গোপালচরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন সৌরভ। এখন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গুলি ছোঁড়া হয়েছে শিশুটির চাচাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু চাচা দৌঁড়ে পালিয়ে রক্ষা পেলেও মাননীয় সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ছোঁড়া কয়েকটি গুলির জের বইছে শিশু শাহাদাত। আরও কষ্টের কথা হলো, বাচ্চাটির অ্যাম্বুলেন্স যেন হাসপাতালে না যেতে পারে, সে চেষ্টাও করা হয়েছিল। এমপির সহযোগী ক্যাডাররা রাস্তা আটকে দিলে পুলিশ গিয়ে আহত রক্তাক্ত শাহাদাতকে হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। নিশাচর এই সংসদ সদস্য ২০০৪ সাল থেকে সুন্দরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রথমবারের মতো দলীয় মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন।
ঘটনা জটিল কিছু নয়, কোনো রহস্যও নেই। সকালে নিয়মমতো চাচা শাজাহানের সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েছিল শিশু শাহাদাত। বামনডাঙ্গা থেকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহরে যাচ্ছিলেন এমপি মঞ্জুরুল। ব্র্যাক মোড়ে গিয়ে তিনি শাজাহানকে পাজেরোর গ্লাস নামিয়ে ডাকেন, শাজাহান ভয় পেয়ে দৌঁড় দিলে এমপি ক্ষিপ্ত হয়ে গুলি ছোঁড়েন। খুব রাগ হয় তার, সে ডাকলে কেন আসবে না ‘সামান্য’ শাজাহান। দেই ভাতিজাকে গুলি করে।
কিছু প্রশ্ন মাথায় খেলছে। এই সংসদ সদস্যকে লোকজন ভয় পায় কেন? অভিযোগ আছে, তিনি নাকি বেশিরভাগ সময় নেশাগ্রস্ত থাকেন।
সুন্দরগঞ্জ পৌরসভা মেয়র ও সাবেক উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুনের মতে ‘এই এমপি দিনের বেলা ঘুমান আর রাতে নিজে পাজেরো চালিয়ে ঘুরে বেড়ান। ’ অনেক মহান মুসলিম শাসকেদের কথা আমরা শুনেছি। তারাও রাতভর ঘুরতেন, প্রজাদের খোঁজখবর নিতেন। দুঃখ-দুর্দশার চিত্র চাক্ষুষ করে দিনের বেলা প্রজাসেবা করতেন। কিন্তু তিনি কী এমন করছেন যে দলের নেতা-কর্মীরাই বিব্রত হচ্ছেন, দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজেদুল ইসলামের বয়ান তো মাথা গুলিয়ে দেওয়ার মতো। এই এমপি নাকি বিনা কারণেও এমন করেন। সাধারণ লোকজনকে, সরকারি কর্মকর্তাদেরও গালিগালাজ করেন। বলেন, ‘তুই জামায়াত করিস, তোকে মেরে ফেলবো। ”
সুস্থ মাথায় এসব ভাবতে পারছি না। নিজেকেও মাতাল অনুভব হচ্ছে। এসব অভিযোগ থাকলে তো এলাকার কাজকর্ম- টাকা পয়সা ভাগাভাগিতে তার থাকার কথা নয়। কিন্তু আছেন, তিনি সবই নিয়ন্ত্রণ করেন। উপজেলার টিআর, কাবিখা ও কাবিটার কাজ থেকে শুরু করে সব কাজের নিয়ন্ত্রণে তার স্ত্রী খুরশিদ জাহানের ব্যাপক ভূমিকা আছে। কোনো কাজের জন্য মহান এমপির কাছে পৌঁছবার পথও স্ত্রী খুরশিদ জাহান। তাহলে কি তিনি মাতাল বলেই তার স্ত্রী সব দ্বায়িত্ব পালন করছেন? কিন্তু সে যাই হোক, নিজে নারী অধিকারকর্মী হিসেবে বিষয়টা শুনে আমার কিন্তু খুব খারাপ লাগেনি এই ভেবে যে, এমন একজন মহিয়সী নারী আছেন যিনি একটি এলাকা পরোক্ষভাবে শাসন করেন। এবার নিশ্চয়ই দল জনাবা খুরশিদ জাহানকে নমিনেশন দেবেন!
এখন আমার প্রশ্ন হলো, যারা এই এমপিকে মাতাল চিহ্নিত করছেন, তারা এই মঞ্জুরুলকে এলাকায় দীর্ঘদিন আওয়ামী রাজনীতিতে বহাল রাখলেন, কেন রাখলেন? যদি তিনি এমপি নমিনেশন পেলেন, কেন পেলেন? দলের খোঁজখবর, সাক্ষাৎকার, রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম ও নিয়ম-প্রক্রিয়া কিছুই কি এখানে বিবেচিত হয়নি? না হলে কেন হয়নি? এগুলো সবই প্রশ্ন। উত্তর যে কাউকে দিতেই হবে, এমন নয়।
কয়েকমাস আগে ঢাকায় এক আওয়ামী মহিলা লীগের নেত্রীর ছেলেও গাড়ি থেকে অযথা গুলি করে মানুষ মেরে ফেলেছেন। তিনিও নাকি মাতাল ছিলেন। ঘটনার সারাংশ কি আজও বুঝে উঠতে পারিনি। এরা যদি মাতালই হবেন, এদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন কারা? লাইসেন্স দিতেও কি লোক বিবেচনা করা হয় না? মাতালের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার নিয়ম কী? এগুলোও একটু জানা দরকার।
বাংলাদেশে বহুদিন পর মুক্তিযুদ্ধের সোনালী সময়ের স্বপ্ন বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এ সরকারের সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে, হচ্ছে। দেশে দৃশ্যমান উন্নয়ন হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে দেশ দারুণভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। শাসকদের মাথায় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) নিয়ে ভাবনা-চিন্তা চলছে। সবই ঠিক আছে। কিন্তু শাসনপ্রণালীতে এসব অস্থির অসামঞ্জস্যপূর্ণ লোকের সংস্থান হলে সব যে জলাঞ্জলি যাবে, একথা তো নীতি-নির্ধারকদের অনেকেরই বোঝার কথা। হয়তো দেখেও না দেখার ভান চলছে, বুঝেও না বোঝার অভিনয় হচ্ছে। জনগণ কিন্তু কোনো অন্যায় সহ্য করে না, করবে না, করছে না। চুপ করে থাকা মানে সহ্য করা নয়। ফুঁসে উঠলে থামানো দায় হবে। পুরো শাসন ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হবে গুটিকয়েক অসুস্থ নেতৃত্বের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও ভারসাম্যহীন ক্রিয়াকর্মে।
আমরা জানি বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কোনো অন্যায় সহ্য করছেন না। এরকম অন্যায়-অসঙ্গতি তিনি সইবেন, আশা করি না। আগাছা দমনে তিনি বদ্ধপরিকর। আগাছা দমন করতে শক্ত নিড়ানি ব্যবহার করলে আমরা একটু স্বস্তি পাই, মুক্তির স্বাদ নিতে সক্ষম হই। স্বাধীনতার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কষ্টের মূল্য জাতি হিসেবে আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। তার নেতৃত্বের বলিষ্ঠতা আমাদের কাছে অনুকরণীয় আদর্শ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সচেতন প্রয়াসও আমরা লক্ষ্য করি। তিনি অচিরে আরও যারা নেতাকর্মী আছেন তাদের সতর্ক করবেন। প্রয়োজনে কঠিন ছাঁকুনি দেবেন। এ ধরনের সংসদ সদস্য বা দলের ভেতর এরকম ব্যক্তি ঘাপটি মেরে থাকলে সুশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি। বিরোধীরা সুযোগ নেয়, অপপ্রচার চলে। অনেক ভালোভালো অর্জন ম্লান হয়।
আমরা একটি গৌরবোজ্জ্বল দেশের স্বপ্ন দেখি। সুশাসন ও উন্নয়নের স্বপ্ন দেখি। গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখি। অবিলম্বে এই অভিযুক্ত এমপিকে গ্রেফতার ও সংসদ সদস্যপদ বাতিল করার আহবান জানাই। দলীয় কর্মী হিসেবে তার নাম বাতিল করা হোক। প্রকৃত বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে তার উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। আমরা মুক্তির সৌন্দর্যে দেশকে সুস্থ-স্বাভাবিক ধারায় জঙ্গিমুক্ত, অস্ত্রমুক্ত জীবনে প্রবাহিত করতে চাই। সরকার অবশ্য আমাদের সে পথেই নিয়ে যাচ্ছে, বিশ্বাস করতে চাই।
কিন্তু বাধার রাস্তায় কাঁটা থাকলে আর কী করা! শাহাদাতের মায়ের কান্নার তো একটা জবাব থাকা চাই। তার মা সেলিনা বেগমের আকুতি, ‘হামার ছোলটের এতো অক্ত (রক্ত) ঝরালো। এমপি হোক আর যাই হোক, আমি ছোলটেরে গুলি করার বিচার চাই। ‘ অথচ গাইবান্ধার পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম বলছেন, ‘শিশুটি গুলিবিদ্ধ হয়েছে এটা ঠিক। তবে কে গুলি করেছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তদন্ত চলছে’। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, একটি দৈনিকের প্রতিবেদন মতে, এখনও থানায় কোনো মামলা বা অভিযোগই হয়নি। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, এতক্ষণে নিশ্চয়ই হয়েছে। না হলে অনেক কথা বলার আছে কিন্তু। কারণ যা বলিনি, সেখানেই কিন্তু সব কথা, সব ব্যথা জমা আছে। নিশ্চয়ই রাষ্ট্র প্রজাদের বুকে আর ব্যথা বাড়াবে না!
লেখক
রাজীব মীর
সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল- [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৩, ২০১৫
এইচএ/