ইতোমধ্যেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে যা নি:সন্দেহে শুভ উদ্যোগ।
ভ্যাট বা এজাতীয় ফি আদায়ের আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা বেশি জরুরি। শিক্ষার মান, অবকাঠামো, গবেষণা, পাঠ্যক্রম ইত্যাদির মানোন্নয়নের দিকে মঞ্জুরি কমিশন তথা সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে। সেই সাথে উচ্চশিক্ষার নামে উচ্চ ফি’ আদায় করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরে এগিয়ে যাক আমাদের উচ্চশিক্ষা এটাই প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ সময়: ২১২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৫
জেডএম/