বিড়িশিল্পকে উৎসাহ প্রদান এবং সিগারেট কোম্পানিগুলোকে বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দিয়ে এবারের বাজেটে তামাকের ওপর কর প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাকের ওপর কর প্রস্তাবের প্রধান দিকগুলো হচ্ছে :
* সব ব্র্যান্ডের সিগারেটের ওপর সম্পূরক শুল্কের হার বৃদ্ধি করা হয়েছে বর্তমান হারের চেয়ে ২ থেকে ৩ শতাংশ।
* চর্বনযোগ্য তামাক যেমন জর্দা ও গুলের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০% থেকে বাড়িয়ে ৩০% করা হয়েছে।
* সিগারেট কোম্পানিগুলোর ওপর আয়কর বাড়িয়ে ৪২.৫% করা হয়েছে, যা আগে ছিল ২৭.৫% (শেয়ারবাজারে অংশগ্রহণকারী কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে) এবং ৩৭.৫% (অন্যান্য কোম্পানির ক্ষেত্রে)।
* বিড়ির ওপর কোনো কর বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়নি, বরং এ খাতকে উৎসাহিত করার জন্য বিড়ির প্যাকেটে শলাকার সংখ্যা ১২টি এবং ৮টি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে কেবল ২৫ শলাকার বিড়ির প্যাকেটই পাওয়া যাচ্ছে।
* জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে তামাকের ওপর করবিষয়ক একটি সেল গঠন করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে ‘স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি, কর্মসংস্থান এবং রাজস্ব আয়ের কথা বিবেচনায় রেখে ভারসাম্যপূর্ণ তামাক নীতি প্রণয়ন। ’
* অন্যান্য কর প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে তামাক বর্জ্য রপ্তানির উপর ৫% শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং কাঁচা তামাক রপ্তানির ওপর শুল্কহার ১০% থেকে কমিয়ে ৫% করা।
প্রতিক্রিয়া
আবারও বিড়িশিল্পকে করের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হলো। কেবল ছাড় দেওয়াই নয়, এ ‘শিল্প’কে উৎসাহিত করার জন্য বিড়ি প্যাকেটের আকার ছোট করা হয়েছে : বর্তমানে ২৫ শলাকার যে বিড়ির প্যাকেট পাওয়া যাচ্ছে, তার সাথে ১২ শলাকা এবং ৮ শলাকার বিড়ির প্যাকেটও এখন থেকে পাওয়া যাবে। যার অর্থ, মাত্র ২ টাকায় এক প্যাকেট বিড়ি কেনা যাবে। বিড়িকে গরিব মানুষের কাছে আরও সহজলভ্য করার এ উদ্যোগ সত্যিই উদ্বেগজনক।
সিগারেটের ওপর যে সামান্য কর বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে (২-৩ শতাংশ) তা খুবই অপর্যাপ্ত এবং দামের ওপর এর প্রভাব বলতে গেলে একেবারেই পড়বে না। আর সিগারেটের মূল্যস্তর বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তার ফলে দাম হয়তো কিছুটা বাড়বে, কিন্তু বাড়তি আয়ের সিংহভাগই সিগারেট কোম্পানিগুলোর কাছে যাবে, সরকার বাড়তি রাজস্ব পাবে কমই। এর পরিবর্তে কেবল সম্পূরক শুল্কের হার উল্লেখযোগ্যভাবে (অন্তত ১৫-২০%) বাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে যদি মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হতো, তাহলে সরকারের রাজস্ব আয় অনেক বেশি হতো এবং সিগারেট কোম্পানির আয় কমে যেত। আর সব চেয়ে বড় কথা, সিগারেটের ব্যবহার কমতো উল্লেখযোগ্য হারে।
জর্দা ও গুলের ওপর সম্পূরক শুল্কের হার বাড়ানো ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ এক্ষেত্রে রাজস্ব আদায় খুবই দুর্বল। তামাক থেকে আহরিত মোট রাজস্বের মাত্র ০.৪% আসে জর্দা ও গুল থেকে। তাই রাজস্ব আদায়ের কার্যকারিতার ওপর জোর দিতে হবে।
সিগারেট কোম্পানিগুলোর ওপর আয়কর বাড়ানোর প্রস্তাবকেও অভিনন্দন জানাই। তবে এক্ষেত্রে বিড়ি শিল্পকে দুঃখজনকভাবে ছাড় দেওয়া হলো। ‘টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি সেল’ গঠনের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে এটি কীভাবে কাজ করে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আশা করি, এ সেলের মাধ্যমেও সিগারেট ও বিড়ি ‘শিল্পে’র স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করা হবে না।
সর্বোপরি, বিড়ি‘শিল্পে’র স্বার্থ রক্ষায় বাজেটের যে প্রচেষ্টা তা শুধু নিন্দনীয়ই নয়, উদ্বেগজনকও। বাজেট বক্তৃতায় তামাকের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশ ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হলেও বিড়িকে নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় প্রশ্ন জাগে, বিড়ি কি তবে তামাক নয়? উত্তরটা সরকারেরও জানা : বিড়িও তামাক এবং সিগারেট ও অন্যান্য তামাকপণ্যের মতোই অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কারণ। তাহলে, কার স্বার্থে বিড়িকে রক্ষা করা হচ্ছে এবং প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে? সরকারের কাছে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ : হাজার হাজার মানুষের জীবন, না বিড়ি বাণিজ্যের সাথে জড়িতদের লাভ আর এর সাথে জড়িত শ্রমিকদের অ-মানবিক কর্মসংস্থানকে টিকিয়ে রাখা?
বাজেট বক্তৃতায় তামাক নিয়ন্ত্রণের কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে দেখে ভালো লাগলো। আর তামাকবিরোধী আন্দোলনের ব্যাপকতার কথা স্বীকার করা হয়েছে, সেটিও ইতিবাচক এবং তামাকবিরোধী আন্দোলনকারীদের কাজের স্বীকৃতি। তবে তামাকবিরোধী আন্দোলনকারীরা আনন্দিত হবেন তখনই যখন তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য সত্যিকারের কার্যকর কর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিশ্বব্যাপী পরীক্ষিত এসব পদক্ষেপের কথা সরকারের রাজস্ব বোর্ড ভালো করেই জানে। শুধু দরকার এ পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
লেখক : মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি কোঅর্ডিনেটর, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২১১৯ ঘণ্টা, জুন ০৯, ২০১১