শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজসেবায় রাউজানের গৌরবময় ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন মাস্টার রুহুল আমীন চৌধুরী। টানা ৩৪ বছর শিক্ষকতার পাশাপাশি ৩০ বছর পালন করেছেন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব।
রাউজানের হলদিয়া ইউনিয়নের ইয়াসিন নগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম রুহুল আমীন চৌধুরীর। তার বাবা ছিলেন মৌলভী আব্দুর রহমান।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। আইন শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের উদ্দেশে পুনরায় কলকাতা যান। কিন্তু
ভারতজুড়ে বন্দে মাতরম আন্দোলনের কারণে সে ইচ্ছা অপূর্ণ রেখে ফিরে আসেন দেশে তিনি।
১৯২৯ সালে মাত্র ৭০ টাকা মাসিক বেতনে রাউজানের প্রখ্যাত আরআরএসি ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতা শুরু করেন রুহুল আমীন চৌধুরী। ভূগোলে তার পাণ্ডিত্য ছিল কিংবদন্তীতুল্য। পাঠদানরত অবস্থায় পেছনের দেওয়ালে রক্ষিত মানচিত্রে লাঠি দিয়ে যেকোনো দেশের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারতেন তিনি।
তার কঠোর অনুশাসন ও পাঠদানের কারণে তিনি সবার কাছে আদর্শের প্রতীক হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিত্ব তার ছাত্র ছিলেন।
টানা ৩৪ বছর শিক্ষকতাকালে নিয়মিত ৬ মাইল পায়ে হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করেছেন রুহুল আমীন চৌধুরী। বেশভূষাও ছিল সাধারণ। সাধারণ পায়জামা-পাঞ্জাবি। স্কুলে পাঠদান শেষে ফিরে যেতেন তার কৃষি খামারে।
এর পাশাপাশি ৩০ বছর ধরে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে এলাকার উন্নয়নে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন এই শিক্ষানুরাগী।
রুহুল আমীন চৌধুরীর কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ধন্যবাদপত্র পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন চট্টগ্রামে কর্মরত ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।
জটিল মামলা পরিচালনায় জুরিবোর্ডের সদস্য পদ অলংকৃত করার গৌরবও অর্জন করেন তিনি। তৎকালীন পাহাড়ি এলাকা রাউজানে জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি গড়ে তোলায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি এলাকাকে শান্তির জনপদে পরিণত করেনে। কথিত রয়েছে তার সময়ে মানুষ দরজা খোলা রেখে নির্ভয়ে ঘুমাতেন।
ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে তিনি মেধা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। এজন্য বৃটিশ সরকার তার স্বীকৃতি দেয়। ১৯২৭ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তার হাতে সম্মাননা হিসেবে স্বর্ণের আংটি, ঘড়ি ও সনদপত্র তুলে দেন বিভাগীয় কমিশনার।
মহান এ শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চেষ্টায় ইয়াসীন্নগর জুবিলী প্রাথমিক বিদ্যালয়, জানিপাথার প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ মক্তব, পুকুর, খামার, পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা, রাস্তা, পাবলিক টয়লেট, ঈদগাহ ও খেলার মাঠ হয়।
তার বাড়িতে ১৯৭০ সালে স্থাপিত গভীর নলকূপ দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর এলাকার সর্বস্তরের জনগণের সুপেয় পানির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
রুহুল আমীন চৌধুরী নীরবে ও নেপথ্যে দরিদ্র ও অসহায় পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা করতেন। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী রাউজানের সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ চালালে অনেকে পালিয়ে যায়। তিনি নিজ বাড়ির একটি অংশে কয়েকটি হিন্দু পরিবারকে যুদ্ধকালীন সময়ে গোপনে আশ্রয় দেন।
সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত রুহুল আমীন চৌধুরী অত্যন্ত মিতব্যয়ী ছিলেন। অতিসাধারণ খাবারে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। এমনকি বৃদ্ধ বয়সেও তিনি চশমা ছাড়া ইংরেজি পত্রিকা পাঠ করতেন।
রুহুল আমীন চৌধুরীর স্ত্রী খায়রুন্নেছা বেগম ভারতের দেওবন্দ থেকে পাশ করা ফটিকছড়ির আব্দুল্লাহ পুর গ্রামের আলেম মৌলানা আব্দুস সোবহানের মেয়ে। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক, পরোপকারী ও পর্দানশীন ছিলেন।
রুহুল আমীন চৌধুরীর ৩ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ডা. মোমিনুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় নেপথ্য ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭৮ সনের ১৫ অক্টোবর রুহুল আমীন চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। এ কৃতি সন্তানের অবদানে শুধু রাউজান নয়, চট্টগ্রামও গর্বিত।
রাউজানের সংসদ সদস্য জনাব ফজলে করিম চৌধুরীর কাছে ‘মাস্টার রুহুল আমীন চৌধুরী’ নামে অন্তত একটি বিদ্যালয় ও সড়কের নামকরণের দাবি তার পরিবারের। এতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার সুযোগ তৈরি হবে।
লেখক, সাবেক ম্যাজিস্ট্রেট, চট্টগ্রাম বন্দর
বাংলাদেশ সময়: ০৪০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৫
এসআর