ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা

স্বাধীনতা আমার বাঙালি হয়ে ওঠার গল্প

সৈয়দ ইফতেখার আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৬
স্বাধীনতা আমার বাঙালি হয়ে ওঠার গল্প

ঢাকা: হঠাৎ একদিন ট্রেন ভ্রমণে, জয়পুরহাটের আশপাশে কোথাও। মালয়েশিয়া ফেরত বাংলাদেশি এক কর্মীর সঙ্গে কথা।

প্রসঙ্গক্রমে তিনি বললেন— দেশ যতোটা না এগিয়ে যাচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে প্রচার-প্রসার। বাস্তবে এখনও আমরা কতটাইবা উন্নয়নশীল...।

- হঠাৎ এ কথা কেন মনে হলো?
- ট্রেনের নোংরা পরিবেশ দেখে।
- ট্রেন দেখে দেশ বিচার!
- মালয়েশিয়াতে এটি নেই, এমনকি পাশের দেশ ভারতেও না।

তার এসব নেতিবাচক কথা শুনে চুপ করে থাকার পরও ভদ্রলোক যেচে কথা বলে গেলেন। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে পাল্টা প্রশ্ন— মালয়েশিয়াতে হুটহাট ট্রেন যাত্রী একজনকে ধরে কথা বলা সম্ভব ছিল?
- তেমনভাবে নয়, আর সেখানে এতো সময় কই!
-(উঁচু সুরে) আমাদের বুঝি খুব বেশি সময়!
- না, তাও না। কিন্তু এখানে সবাই একই। আমরা আমরাই তো।

তার সেই ‘একই’ এবং ‘আমরা আমরাই তো’ শব্দ-বাক্যটা আজও কানে বাজে। দূরের এক জয়পুরহাটের লোকাল ট্রেন যাত্রার কাহিনীর মাজেজা এটাই। প্রবাসী সে ব্যক্তি,নিজ দেশ-দেশের মানুষ,বাংলা ভাষাভাষী পেয়ে অবলিলায় মেতে ওঠেন আড্ডায়। গ্রামেগঞ্জে, কিংবা শহর-হাটে সবখানেই এদেশ, এদেশের প্রকৃতি-মাটি-মানুষ-গন্ধ-গাছপালা সবই একই, এমন কি ভাষাও। এখানে মানুষে পার্থক্য থাকলেও হৃদয়ে একতার ঝনঝনানি আছে। হোক সে পাহাড়ি বা সমতলের-শহরের কেউ। দূর উপকূল বা চরাঞ্চলে গিয়েও ‘বাঙলা-বাঙালি’ আর অধুনালুপ্ত ছিটে গিয়েও ‘বাঙলা-বাঙালি’। এটাই তো বাংলাদেশ, আমাদের স্বাধীন সোনার বাংলা। যা সম্ভব হয়েছে ১৯৭১ র জন্য।

’৭১ এর ‍অর্জনে এখনকার একতা এবং একটি জাতি হিসেবে গড়ে ওঠাই তো স্বাধীনতার মাহাত্ম্য! মন থেকে বিশ্বাস করি ’৭১ মানব হৃদয়কে এক করেছে। যাকে চিনি না, তাকেও আপন মনে করার অকল্পনীয় শক্তি দিয়েছে, সর্বোপরি জাতি হিসেবে আমাদের বানিয়েছে অনন্য। আরও গভীরভাবে বললে— অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও আর্যর বাঙালি হয়ে ওঠার গল্পের স্বীকৃতি মহান ’৭১ থেকেই। তাই তো প্রকাশে গর্ব হয়: স্বাধীনতা আমার বাঙালি হয়ে ওঠার গল্প। যে গল্প আমার কাছে ধর্ম! রোজকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্পে দিন শেষে এগিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের বাংলাদেশ, আবার রাত পেরিয়ে ভোরে সম্ভাবনার সূর্য মারছে উঁকি।

কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় স্বাধীনতা যেমন— রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান। ঠিক তেমনি— কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা। তারপর আবার— যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা। এটাই স্বাধীনতা, আমার ইচ্ছে স্বাধীন মনের বাঁধন হারা তৃপ্তি। এই স্বাধীনতাই আমাদের দিয়েছে বিচরণ শক্তি। এগিয়ে যাওয়ার সাহস, সুপ্ত সূত্র-মন্ত্র।

পরাধীন এক পাকিস্তানে রবীন্দ্র সংগীত ছিল প্রায় নিষিদ্ধ। ছিল না মৌলিক অধিকার, উন্নয়নের ধারা-অর্থনৈতিক মুক্তি। গোলামির সব রকম শৃঙ্খল ভেঙে আজ বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িকতা ও পরমতসহিষ্ণুতার কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি বাঙালির পরম অধিকার এবং মাথা তুলে চলার শক্তি জুগিয়ে যাচ্ছে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লাখ মা-বোনের হারানো ইজ্জত। এই স্বাধীনতাই শিখিয়েছে চেতনাবোধ, ভালোবাসার উল্লাস। আর চারটি বছর পর (এখন স্বাধীনতার ৪৬ বছর) এই স্বাধীনতার অর্ধশত পূর্ণ করবো আমরা, সে কী গর্ব-মর্যাদা!

বাবা-মা-দাদী-নানা-নানির মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধের গল্পের বিশ্লেষণে নয়- ব্যক্তি হিসেবে নিজে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালনে-কৃতজ্ঞতায় আজ বলতে ইচ্ছে করে, প্রিয় দেশ মাতৃকা— ও মা, অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা... এবার তোমায় কিছু দিতে চাই! প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে শুধু এটুকু শপথ কি করতে পারি না? সবাই মিলে দেশ মাকে কিছু দিলে আমাদের উন্নতির জয়রথ আর থামায় কে! উন্নতির জন্য বাঙালির সম্মিলিত প্রচেষ্টার পাশাপাশি চাই একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী মনের উন্মেষ। তবেই সার্থক হবে বাঙালি জন্ম। কোথাও দেশ পৃথক হতে পারে কিন্তু ’৭১ আমাদের দিয়েছে সারাবিশ্বের বাঙালির নেতৃত্বের চাবিকাঠি। অনন্তকাল বঙালির সত্ত্বাকে জিইয়ে রাখার মন্ত্রণা। যা রক্ষার দায়িত্ব এদেশীয় তরুণ-যুবাদের।

তরুণ বা যুবক লেখক হিসেবে বলতে হচ্ছে— এমন একটা সময়ে আমাদের শিক্ষা জীবন গতি পেয়েছে যে সময় (২০০০-২০০৪) মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছিল ভিন্ন! ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল একটি গোষ্ঠী। এখন ভাবলে হয়ত একটু লজ্জাই হয়; সে সময় বিকৃত কিছু লিখেই পাস করতে হয়েছে। বড় কথা— যখন মানস গঠনের সময় তখন এসব জানতে-পড়তে-লিখতে হয়েছে। পরে অবশ্য মিলিয়ে দেখার সুযোগ মিলেছে বটে, কিন্তু একটা প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বিকৃত জ্ঞানও এই স্বাধীন বাংলায় দেওয়া হয়েছে! এর দায়ভার বা ক্ষতিপূরণের দায়িত্বটা নেবে কে! গভীরভাবে ভাবার আছে সেটি নিয়ে। আর এখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা হচ্ছে— যা অত্যন্ত  প্রশংসার দাবি রাখে। পাশাপাশি বাংলাদেশের নানামাত্রিক অভাববোধ এবং উন্নতি-অগ্রগতির সোপানে জাতি হিসেবে শান না দিলে পিছিয়ে পড়বো আমরা। একুশ শতকের মহান এই স্বাধীনতার মাসে চাওয়া শুধু এটুকুই।

লেখক: নিউজরুম এডিটর, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৬
আইএ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।