ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পর্নাসক্তির সাংস্কৃতিক বিনির্মাণ

রাজীব মীর, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৫
পর্নাসক্তির সাংস্কৃতিক বিনির্মাণ

মনে করি, একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীর নাম x। একই উপজেলায় একটি সরকারি স্কুল এবং একটি বেসরকারি স্কুল রয়েছে।

বেসরকারি স্কুলটির নাম এ রব হাই স্কুল। দু’টি শত্রু স্কুল। শুধু যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ শত্রুতা, তা কিন্তু নয়। শিক্ষকরাও এর অংশ। এ কারণে সরকারি স্কুলের কাউকে এ রব স্কুলের স্যাররা প্রাইভেট পড়ান না। সরকারিরা তো নয়ই। এমতাবস্থায় x তার বাবার শরণাপন্ন হয়। গফুর স্যার X এর বাবার  বন্ধু, একসঙ্গে বিএড করেছেন। রাজি হয়েছেন, কিন্তু পড়তে হবে সিনিয়রদের সঙ্গে, এটা ফাইনাল। x  যেহেতু সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থী, এ রব কর্তৃপক্ষ জানার রিস্ক তাই কম। যে কোনো কারণেই হোক সখ্য গড়ে ওঠে ব্যাচের সকলের মধ্যে। এদের কেউ এখন বিচারক, কেউ সেনা অফিসার, কেউবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার।

ক্লাশের সেরা ছেলের দল, সারাদিন মুখে পড়া অন্তরে বিষের ছোবল। চাবির গোছায় নারী-পুরুষের অশালীন ছবি দেখা দিয়ে শুরু। এরপর এক এক করে প্রতিদিন দেখানোর পালা; ‘কাল তুই আমাকে দেখাসনি, আজ দ্যাখ, আমি কী নিয়ে এসেছি’। উত্তরোত্তর ভিউ কার্ড, পোস্টার, ফটো, চটি পাঠ, পর্নভিডিও, গালগল্প চলছে। নবম শ্রেণির ফল এলো। x অংকে ৬৮ পেয়েছে, অথচ বন্ধুরা ৯৮ পর্যন্ত পেয়েছে। পরের দিন ক্লাসে গিয়ে উপস্থিত সে, মন খারাপ। কল্পনা আর শোনা অভিজ্ঞতার মিশেল দিয়ে বয়ানে বন্ধুদের এমনভাবে মোহিত করলো, শ্রেণিকক্ষের কোনো শিক্ষকও এতো ছাত্র এতোক্ষণ একসঙ্গে জমিয়ে রাখতে পেরেছেন বলে দেখা যায়নি। পরের দিন থেকে টনিকের মত কাজ, বন্ধুরা সারা রাত নিজ নিজ পর্নভিডিও দর্শনের অভিজ্ঞতা বয়ান করছে, আর x সারা রাত অংক কষতে ব্যস্ত থাকে। কেউ কেউ সেবার ফাইনালও উৎরাতে পারেনি। তাকে ছোঁয়াতো দূর। ফাস্ট বয়।

খেলাটা এখানেই শেষ হলে পারতো। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো x। হলে থাকে। রাত জেগে খেলা দেখে সবাই। উৎসাহী চোখ রাত আড়াইটায় টিভি সিক্স দেখে। সেখানেও চলে খেলা, তবে ক্রিকেট বা ফুটবল নয়। বছর কয়েক স্টার মুভিজ আর টিভি সিক্সে সেক্সপ্রধান ছবি দেখেই কেটে যায় অনেক আনকোরা প্রেমিকের। হলের কক্ষেও যে মাঝে মধ্যে টেস্ট ম্যাচ চলে, সংবাদে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পর ওপথে আর মন বসেনি তার। তথ্যপ্রযুক্তির সহজ প্রবেশগম্যতার ফলে স্ক্রিনে খামোখা চোখের সামনে পর্নগ্রাফি হাজির করেছে, বন্ধু বা শত্রুর দরকার পড়েনি। সেখান থেকে উৎসাহ নিয়ে যা দেখতে মন চায়, লিখে ক্লিক করলেই এরকম লাখো গোপন ক্রিয়াকর্ম চোখের সামনে হাজির হতে শুরু করে, লোভ সামলানো দায়। জনসম্মুখে এ কথা স্বীকার করারও নানান ঝক্কি; বিকৃতমনা, অসুস্থ, অস্বাভাবিক। এগুলো সবই ব্যক্তি x এর ব্যক্তিগত বা প্রাইভেট, কাজেই সিরিয়াস নিবন্ধের ভাষা ও বক্তব্য ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে হওয়া উচিত নয়, x খেপে যেতে পারে বা বিরক্ত হতে পারে। পরে অবশ্য অংকের নিয়মে x  এর মান নির্ণয়ের প্রচেষ্টা থাকবে। এবার একটু সমাজে  চোখ ফেরাই ।

প্রথমে একটা নাম শুনি। একটেল সুমন। সুমন নামে এক সুদর্শন ছেলে গোটা বিশেক মেয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও করে বাজারে ছেড়েছে। তোলপাড়! ভাগ্যাহতা নারীদের কি হয়েছে, জানা নেই। একে একে বহু কাহিনী জমা হয়েছে, বহু নারী আত্মহত্যাও করেছে। সমাজের কিছু হয়নি। যাদের গেছে, তাদের গেছে। কীভাবে যায়, ঘুরে দাঁড়ালে কী হয়, নিজের দেখা একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। আমার এক শিক্ষার্থী কেঁদে ভাসছে। তার প্রেমিকার বোন এক ছেলের সঙ্গে কুয়াকাটা গেছে। কী করেছে,  এখন ছেলেটি জিম্মি করে টাকা নিচ্ছে নিয়মিত। টাকা না দিলে বাজারে চমৎকার ভিডিওটা ছেড়ে দেবে। ছেলেটি ঢাকায় একটি কম্পিউটারের দোকানের সেলস পারসন। ফোন দিলাম তাকে, পাশে স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক বড় নেতা বসা। ফোনে ছেলেটি বললো আছে, কী হইছে। ভাইকে ফোন ধরিয়ে দিলাম। তাকেও চড়া উত্তর ওই ছেলের, গালিগালাজও। সেই রাতেই আমরা ঢাকা। সকালে শাহবাগ থানার ওসির সহযোগিতায় তাকে ধরা হলো। ছেলের অবস্থা তথৈবচ। এখনও হয়ত কারাগারে।

ইন্টারনেট সোসাইটি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ভিডিও সমাজে বিদেশি নায়িকাদের সেক্স ভিডিওর ছড়াছড়ি। উত্তরাধুনিক যুগে সেগুলো নাকি সাজানো। মুখ নায়িকার, দেহ অন্যের। এক সকালে অনলাইনজুড়ে সংবাদ ঝড়। নায়িকা-নাটকের, ঘটনা বাস্তব। গোটা বাংলাদেশ তিরষ্কারের ভাষায় ছি ছি করে! মডেলিং! আর নেশা করে সারারাত ধরে কঠিন চোখে সে ভিডিও দেখে, লালসা মেটায়! আবার গেলো গেলো রব তোলে!  অনুরূপ ঘটনা হরহামেশা ঘটে, অনেকের ঘরেই ঘটে। আর না হলে এত ভিডিও কোত্থেকে আসে। হয় বলেই আসে, তাই না?

প্রশ্ন হলো, হয় কেন? সবই যে জানিয়ে হয়, তা কিন্তু নয়! গোপন ক্যামেরা বলতে একটা বিষয় আছে। আরেকটা ভয়াবহ অসুখের নাম অজ্ঞতা-অশিক্ষা। ফুসলিয়ে, ভুলিয়ে ও লোভ দেখিয়ে অনেককেই এই ফাঁদে পা দিতে বাধ্য করা হয়। অনেকে কিছু না করেও হয়ে যেতে পারেন, নায়ক-নায়িকা। কী ভয়ংকর! ধরেন, মডেলের চোখের মত চোখ বা নায়িকার মুখের মত মুখ হলেই হলো, বাজার মাত ! তারা হয়তো যে কাজটি কখনও করেনইনি, ফেঁসে যেতে পারেন, পর্নদর্শক মনের গহীনে ভোগের লালসা মেটাতে! অনেকে ঘুমের ঘোরে বা নেশার আচরে পড়ে এরকম প্রতারণার শিকার হন, হতে পারেন। সিনেমায় অনুরূপ ঘটনা দেখা গেলেও এগুলো এতটুকু বাস্তবতা বিবর্জিত নয়। স্কুল শিক্ষক পরিমল বা পান্না মাস্টারের ফাঁদ সংবাদতো সুবিদিত । জীবনের কোনো সেক্টর এর ব্যতিক্রম নয়। গ্রামের মাতবর আরশহরের অফিসার বাছ-বিচার নেই, সকল পেশায় নানা ফর্মে কিছু লোক এরকম প্রতিনিয়ত করে যায়। সংবাদে দেখা যায়, কখনো কখনো বেআমল হুজুর সমকামী হয়, অনৈতিক ফাদার হন বহুগামী। কিছু উঠে আসে, কিছু উঠতে উঠতে নিভে যায়। কিছু হতেই থাকে, সমাজই বাঁচিয়ে রাখে। না হলে বাচ্চাদানে অসমর্থ দম্পতিরা বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে পীরের দরগাহ থেকে বাচ্চা নিয়ামত লাভে সমর্থ হোন কার জোরে?

চট্টগামে অনেক পীর-আউলিয়ার মাজার আছে। চট্টগ্রামের মাজারপ্রীতিও বেশ। মাজার কেন্দ্রিক একদল ধর্মব্যবসায়ী কিছু মাজারে শায়িত কামেল পীরকে ব্যবহার করে বিভিন্ন কীর্তি-কলাপ করে আসছে। একদিন রেল স্টেশনে বসে আছি। মানুষের জীবনযাত্রা লাইভ দেখে লিখেছিও সেসময়। এরকম সময় একজন খানকায়ের খাদেম একটি বালকের পাশে এসে বসলেন। রাত ১টা হবে। স্টেশনের সেকেন্ড অফিসার শাকের ভাইকে বলা আছে। ভয় নেই, বেশি দূর যাওয়া যাবে না। গেলে গাঁজাখোর-ছেঁচড়াদের হাত থেকে রক্ষা নেই। পুলিশও জানে। সে যা হোক। খাদেম বালককে মাজারের সেবক বানাবেন। ফুঁসলাচ্ছেন। গায়ে হাত দিচ্ছেন। বালক ক্রমশ অবশ হয়ে পড়ছে...! হঠাৎ আমাদের ত্বরিত উপস্থিতিতে সে যাত্রায় বালক রক্ষা পায়।

ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। আমার বন্ধু, সাঁতার শিখেছে  পুকুরে, বাবার হাত ধরে। বাড়িতে বেড়াতে আসা এক কাকুও তাকে সাঁতার শেখালেন, ওখানে কী যেন লাগিয়ে। চমকে সরে এসে সে বাসায় জানায়। কিন্তু  তার বাবা-মা পরিবারের বাইরের কাউকে কখনও এটা বলতে নিষেধ করে দেস। বন্ধু হওয়ার সুবাদে তখন জানতে পারি। বয়স বিবেচনায় প্রতিক্রিয়া আন্দাজে অসমর্থ ছিলাম বৈকি। ইদানীং মনে হচ্ছে , কোথাও আমাদের বড় কোনো ভুল হচ্ছে।

এক. ঠিক সময়ে যৌন শিক্ষার অভাব
দুই. যৌনতা আর সাংস্কৃতিক বোধের বিচ্যুতি
তিন. এব শব্দ উচ্চারণ করো না- কাউকে বলো না জাতীয় কথা

আমাদের স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষকরা জবা ফুলের পরাগদণ্ড ধরায়ে বসে থাকতেন, যে দণ্ড সম্পর্কে না শিখলে আরও হাজার রকমের দণ্ড জীবনে চাপতে পারে, সেগুলো যে পড়াশোনা করা অপরিহার্য, শেখাননি। এড়িয়ে গেছেন। পরিণামে বহু নারী শিক্ষার্থী পিরিয়ডকালীন সমস্যা শুধু না বলতে পেরে, ব্যথায় কাতরেছেন, অনেকের সংক্রমণ পর্যন্ত হয়ে গেছে। পারিবারিক শিক্ষাও যদি থাকতো, এরকম হতো না। দুর্ভাগ্য,বাংলাদেশ! সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা! সিনেমার নামও শুধুই কমলা, কমলার বনবাস। অল্প বয়সে কন্ট্রাসেপটিভ ব্যবহার না করে সঙ্গম করার কারণে অনেকেই অবিবাহিত অবস্থায় কনসিভ করেন, অ্যাবরশনো করেন, মরেও যান অনেকেই। সকল ‘মহিলা কলেজে’র আশে পাশে অ্যাবরশনের সাইনবোর্ড বা মেটার্নিটি ক্লিনিকে চোখ দিলেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা বিষয়টির হদিস পেতে পারেন।

কিন্তু যে বিষয়টি আরও মারাত্মক, সেটা হলো জেন্ডার ইনসেনসিটিভিটি। আমরা নারীর সমতার কথা বলি, কিন্তু ভাবি না, এটা পর্ন দেখা বা এ জাতীয় আলোচনায় কত স্পষ্ট। স্বয়ং বিশ্ববিদ্যালয়েই এরকম হাজার প্রগতিশীল শিক্ষক পাবেন, যিনি আপনার সঙ্গে একজন নারী দেখলে অযথাই মুখ টিপে হাসবেন। একবারও ভাবেন না, কতোটা অনিরাপদ ভেবে নারীকূল তাদের চোখের দিকেও তাকান না।

আমাদের গালিগুলোও কিন্তু সব নারীপ্রধান। মা বোন ধরে কত কিছু! বাবা-ভাইকে ধরে কিন্তু কোনও গালি নেই। ইন্টারেস্টিং! চটিতে আছে বৌদি, মাসী , পিসীর গল্প। হিন্দু নারী। মালাউন। এ যেন পুরুষতন্ত্র আর সাম্প্রদায়িকতার ডাবল ক্ষোভ। মনের আসল চেহারা নাকি বিছানায় প্রকাশ পায়, কল্পনার বিছানায় সেটা তো আরও রঙিন, বল্গাহীন। এই যে চটি-পাঠ,  নীল ছবি বা পর্নছবি দর্শন, সেখান থেকেই তো মনের গহীনে বাস করতে করতে বড় হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, নারীর প্রতি সহিংসতা সম্পন্ন বোধ, যা যৌন অবচেতনে প্রকাশ পায়, পাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক হামলায় হিন্দু আর আদিবাসী নারী প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হয়। ঢাকার রাস্তায় কর্মজীবী গারো নারীকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে কাপড় খুলে হিন্দু-মুসলমান পরীক্ষা করা হয়। মুক্তির বউ মানে ভারতবাদী হিন্দু...ওদের ধর্ষণ করা হয়। এই যে পারিবারিক অচেতন অবস্থা বা রাষ্ট্রীয় নির্মম বাস্তবতা এগুলো কি পর্ন থেকেও খারাপ নয়!

শৈশবে কোনো কিছুর মান বের করতে মনে মনে X ধরতাম। শিক্ষার্থীর নামও X। আগে মান বের করা যেতো। এখন তথ্যপ্রযুক্তির অকল্যাণে অংকের সেই x এতো বিস্তৃত, অপনাম হয়ে দাঁড়িয়েছে 3x!  অপমান হয়েছে কার? কারা মেলাবে সেই অংক। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, নাকি রাষ্ট্র? ভোগ ও লোভের লালসা উপেক্ষা করে ব্যক্তি অগ্রসর হবে, পরিবার হবে সচেতন, সমাজ সতর্ক, আর রাষ্ট্র? অপেক্ষা ব্যতীত আর কিইবা করার আছে?

লেখক
রাজীব মীর
সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ২১২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৫
এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।