ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শোষণ বঞ্চনাই ভাসানীর সংগ্রামের প্রেরণা

সজিব তৌহিদ, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৫
শোষণ বঞ্চনাই ভাসানীর সংগ্রামের প্রেরণা

ঢাকা: মাওলানা অবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার এক জনসভায় বক্তৃতা করতে গেছেন। পরিস্থিতি ঘোলাটে দেখে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হলো- ‘এখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে, কোনো বক্তব্য দেওয়া যাবে না’।



বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদী মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলেন, ‘মানি না ১১৪ ধারা, আমি বক্তৃতা করবো’। মাওলানা ভাসানী অগ্রজ মানুষ। তাই বঙ্গবন্ধুকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন,  ‘১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। আমাদের সভা করতে দেবে না। আমি বক্তৃতা করতে চাই না। তবে আসুন আমরা সবাই মোনাজাত করি’।

তৎক্ষণাৎ মাইক্রোফোন সামনে নিয়ে ভাসানী ‘আল্লাহু আমিন’ বলে মোনাজাত শুরু করেন। সেই মোনাজাত এক ঐতিহাসিক মোনাজাত। আধা ঘণ্টাব্যাপী মোনাজাতে বক্তৃতার কোনো কিছুই বাকি রাখলেন না। শাসকদের শোষণ, জুলুম-নির্যাতনের সবকিছুর প্রতিবাদ জানালেন। মনের ক্ষোভ-আক্ষেপ আর দাবির কথা তুলে ধরলেন। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ ও মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা বোকা বনে গেলেন।

এমনই এক চৌকস মানুষ ছিলেন নির্যাতিত-মেহনতি মানুষের ‘নয়ন মণি’ হিসেবে খ্যাত মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। যিনি ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে সমধিক পরিচিত। তার ভক্তরা তাকে ‘যুগ যুগ জিও তুমি, মাওলানা ভাসানী’ নামে সম্মানিত করেন। আর কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীর তাকে স্মরণ করেন ‘ভাসানীর ভাষা দিতে আসে মিছিলের দলে দলে’ গানটির মাধ্যমে।

মাওলানা ভাসানীর সারা জীবন কেটেছে দিনমজুর মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে। বিনিময়ে তাকে সাতাশ বার জেলের ঘানি টানতে হয়েছে। দেশের জাতীয় রাজনীতির ইতিহাসে তার রয়েছে অনবদ্য ভূমিকা।

তার শৈশব-কৈশোর কাটে দারিদ্র্যের কষাঘাতে। শৈশবে তিনি খেটে খাওয়া মানুষের নিষ্পেষণ দেখেছেন। দুর্ভিক্ষে কচু, ঘেঁচু, জোয়ার খেয়ে মানুষ বাঁচতে দেখেছেন। সুদখোর মহাজনের ঋণের জালে মজদুরদের ফেঁসে যাওয়া দেখেছেন। শোষণ ও অত্যাচার থেকে বাঁচতে ভিটে-মাটি, থালা-ঘটি-বাটি সব মহাজনের হাতে সঁপে দিতে দেখেছেন। শৈশবের এসব দৃশ্যই তাকে প্রতিবাদী করে তুলেছে।

যুবক ভাসানী মহাজনি শোষণ ও জমিদারদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে টাঙ্গাইল-পাবনা ও সিরাজগঞ্জে স্থায়ী প্রতিবাদ শুরু করেন। জীবনের পরতে পরতে খেটে খাওয়া মানুষের দারিদ্র্য, দুঃখ-দুর্দশা, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা যুগিয়েছে তার আন্দোলনের রসদ। তাই শাসকের শোষণ, নিপীড়ন ও বৈষম্য তাকে সংগ্রামী হতে বাধ্য করেছে। এখনও সমাজে থেকে এসব দূর হয়নি। সুতরাং ভাসানীর সংগ্রাম চলছে, চলবে।

আমৃত্যু রাজনীতি করে নিজের জন্য কিছুই করেননি। তিনি নিজে যেমন সাদামাটা জীবন-যাপন করতেন, তার উত্তরাধিকারদেরও সেই পথেই হাঁটতে হয়েছে।

তার নেতৃত্বে ১৯৩১ সালে সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় এবং ১৯৩৩ সালে গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন ইতিহাসে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে।

ধারণা করা হয়, আঠারো-উনিশ শতকের কৃষক বিদ্রোহ, ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ, নীলকরদের বিদ্রোহ, হাজী শরীয়তউল্লাহ’র বিদ্রোহ, দুদু মিয়ার বিদ্রোহ তাকে প্রভাবিত করেছে।

সে সময় ক্ষুধা-দারিদ্র্য দূর করার সংগ্রাম-আন্দোলন ছিল সার্বজনীন। ভাসানী বলতেন, ‘হিন্দুর ক্ষুধা, মুসলমানের ক্ষুধা,  বৌদ্ধের ক্ষুধা, খ্রিস্টানের ক্ষুধা একই রকম। শোষক ও জালেমের কোনো ধর্ম নেই।   জালেম হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক, দেশি হোক আর বিদেশি হোক, কালো চামড়ার হোক আর সাদা চামড়ার হোক-সব সমান’।

ভাসানী উদারপন্থি জ্ঞানপিপাসু ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তৎকালীন রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তার ব্যাপক আগ্রহ ছিল। ধর্মীয় জ্ঞানে তিনি এতো বেশি পণ্ডিত ছিলেন যে, তার কাছে হাজার-হাজার মানুষ ধর্মীয় শিক্ষা নিতেন। তাকে ধর্মীয় গুরু মানতেন। তার ভক্তরা তাকে ‘পীর বা হুজুর’ বলে সম্বোধন করতেন।

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কোনো কালেই তিনি পছন্দ করতেন না। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করাও ছিলো তার অপছন্দের কাজ। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িকে তিনি সংকীর্ণতাই মনে করতেন। সব ধর্মের মানুষকে সম্মান করতেন, ভালোবাসতেন ও সবার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়াতেন।

তিনি  সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রে মিশ্রিত অপরিমেয় অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তার আদর্শ আজো বাম-ডান-মধ্য সব পন্থিদের  অনুসরণ ও অনুকরণীয়।

এ বঙ্গভূমিতে বহু বছর থেকে চলা আসা ধর্মের নামে রাজনীতি, সহিংস কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি সব সময় ধিক্কার দিয়েছেন। জামায়াতের মৌলবাদী রাজনীতিরও তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। তাদের হাতে তিনি শারিরীকভাবে লাঞ্ছিতও হয়েছেন। ধর্মের নামে জামায়াতের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে ভাসানী বলেন, ‘মিশরের নীল নদের পানি যেমন নীল নয়, জামায়াতে ইসলামও তেমনি কোনো ইসলাম নয়’।

তার স্বপ্ন ছিল টাঙ্গাইলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেরোসিন ও লবণ বাদে যা কিছু নিত্য ভোগ্য পণ্য সবই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা উৎপাদন করবেন। পরবর্তীতে তার পরিপূর্ণ ইচ্ছানুযায়ী না হলেও টাঙ্গাইলের সন্তোষে ‘মাওলানা ভাসানী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ’

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই হবে বৃক্ষের মতো অসাম্প্রদায়িক। দেখো না,  বৃক্ষ সবাইকে ফল দেয়, ছায়া দেয় আর বৃক্ষ প্রতিদান চায় না। তোমরা বৃক্ষের গুণে গুণান্বিত হও, তাহলেই মানুষ হবে’।

১৯৪৭ সালের আগেই পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম করতে থাকেন মাওলানা ভাসানী। ১৯৪৯ সালে তার নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ছিলেন এ রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। যা পরবর্তীতে বর্তমান আওয়ামী লীগে রূপ ।

১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার যে ঘোষণা দেন। তার প্রতিবাদে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে ১৯৫২ সালে ৩০ জানুয়ারি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। যার মাধ্যমে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সুসংগঠিত ও সফল হয়।

পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ-নিপীড়ন ও বৈষম্যের প্রতিবাদে ১৯৫৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারী সম্মেলনে তিনিই প্রথম জনসম্মুখে বক্তৃতায় ‘পাকিস্তানকে ওয়ালাইকুম আসসালাম’ জানিয়েছেন। যা স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেদিনের সেই বক্তৃতার জন্য পরে তাকে জেলও খাটতে হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে কথা বলায় বার বার তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের রোষানলে পড়তে হয়েছে। একাত্তরের মার্চে গণহত্যা শুরু হলে পাকিস্তানি বাহিনী তার সন্তোষের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তিনি ভারতে চলে যান। সেখানে তাকে জাতীয় নেতার মর্যাদা দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের তিনি ছিণে উপদেষ্টা। এভাবেই চলে তার সংগ্রামী জীবন।

বৃক্ষের গুণে গুণান্বিত এই মানুষটি ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে সমাহিত করা হয়। দিনটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে ভাসানীর মাজার প্রাঙ্গণে।

মজলুম এই জননেতার ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে মঙ্গলবার (১৭ নভেম্বর) তাকে স্মরণ করবে পুরো জাতি।

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে ভাসানীর অন্যতম স্মৃতিময় বাড়িতে নানা কর্মসূচিতে পালিত হবে তার মৃত্যুবার্ষিকী।

মাওলানা ভাসানী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও মাওলানা ভাসানীর কনিষ্ঠতম নাতি আজাদ খান ভাসানী বলেন, সময়ের প্রয়োজনে, শেকড়ের টানে মাওলানা ভাসানীর আদর্শ ছাড়া জাতীয় মুক্তি সম্ভব নয়। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। এ প্রজন্মই মাওলানা ভাসানীকে বাঁচিয়ে রাখবে। তার আদর্শ বাস্তবায়নে শোষণ-নিপীড়নমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় তরুণ প্রজন্মই মাঠে থাকবে।

তিনি বলেন, মাওলানা ভাসানীর জীবন ও কর্মের ওপর এখন ভারত, কানাডা, ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা হচ্ছে। তরুণদের তার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং ভাসানী তো উপেক্ষিত হোক না,  ইতিহাসই থেকে এই বিশ্বমানের নেতাকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ সময়: ০০৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৫
টিআই/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।