ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য টুনাটুনির পাঠশালা‌

সুমাইয়া জাফরিন চৌধুরী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৫
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য টুনাটুনির পাঠশালা‌

আলোকে ভালোবাসার দায়বদ্ধতা থেকে আলো ছড়ায় এমন প্রদীপ জ্বালানোর চিন্তা মাথায় ঘুরছিল এক দল তরুণের। সময় তখন ২০১০ এর মাঝামাঝি।

ক’জন উদ্যমী দেশপ্রেমী তরুণ তাদের লালিত চিন্তা ভাগাভাগি করল। আশ্চর্য এবং আশার কথা-সেদিন সবাই একবাক্যে হ্যাঁ বলেছিল।

তারপর শুধু এগিয়ে যাওয়ার গল্প। যার যার অবস্থান থেকে সবাই আলোর কথা-ভালোর কথা বলেছিল। দেখাচ্ছিল আশার পথ-ভালোবাসার পথ। মনোযোগী হয়ে সবাই হয়েছে সহযোগী।

চলে এলো সেই আলো ছড়ানোর শুরুর দিনটি। কঠিন বাস্তবতা, অপ্রত্যাশিত বাধা ও সাময়িক দুর্বলতা ডিঙিয়ে ‘মানবতার কল্যাণে একতা’ এই স্লোগানকে আঁকড়ে ধরে জ্বলতে শুরু করলো ‘হিউম্যান এইড বাংলাদেশ নামের প্রদীপটি। ২০১০ সালের ২৫ মে থেকে।

শুরুর পথটা অমসৃণ থাকলেও ‘হিউম্যান এইড বাংলাদেশ’ এর ছায়াপথ এখন অনেক স্বাপ্নিক ও ফুলেল। এর দায় যাদের উপর বর্তেছে তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির পথ চলা এখন আদর্শ।

‘হিউম্যান এইড বাংলাদেশ আজ একটি বাতিঘর, একটি আলোকশিখা, প্রজন্মের পথদ্রষ্টা। অথচ পথচলার প্রারম্ভে এত কিছু ছিল ভাবনাতীত। কিন্তু পরিশ্রম ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা যে স্বপ্নকেও বাস্তবায়ন করতে পারে তার উদাহরণ আবার উপস্থাপন করলো ‘হিউম্যান এইড বাংলাদেশ’।

আলো ছড়ানোর অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে  ‘হিউম্যান এইড বাংলাদেশ’ ঢাকার কল্যাণপুর বস্তিতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের জন্য ‘টুনাটুনির পাঠশালা’ নামে একটি পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেছে। সপ্তাহের ছয়দিন পড়াশোনা চলে এই পাঠশালায়। চার থেকে শুরু করে বারো বছর বয়সী শিশুরা এখানে শিক্ষা নেয়।

সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত শিশুরাই এই পাঠশালার শিক্ষার্থী। বর্তমানে ১৬২ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে এই পাঠশালা তাদের পাঠদান কাজ করে যাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ বসবাস করে কল্যাণপুর বস্তিতে, আবার কেউ থাকে রাস্তায়।

এদের অনেকেরই দু’বেলা খাবার জোটে না। কিন্তু তারা পড়া-লেখার প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী। একটি দিনও তারা স্কুল মিস দিতে চায় না।
এছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুলে বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়। এতে বিভিন্ন শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র দেখানো হয়। প্রতিদিন পাঠশালার

ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। মাঝেমাঝেই স্বেচ্ছাসেবকরা পাঠশালার ছাত্রছাত্রীদের জন্য নানা ধরনের খাবার নিয়ে আসেন। পড়াশোনার পাশাপাশি পাঠশালার শিক্ষার্থীদের এক্সট্রা কারিকুলাম হিসেবে গান, নাচ, অভিনয়, আবৃত্তি শেখানো হয়।

সম্প্রতি স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের তথ্য প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ তৈরির লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়েছে।

এ পাঠশালার কোনো দারোয়ান নেই, নেই কোনো স্কুল ভ্যানও। বিদ্যালয় খোলা, বন্ধ, বাচ্চাদের ডেকে আনা, সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো দু:সাধ্য কাজ স্বত:স্ফূর্তভাবে করে থাকেন একজন শিক্ষিকা। শুরুর দিকে এই কাজটি উর্মি নামের ১২ বছরের একটি মেয়ে একাই করে থাকত।

পাঠশালায় শিক্ষায় আছে মমতাময়ী তিনজন শিক্ষিকা। তারা অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বাচ্চাদের শিক্ষা দেন। সপ্তাহে ছ’দিন নিয়ম করে ক্লাস নেন তারা। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবটুকুই তারা উজাড় করে দেন এসব পথ শিশুকে। তাদেরকে মাস শেষে কিছু সম্মানি দেওয়া হয় 'হিউম্যান এইড বাংলাদেশ' এর ক্ষুদ্র ফাণ্ড থেকে।

'হিউম্যান এইড বাংলাদেশ' এর কর্মীরা যেহেতু এই এলাকার জনগণকে নানা বিপদ আপদে সাহায্য করেন সেজন্য বাচ্চাদের মা-বাবারা তাদের উপর ভরসা করতে পারছেন। 'হিউম্যান এইড বাংলাদেশ' এর স্বেচ্ছাসেবকরা বাচ্চাদের অভিভাবকদের শিক্ষার গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টার পাশাপাশি অভিভাবকদের নিয়ে মাঝে মাঝে বিভিন্ন কর্মমুখি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

ফলে বাচ্চাকে কাজে না পাঠিয়ে মা-বাবারা তাদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। নতুন অনেক মা-বাবাও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তাদের বাচ্চাদের এই পাঠশালায় ভর্তির জন্য।

অন্য যেকোন পাঠশালার থেকে এই পাঠশালা ব্যতিক্রম। কারণ এখানে অনেক পরিকল্পিত উপায়ে শিক্ষা দেওয়া হয়।

‘হিউম্যান এইড বাংলাদেশ’ এর স্বেচ্ছাসেবকরাই মূলত এই পাঠশালাটি চালাচ্ছেন। তারা সময় পেলেই পাঠশালায় গিয়ে ক্লাস নিয়ে আসেন, ছাত্র-ছাত্রীদের খোঁজখবর নেন, তাদের জন্য মাঝেমাঝে খাবার নিয়ে যান। ‘মানবতার কল্যাণে এক‍াত্ত্বতা’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে কাজ শুরু করে এরপর রক্তদান কর্মসূচি, ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত জনগণকে সাহায্য প্রদান, প্রতিবন্ধীদের সহায়তাসহ নানারকম জনকল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছে 'হিউম্যান এইড বাংলাদেশ'। তারা যে কাজগুলো করেন তার সবগুলোই সামাজিক কল্যাণমূলক, লাভবিহীন এবং সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত।

তারা বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিপ্লব ঘটানোর পরিকল্পনাকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমরা যেহেতু দরিদ্র দেশ, সেহেতু সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষিত করে তুলতে হবে সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত শিশুদের। স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে সবার কাছে।
'হিউম্যান এইড বাংলাদেশ' চায় সব মানবপ্রেমী মানুষ তাদের সাথে যুক্ত হোক এবং দেশের সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর কাজে তাদের
সহযোগিতা করুক।

আঁধারিক গাম্ভীর্যে আলোর চঞ্চলতা আনতে ভোরের সূর্য হবে হিউম্যান এইড বাংলাদেশ। প্রভাতি দোয়েল হয়ে পাঞ্জেরির ঘুম ভাঙাবে হিউম্যান এইড বাংলাদেশ।


সুমাইয়া জাফরিন চৌধুরী: এডুকেশন ডিরেক্টর, হিউম্যান এইড বাংলাদেশ




বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।