বুকে বিপ্লবের মন্ত্র, পকেটে চট্টগ্রাম বন্দরের চাকরির নিয়োগপত্র আর ঘরে তরুণী স্ত্রী, দেড় বছরের সন্তান এবং স্ত্রীর গর্ভে অনাগত সন্তান কোনটি বেছে নেবেন তিনি? সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় জনগণের অংশিদারিত্বের জন্য জাসদ রাজনীতি আর তাদের গোপন সংগঠন গণবাহিনীর আহবানেই সাড়া দিলেন মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার নজীর আহম্মদ। জাসদ রাজনীতির কারণে নোয়াখালী থেকে শুরু করে ঢাকা পর্যন্ত অনেকের ভাগ্যের রাতারাতি পরিবর্তন ঘটেছে।
নোয়াখালীর মুক্তিযোদ্ধা তে বটেই, তখনকার সময়ে নোয়াখালীসহ সারা দেশে যারা জাসদ রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন, এমন লোক খুবই কম পাওয়া যাবে যারা ইঞ্জিনিয়ার নজীরের নাম অন্তত একবারও শুনেননি। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সেই অনাগত সন্তান আজ যুবক, তরুণী স্ত্রীও বৃদ্ধপ্রায়। যে আদর্শ কিংবা বিপ্লবের জন্য ইঞ্জিনিয়ার নজীর মুক্তিযুদ্ধের পর লোভনীয় সরকারি চাকরিতে যোগ না দিয়ে ঘর ছেড়েছেন সেই বিপ্লব কিংবা বিপ্লবে-উদ্বুদ্ধকারী নেতাদের আজকের চরিত্র দেখে হিসাব মেলাতে পারেন না এই মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী-সন্তানেরা। টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে কাটানো ৩৬ বছরের পুরনো স্মৃতি এখন তাদের কাছে নিত্যনতুন নানা প্রশ্নের উদ্রেক করে। যেসব কথাই নিচে তুলে ধরতে চাই।
এক.
১৯৭৫-এর ১০ জুলাইয়ের পর ৩৪ বছর কেটেছে কোনো দিন স্বামীর মৃত্যু কিংবা হত্যাকা- নিয়ে কোনো প্রশ্ন শোনা যায়নি মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার নজীরের স্ত্রীর কণ্ঠে। নিজের সুখ পায়ে ঠেলে বুকে পাথর চাপা দিয়ে সন্তানদের আগলে রেখেছেন তিনি। ২০০৯-এর ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের ঘটনায় হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার ঐতিহাসিক রায় ঘোষণার পর সেই পাথর কিছুটা যেন নড়ে চড়ে উঠে।
ঝাপসা হয়ে আসা একটি চিঠি হাতে নিয়ে অঝোরে কেঁদে চলেছেন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা নজীরের স্ত্রী। মৃত্যুর কিছুদিন আগে এই চিঠিটি লিখেছিলেন নজীর আহম্মদ। স্ত্রীকে লেখা সেই চিঠির একটি অংশ হচ্ছে : ‘হয়তো উপলব্ধি করতে পারছো অন্যায়ের বিরুদ্ধে শুধু দু’টা কথা বলাতে আজ আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা। চৌকিদার, দফাদার, কয়েকজন আওয়ামী লীগার আমাকে ধরে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগছে। পুলিশ সব সময় পিছু ধাওয়া করছে। অনেক চেষ্টা করেও মার সাথে একটু দেখা করতে পারি না। মা তোমাদের জন্য কান্নাকাটি করেন। বহুদিন থেকে বাজারে এবং রাস্তাঘাটে উঠতে পারি না। তুমি- জিনিসের জন্য বলেছ, সময় পেলেই পাঠিয়ে দেব। ’ কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার নজীর আর ফেরেননি।
’৭৫-এর অনাগত সন্তানটি আজ সাংবাদিক। তাই ৩৫ বছর পর সেদিন কান্নারত অবস্থায়ই ছোট ছেলেকে উদ্দেশ্য করে ইঞ্জিনিয়ার নজীরের স্ত্রীর প্রশ্ন : ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদেও তো এতদিন পর বিচার হলো, তাহলে তোর বাবার হত্যাকা-ের বিচার হবে না?’ ছেলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাকে সান্ত¡না দিতে এক কথায় উত্তর দেয়, ‘বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের জন্য তাঁর সন্তান শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হতে হয়েছে, তোমার ছেলে প্রধামন্ত্রী হবে না, আর তোমার স্বামীর হত্যার বিচারও হবে না’। মা এই উত্তরে আপাতত সান্ত¡না পেলেও তাঁর মনে থেকে যায় গভীর ক্ষত।
কারণ চট্টগ্রাম বন্দরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ইঞ্জিনিয়ার নজীরের চাকরির সুযোগ অবারিত থাকলেও আবেগপূর্ণ রাজনীতি তাঁকে নিয়ে গেছে মৃত্যুর দুয়ারে। সদ্য স্বাধীন দেশে কথিত বিপ্লব করতে গিয়ে যদি মেধাবী মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার নজীরের মৃত্যু না হতো তাহলে হয়তো এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী কিংবা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর মতো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দু বছর বেশি চাকরির সুযোগ পেতেন। অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়াতে হতো না তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের। আর চরম অবহেলার শিকার হতে হতো না জাসদ নেতৃত্বের।
দুই.
মুক্তিযোদ্ধা নজীরের সেই অনাগত সন্তান আমি। ২০০৩ সালের ৩০ এপ্রিল নোয়াখালী থেকে আমার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক চলমান নোয়াখালী প্রকাশিত হবার পর উদ্বোধনী সংখ্যার একটি কপি হাতে পেয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে কদিন পর আমাকে চিঠি লিখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রক্টর, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. গাজী সালেহ উদ্দিন। সেই চিঠির একটি অংশে তিনি লেখেন : ‘বেশ কয়েকদিন পূর্বে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে বাংলাদেশের কিংবদন্তী রাজনৈতিক নেতা সিরাজুল আলম খানের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। ব্যক্তিগতভাবে পূর্বপরিচয় ছিল না। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে তাঁর অনুসারীদের মাধ্যমে পরিচয় ঘটলো। স্বাভাবিকভাবে যাত্রাপথে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি, জাসদের গণবাহিনী ইত্যাদি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করছিলাম। গণবাহিনী গঠন তাদের কার্যক্রম, বিশেষ করে তোমার বাবা নজীর ভাইয়ের মৃত্যু, তোমার পরিবারের অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে। এ ব্যাপারে আমার ভূমিকা ছিল কিছুটা আক্রমণাত্মক, কারণ নজীর ভাই শুধু আমার আত্মীয় নন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো তাঁর সান্নিধ্যে আসার। তাঁর চিন্তাচেতনা সমগ্র দেশে খেটে খাওয়া আপামর জনগণের উন্নয়ন-কল্যাণকে নিয়ে আবর্তিত হতো। তাঁর মতো সাহসী মুক্তিযোদ্ধা খুবই কম দেখেছি। আমার বক্তব্য ছিল একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রে মেধাবী ছাত্র-যুবককে একত্র করে স্বল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত গণবাহিনী গঠন নিয়ে নিয়মিত সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ করাটা কতটা যৌক্তিক। সিরাজুল আলম খানের বক্তব্য ছিলÑ সকল বিপ্লব সফল হয় না, তবে বিপ্লব করতে গেলে কিছুটা রক্ত ঝরবেই। ’
রক্ত সিরাজুল আলম খানের ঝরেনি, ঝরেনি আ স ম রব কিংবা হাসানুল হক ইনুদের। অগণিত জাসদ নেতা-কর্মীর রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে বিপ্লব নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা কতটুকু যৌক্তিক? মনে হয় সময় এসেছে বিপ্লবতত্ত্বের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনারও, যেভাবে চলতি বছরের শুরুর দিকে আমাদের গণমাধ্যম এবং বিচারালয়ের মাধ্যমে কর্নেল তাহের হত্যা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্কের অবসান হয়েছে।
কারণ আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যখন দমন-পীড়ন করেন কিংবা জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলেন তখন ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ নেতা-কর্মীদের কথা মনে রাখেন না। যারা স্বজন হারান তারাই বোঝেন এর মূল্য কতটুকু।
শেষ.
লেখার এক পর্যায়ে উল্লেখ করেছিলাম ’৭৫-এ দেশে যারা জাসদ রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন, তাদের অনেকেই ইঞ্জিনিয়ার নজীরের নাম জানতেন। কেউ ব্যক্তিগতভাবেও চিনতেন। কিন্তু কথা রাখেননি জাসদ নেতৃবৃন্দ।
কোনোমতে শিক্ষাজীবনের পাঠ চুকিয়ে যখন আমি আর আমার ভাই ছুটে গিয়েছিলাম জাসদ অফিসে, তখন কেউ এগিয়ে আসেননি সহযোগিতা নিয়ে। একটি চাকরির জন্য তৎকালীন মন্ত্রী আ স ম আবদুর রবের কাছে দেখা করতে গেলে তিনি কথা বলার সময়ও পাননি। তখন জাসদ ঐক্যবদ্ধ।
তখন বার বার মনে হয়েছে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে নিহত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের পরিবারের অবস্থাও নিশ্চয় একই রকম।
২০১০ সালের ১০ জুলাই সকালে আমার মুঠোফোনে হঠাৎ করে একটি ফোন আসে। অপরিচিত নম্বর। অপর প্রান্ত থেকে নারীকণ্ঠ বলছেন, ‘রুদ্র আমি ঢাকা থেকে শিরিন আখতার...কোনো জাবাব পেয়ে তিনি বলেই চলেছেন আমি শিরিন ফুপু...তোমার শিরিন ফুফু...। ’ কয়েকবার বলার পর বিশ্বাস হচ্ছিল এখনো আমাদের কেউ খবর রাখেন! অপর প্রান্ত থেকে জাসদ নেত্রী শিরিন আখতার দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আমাদের কী করার আছে। আমরা তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি.....
জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছি। বেড়ে ওঠার প্রতিটি পদে পদে মানুষের কাছে শুনেছি মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী নানা কীর্তির কথা। যে রাজনীতি বাবাকে দেখার সুযোগ থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছে সেই রাজনীতি কখনো টানতে পারেনি আমাদের দুই ভাইকে। তবে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আচরণ এবং নেতা-কর্মীদের প্রতি দায়বোধ কষ্ট দেয় প্রতিটি মুহূর্তে। ইতিহাসের জঘন্যতম সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- নিয়ে শেখ হাসিনা কিংবা ১/১১-র পরবর্তী সময়ে রিমান্ডে নির্যাতনে অসুস্থ তারেক রহমানকে পিজি হাসাতালে দেখতে গিয়ে খালেদা জিয়া যে অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন তা দেখে কিছুটা বিস্ময় জাগে মনের ভেতর। কারণ নিজেদের স্বজন নিয়ে তাঁদের যে কান্না, ১৫ কোটি মানুষের জন্য তাদের এমন কাঁদতে দেখা যায় না।
কষ্ট লাগে, যে পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধা নজীরকে ঘায়েল করতে পারেনি অস্ত্র দিয়ে, সেই নজীর আহম্মদ মারা গেলেন স্বাধীন দেশের মাটিতে। হয়তো ’৭৫-এর ১০ জুলাই রক্ষীবাহিনীর যে সদস্য তাঁকে গুলি করেছেন তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কষ্ট লাগে যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা উড়াতে গিয়ে আমার বাবার নির্মম মৃত্যু হলো, সেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের বেহাল দশা দেখেও।
আশা করি আমাদের নেতৃবৃন্দ জনগণের সামনে তত্ত্ব তুলে ধরার ক্ষেত্রে শুধু এক্সপেরিমেন্টের জন্য নয়, কল্যাণের দিকটিও বিবেচনায় রাখবেন আগামী সময়ে।
বাবার মৃত্যুদিনে বাবাকে না দেখা এই সন্তানের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক চলমান নোয়াখালী
[email protected]