ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ফাঁস হোক যে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে !

রাজীব মীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৫
ফাঁস হোক যে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে ! ছবি: প্রতীকী

পরীক্ষা বিষয়টা এই সেদিনও বেশ আতঙ্কের ছিলো। এসএসসি, এইচএসসি’তে সৃজনশীল নকল পদ্ধতি আর ম্যাজিস্ট্রেটের আগমনী সংবাদ ছিলো রীতিমতো বিনোদন আর টেনশনের একটি বিষয়।

পরীক্ষার হলের বাইরে অভিভাবকরা নকল নিয়ে অপেক্ষা করছেন আর কখন ম্যাজিস্ট্রেট আসবেন, সেই প্রহর গুণছেন।

জিপগাড়ি দেখলেই হুড়মুড় করে মফস্বলের নকল সরবরাহকারীরা পালাচ্ছেন,কঠিন উৎকণ্ঠা আর সঙ্গে মুখ লুকানোর আনন্দ। একবার হলের মধ্যে এক পরীক্ষার্থী ৫নং প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছেন না,৬ নম্বরের নকল শেষ হতেই জানালায় উঁকি দিয়ে নকল সরবরাহকারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সাপ্লাই পেয়ে খুলেই লিখতে বসে পরীক্ষার্থী। ৫নং প্রশ্ন উত্তর-‘ তোমার বুকপকেটের নিচেই আছে। ’ ভাবার সময় নেই, ভেবে নিয়েছে এটাই উত্তর, লিখে ফেলেছে। যাহোক সেদিন আর নেই।

তখন অনেকেই ফেল করতো আর এখন অনেকেই জিপিএ ফাইভ পায়। দিন পাল্টেছে। এখন সে অর্থে নকল সরবরাহও নেই, নেই পরীক্ষা হলের আন্তরিক আনন্দ আর উড়ন্ত উদ্দীপনা। সৃজনশীল পরীক্ষার্থীদের ভিড়ে অভিভাবকরা নিশ্চিন্ত হয়ে উঠেছেন, তাঁদের সন্তান কিছু একটা জিপিএ পাবেই, ভয় নেই। কিন্তু আশঙ্কামুক্ত এই পরীক্ষা পদ্ধতিতে নতুন এক অসুখ দানা বেধেছে, তার নাম প্রশ্ন ফাঁস।

এক শিক্ষার্থীর বাসায় বেড়াতে গেলাম, রাত নয়টা। বাসায় মা আছেন। বাবা, ভাই বাইরে। যখন উঠবো, বললো ‘একটু বসেন। ভাইটা এলে তবে যান, প্লিজ। ’ ভাবলাম খাবার আনতে গেছে, দেরি হচ্ছে। জানতে চাইলাম, সে কোথায় গেছে? বললো যে, কাল তার শেষ পরীক্ষা, প্রশ্ন আনতে গেছে। আমি বললাম কাল পরীক্ষা আর আজ গেছে সাজেশন আনতে, এটা কিছু হলো। বললো, সাজেশন নয়,পরীক্ষার অরিজিনাল বোর্ড প্রশ্ন। ভাই ফিরলে আগ্রহী চিত্তে প্রশ্ন করলাম, কমন পড়ার নিশ্চয়তা কি! ‘আগের সবগুলোই পড়েছে,’সে নির্ভয়ে উত্তর করলো। যাহ, এটা হয় নাকি! বললো যে,‘হয় স্যার। ’ জিগ্যেস করলাম, কত টাকা নেয় ! হেসে দিয়ে বললো,‘স্যার আজকেরটা আমার বান্ধবী আমাকে গিফট করেছে। ’

প্রায়ই শুনি প্রশ্ন ফাঁস হয়, টাকায় আগে চাকরি হতো শুনতাম, এখন প্রশ্ন বিক্রি হয়। সম্প্রতি মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার একাধিক প্রমাণ থাকার পরও যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, যারা ভর্তি হতে পারেননি আন্দোলনে নেমেছেন, অনশন করছেন। যারা ফাঁস করেছেন কয়েকজন বন্দি হয়েছেন, একজন পুলিশ হেফাজতে মারাও গেছে । কিছুতেই কিছু হয়নি,হয় না। তাহলে প্রশ্ন ফাঁস কি হতেই থাকবে-এর থেকে পরিত্রাণ কী?

বিষয়টিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক শামীম রেজা বললেন,‘এর একমাত্র সমাধান হলো ওপেন বুক এক্সাম। সবার কাছে বই থাকবে, দেখে দেখে যে যা বুঝে লিখবে। ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চার পাঁচটা কোর্স বা বিষয় থেকে প্রশ্ন করা হবে, নির্ধারিত বিষয়ে বই নিয়ে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসবে, না পড়া থাকলে খুঁজে বের করতেই সময় শেষ হয়ে যাবে। ’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদারের মতে,‘কোচিং ব্যবসাও বন্ধ করতে হবে। মন্ত্রী-এমপিরা কোচিং উদ্বোধন করবেন, আর কোচিং সেন্টারকে অন্যরা গালাগাল করবেন, এটা সমাধান হতে পারে না। ’

পরীক্ষা প্রশ্ন ফাঁস আর পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আরও ভাবনার অবকাশ আছে বৈকি! ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করলাম,বলোতো কালো টাকা কী? সে অনেকক্ষণ কি যেন ভাবলো, তারপর বললো,  ‘আমি তো গত ক্লাসে আসি নাই,স্যার !

এই যে অনুভূতিহীন ভাবলেশহীন পরীক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা, এখান থেকে জরুরি পরিত্রাণ দরকার। প্রাথমিক থেকেই বেশি পাসের দিকে কম নজর দিয়ে সংখ্যায় কম বেশি যাই হোক শক্ত ভিতের শিক্ষার্থী নির্মাণে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা জরুরি। আর তা না হলে প্রতি বছর যে হারে জিপিএ-৫ এর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে শহীদ মিনারেও কিন্তু প্রতিনিয়ত প্রতিবাদীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে।

সংখ্যা বৃদ্ধি হয় হোক, মান না বাড়লে অপমান হয়, সম্মান থাকে না। প্রশ্ন ফাঁসের খবরও তাই লুকিয়ে রাখার দরকার নাই,ফাঁস হয়ে যাক এ খবর যে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। নীতি পরিশুদ্ধ হোক, সত্য হোক প্রতিভাত। আবার পরীক্ষা নেওয়া হোক। ভুল পদ্ধতির চিকিৎসা হলে রোগীর জীবন যেমন বিপন্ন হয়, হতে পারে তেমন ভুল পদ্ধতির মাধ্যমে যারা চান্স পায়, পেয়ে থাকে ঘটনা কিন্তু একই।

শিক্ষাদান পদ্ধতিতেও তাই আমূল সংস্কার জরুরি। পরীক্ষা পদ্ধতিতে তো বটেই। গাইড বই আর শিট নির্ভর ডিগ্রিধারী জনবল দিয়ে জাতি কি করবে! উন্নয়নে দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই। জ্ঞান অভিজ্ঞতা আর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে সুপরিকল্পিত জাতি তৈরি হওয়া সম্ভব। সবারই যে উচ্চ শিক্ষা নিতে হবে এমনও নয়। এইচএসসি’র পর টেকনিক্যাল দিকে জনগোষ্ঠী ভিড়তে পারে, কৃষি,পশু ইত্যকার বিষয়ে মনোযোগী হয়ে উঠতে পারে। ইংল্যান্ডের রয়্যাল ফ্যামিলির কেউ অক্সফোর্ড,ক্যাম্ব্রিজে পড়াশোনা করে না। প্রিন্স চার্লস আর ডায়নার ক্ষেত্রেও ঘটনা সত্য। তাঁদের অনেকেই স্কটল্যান্ড থেকে মুরগি পালনের ওপরও ডিগ্রি নিয়ে থাকে।

আমাদের দেশেও প্রয়োজনে কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় পড়বে এমনও হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে হলো না, সিরিয়াল অনুযায়ী কলেজে সেগুলো পড়বে। সেই সব বিষয় কলেজে প্রয়োজনে খুলতে হবে। এভাবে সারাদেশে শিক্ষা উপযোগী বিষয়সমূহ পড়তে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তুলতে হবে।

আমাদের দেশে আগে বুয়েট থেকে শিক্ষার্থীরা গ্রাজুয়েশন শেষ না হতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পেয়ে যেত, কারণ তাদের ওখানে এদের সহজেই ব্যবহার করা যায়। ওদের প্রয়োজনানুযায়ী এমন সব বিষয় আমাদের এখানে বুয়েটে পড়ানো হতো। দেশের সাধারণ মানুষের টাকায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তাম, আমেরিকায় গিয়ে ওদের জন্য খাটুনি দিতাম। দেশের উপযোগীতা বিবেচনা করে বিষয় নির্বাচন ও পাঠদান প্রক্রিয়া ছিলো সুদূর পরাহত। তাই বিষয় নির্বাচনেও দেশের কৃষি,পশু সহ সব বিষয়ে প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে অগ্রসর হলে আমাদের তৈরি জনশক্তি আমাদের এখানেই কাজে লাগতে পারে । আমাদের আর পরমুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হয় না, হবে না।

শিক্ষকরাও নিজেদের বেতন বৃদ্ধি আর সম্মান বাঁচানোর সংগ্রামের পাশাপাশি গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গভীরভাবে ভাববেন, আশা করি। যদি ভাবনাটা ঠিক মতো হতো, উদ্বেগ কিন্তু অনেক বেড়ে যেত। কারণ বেতন কমিশন বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানোর যে ভয়াবহ সুপারিশ করেছেন,অভাবনীয়। কখন কীভাবে কে বাড়াবে এই আয় ! সব তো সেই গরীব শিক্ষার্থীর কাঁধেই বর্তাবে।

চলবে বিচ্ছিন্ন আন্দোলন,নামবে কাঁদানো গ্যাস, বইবে কান্নার বৃষ্টি। লক্ষ্য করলেই দেখা যায় বাংলাদেশে চলছে মূলত তিন ধরণের শিক্ষা - ধর্মীয় শিক্ষা,সামরিক শিক্ষা আর সাধারণ শিক্ষা। প্রথম দুটোয় যে পরিমাণ ব্যয় হয়, সাধারণ নিতান্তই সাধারণ হয়ে পড়ে। কে খবর রাখে ? সেই কিয়দংশের মধ্যে আমরা কে কত পাবো লড়ি,সামরিক বাজেট সম্মূখ সমরে আরও এগিয়ে যায়। আমাদের পড়াশোনার ধরণ কারিগরি না অবগারী সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। পাঠের সমীকরণ সহজ না করে বেসরকারিতে ব্যবসা আর কম্পিউটার খুলতে থাকলে কে কোথায় কি করবে, কিভাবে থাকবে- কে জানে ?

শুনেছি সব সাহেবদের সন্তানেরা বিদেশেই পড়েন,দেশে এসে তারা আর কার জন্য লড়েন? নিজের জন্যই। তাঁর সন্তানও বিদেশে যাবে,কী খাবে --এগুলো নিয়েই পরবর্তী সিলেবাস রচিত হয়। ইংরেজি মাধ্যম বা বেসরকারিতে তৈরি হয় তাঁদের পরবাস, অবকাশ -শান্তির নিবাস ! আর আমরা দিনের পর দিন স্লোগানের পর স্লোগান দিতেই থাকি, দিতেই থাকি- ‘যদি হবে প্রশ্ন ফাঁস পড়বো কেন বারো মাস !’

লেখক:
সহযোগী অধ্যাপক
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৫
পিসি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।