ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

বিবদমান সাংবিধানিক সংকট নিরসনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভাবনা

ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২০ ঘণ্টা, জুন ২, ২০১১
বিবদমান সাংবিধানিক সংকট নিরসনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভাবনা

সংসদ সার্বভৌম। House of the Nation. জনগণের ক্ষমতার প্রতিনিধি-সকল ক্ষমতার উৎস।

জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ শুধুমাত্র বাংলাদেশের সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হয়। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বাংলাদেশের সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বাধীন একটি অ-নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান।

জাতীয় সংসদ সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বাধীন একটি সকল ক্ষমতার মালিক জনগণের নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান। জনগণের এই প্রতিষ্ঠানই পারে একটি সংবিধান রচনা করতে, সংশোধন করতে ও বাতিল করতে জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে। জনগণের এই ক্ষমতা সুপ্রীম কোর্টকে দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে শুধু সেই আইন বাতিল করার ক্ষমতা যে আইন দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের পরিপন্থি। দেশের সর্বোচ্চ আইনকে সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সুপ্রীম কোর্টকে, পরিবর্তনের নয়। সুপ্রীম কোর্টের রায়, বৈধ বা অবৈধ, সংসদের ক্ষমতা খর্ব করার এখতিয়ার রাখে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বর্তমান বিধান আমূল পরিবর্তনের দাবি রাখে। যে ব্যবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দলীয় রাষ্ট্রপতির নিয়োগের সুযোগ রয়েছে, সে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আর যাইই হোক না কেন, কোন অবস্থাতেই নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় হতে পারে না এবং তদ্রুপ একজন প্রধান উপদেষ্টার অধীন কোনভাবেই সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচন আশা করা যায় না। রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের উপর বিশ্বাস রেখে যে বিধানের জন্ম সে বিধান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের বেলায়ও যে একই ভাবে প্রয়োগ হতে পারে এ বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ থাকার অবকাশ নাই। এটা অনস্বীকার্য্য যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোন রাজনৈতিক সরকারের অধীন সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয় এবং নির্বাচনকে সুষ্ঠ করতে আপাততঃ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন বিকল্প নাই তবে যে কারনে এই ব্যবস্থা অপরিহার্য্য সে কারনেই এর আমুল পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। কর্মোক্ষমলুপ্ত অবসর প্রাপ্ত ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন দূর্বল চিত্তের কোন প্রধান বিচারপতি বা বিচারপতি যারা অবসরে যান কর্মক্ষমতা লোপ পাওয়ার কারনে তাদের পক্ষে বলিষ্ঠ ও সাহসী ভূমিকা যেমন আশা করা যায় না, অবসরপ্রাপ্ত বিধায় তাদের কৃতকর্মের জবাবদিহিতার প্রশ্নটি ও নিরুত্তর রয়ে যায়। এ ধরনের এক দূর্বল ব্যবস্থা নিয়ে পুনরায় কোন পরীক্ষার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে এ ব্যবস্থাকে নাকচ করতে আদালতের আশ্রয় নিতে হবে কেন ? স্বাধীন সার্বভৌম সংসদ কি পারে না এ বিষয়ে কার্য্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে? সংবিধানের ১১১ ধারা মতে আপীল ডিভিশনের রায় হাই কোর্ট মানতে বাধ্য - সংসদ নয়। কিভাবে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী বললেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল সংক্রান্ত সুপ্রীম কোর্টের রায়ের বাইরে যাওয়ার তার কোন উপায় নেই এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল করতেই হবে’? সংসদের ক্ষমতা সম্পর্কে সংসদ নেত্রীর এই ধারনা কেন? এই সংসদ যে সুপ্রীমকোর্টের রায় বাতিল করে আইন করতে পারে সেটা কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অজানা ? বাতিলকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার স্থলে শত শত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্ম দিতে পারে সংসদের এই ক্ষমতা যে সুপ্রীমকোর্ট স্পর্শ করতে পারে না, সংসদ নেত্রী তো সেটা ভালভাবেই জানেন। তাহলে কিসের এই বাধ্যবাধকতা ?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নতুন ভাবে চিন্তা ভাবনার সময় এসেছে। সময় এসেছে একটা শক্তিশালী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা উদ্ভাবনের। সমস্ত জনগনকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধান এখন মৃত প্রায়। ক্ষত-বিক্ষত এই সংবিধানের উপর এত কাটাছেড়া হচ্ছে যে এর অস্তিত্ব নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে, বিতর্ক হচ্ছে। বিরোধী দল বলছে, দেশ চলছে সংবিধান ছাড়া আর সরকারী দল বলছে সংবিধান বহাল তবিয়তে রয়েছে। সংবিধান যে বেহাল অবস্থায় রয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। সংবিধানের মৌলিক বিষয়ে চলছে বিতর্ক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ভাষার চেতনা, ধর্মের চেতনা, সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দলীয়করন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ছাত্র রাজনীতি, জঙ্গীবাদ, হরতাল, সন্ত্রাস, আন্দোলন, সংবিধান লংঘন, আদালত অবমাননা, নির্বাচন কমিশন, দূর্নীতি দমন কমিশন, সরকারী কর্ম কমিশন - সব কিছু নিয়েই এখন জনগনকে ভাবতে হবে সংবিধানকে যুগোপযোগী করে তুলতে।

দেশের সর্বোচ্চ আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ রেখে, কিভাবে সে আইন এখতিয়ার বহির্ভূত একটি অবৈধ রায়ের শিকার হতে পারে, সংবিধানের কোন্ বিধানের অধীন আপীল বিভাগ এই এখতিয়ার গ্রহন করলেন এ সব প্রশ্নের কোন সদুত্তর না পাওয়া পর্যন্ত সংবিধানের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। অবৈধ রায়ে বাতিলকৃত অংশ বাদ দিয়ে সংবিধান পূনঃমুদ্রন কিংবা বিরোধী দলের সক্রিয় অংশগ্রহন ব্যাতিরেকে শুধু কিছু চিহ্নিত মহাজোট ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কিংবা বুদ্ধিজীবির পরামর্শ মতে সংবিধানের উপর সংসদীয় কমিটির Co-chairperson এর অব্যাহত অস্ত্রোপচার সংবিধানকে শুধু পঙ্গুত্বের দিকেই ঠেলে দিতে পারে, সুস্থ্য করে তুলতে পারে না। দেশের সমস্ত ক্ষমতার মালিক জনগন আর দেশের সংবিধান হচ্ছে সেই জনগনের একটি অঙ্গীকার, একটি ঘোষনা। জনগনের সম্পৃক্ততা ব্যাতিরেকে এই সংবিধানকে স্পর্শ করার এখতিয়ার জনগন কোন অনির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের হাতে অর্পন করেনি। শুধু জনগন কর্তৃক নির্বাচিত সংসদের কাছেই রয়েছে সংবিধান সংশোধনের অধিকার। তাই জনগনকেই আস্থায় নিতে হবে সংবিধানে কোন মৌলিক পরিবর্তন আনতে। সুপ্রীম কোর্টের রায় নয়, জনগনের রায়ই হবে চূড়ান্ত। বিগত নির্বাচনে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের বিষয়ে জনগনের কোন mandate গ্রহন করা হয় নি - কোন দলের নির্বাচনী manifestoতে এ বিষয়টি প্রতিফলিত হয় নি যার উপর নির্ভর কোরে সরকারের সংবিধানের উপর বর্তমান কার্য্যকলাপের বৈধতা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। জনগনকে সম্পূর্নভাবে পাশ কাটিয়ে জনগনের মূল্যবান সম্পদ তথা সংবিধানকে স্পর্শ করার এখতিয়ার জনগন অন্য কাউকে দেয়নি। এ অবস্থায় সংবিধান নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হলে এ বিষয়ে জনগনের সুচিন্তিত মতামতের প্রতিফলনে গঠিত একটি Constituent Assembly কিংবা গনপরিষদের কোন বিকল্প নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য সংবিধান সংশোধনীর প্রস্তাব প্রতিফলিত নির্বাচনী ম্যানিফেষ্টোর ভিত্তিতে জনগন তাদের mandate প্রদান করবেন এবং একটি নির্বাচিত গনপরিষদের জন্ম দেবে। এই পরিষদই হবে সংবিধান সংক্রান্ত সমস্ত আলোচনার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু যেখানে নবনির্বাচিত গনপ্রতিনিধিরা বর্তমান সংবিধানের প্রতিটি বিধানের চুলচেরা বিশ্লেষনের মাধ্যমে সংবিধানকে যুগোপযোগী কোরে তুলবে। গনপরিষদের এই নির্বাচন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে এবং বিতর্ক এড়াতে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মনোনয়ন দিবে বর্তমান সংসদের পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষ কমিটি। স্পীকারের নেতৃত্বে এই বিশেষ কমিটির অন্য চারজন সদস্য হবেন সংসদ নেত্রী, সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী, সরকারী দলের চীফহুইপ এবং বিরোধী দলের চীফহুইপ। এই বিশেষ কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মনোনীত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেদিন ক্ষমতা গ্রহন করবেন বিশেষ কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক, সেদিন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি বর্তমান সংসদ ভেঙ্গে দেবেন। বিশেষ কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মনোনীত এবং সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহনের ০৭ দিনের মধ্যে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন যে কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে গনপরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন করবে। নব নির্বাচিত এই গনপরিষদের মেয়াদ হবে ০৬ মাসের জন্য। এই পরিষদ স্বাধীনতা পরবর্তী এই ৪০ বছরের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে সমস্ত অব্যবস্থার অবসান ঘটাবে সর্বোচ্চ আইনের বিধানের মাধ্যমে।

বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সুপ্রীম কোর্টের তথাকথিত রায়ের আদলে এখনই কেন কখনোই বাতিল করতে সংসদ বাধ্য নয়।

গণপরিষদে জনপ্রতিনিধিদের ব্যাপক আলোচনার ভিত্তিতে এই ব্যবস্থায় ব্যাপক রদবদল এনে যেদিন পর্য্যন্ত না আমরা সত্যিকার অর্থে নির্বাচন কমিশনকে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন করে তুলতে পারি, যেদিন পর্য্যন্ত না নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব নিয়োগ ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষন ব্যবস্থার অধীন সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচন পরিচালনায় দক্ষ ও যোগ্য এবং সম্পূর্নভাবে প্রভাবমুক্ত ঈধফৎব গড়ে তুলতে পারি, সেদিন পর্য্যন্ত নবনির্বাচিত গনপরিষদ কর্তৃক প্রনীত সংবিধানের অংশ হিসাবে এক শক্তিশালী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে দেশের সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পিত হতে হবে।

প্রয়োজন সদিচ্ছার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার অভাব রয়েছে জাতি এটি মানতে রাজী নয়। একই ভাবে বিরোধী দলের নেত্রীর সদিচ্ছায় ঘাটতি রয়েছে একথাও জাতি মানতে রাজী নয়। শীর্ষ অবস্থানে একের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধাবোধ, পারস্পরিক মতামতে সহিঞ্চুতা, দলাদলি, পাল্টাপাল্টি, মুখোমুখি, প্রতিহিংসা ও সংঘাতের অবস্থান থেকে সরে আসা এবং সর্বোপরি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পারস্পরিক সহযোগীতার ক্ষেত্র বিস্তৃত করে দেশের সার্বিক কল্যানে নিজদের নিবেদিত করে বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে একটি সমৃদ্ধ আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদা সম্পন্ন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কোরে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের মধ্যে নবজন্মের উন্মেষ ঘটানোই হোক শীর্ষ নেতৃত্বের সদিচ্ছা।

বাংলাদেশ সময় ২২০৭ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।