প্রয়াত জাসদনেতা ইঞ্জিনিয়ার নজীর আহম্মেদকে নিয়ে গত ৯ জুলাই বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম- এর মুক্তমত কলামে প্রকাশিত তার ছোট ছেলে রুদ্র মাসুদের ‘একটি ব্যর্থ বিপ্লব এবং আমার না-দেখা বাবা’ শিরোনামে লেখাটি পড়লাম। জন্মের আগেই পিতাকে হারানোর যে কষ্ট নিয়ে রুদ্র বড় হয়েছেন, জানি সে কষ্টের সঙ্গে অন্যকোনো কিছুরই তুলনা হয় না।
লেখাটিতে রুদ্র একটি রাজনৈতিক দর্শন ও ওই রাজনৈতিক দর্শনের অনুসারীদের প্রতি যেভাবে একতরফা বিষোদগার করেছেন, তাতে তিনি কিছু প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছেন। যে প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়তোবা রুদ্রর কাছে রয়েছে।
প্রথমত: রুদ্রর ভাষায় ‘বুকে বিপ্ল¬বের মন্ত্র, পকেটে চট্রগ্রাম বন্দরে চাকরির নিয়োগপত্র আর ঘরে তরুণী স্ত্রী, দেড় বছরের সন্তান এবং স্ত্রীর গর্ভে অনাগত সন্তান’ এই সব কিছুর মধ্যে তার পিতা ইঞ্জিনিয়ার নজীর বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় জনগণের অংশিদারিত্ব নিশ্চিত করার জন্য রাজনীতিকে বেছে নিয়েছিলেন। এমন একজন খাঁটি বিপ্লবীর ছেলে হিসেবে রুদ্রর তো পিতার আদর্শকে নিয়ে অহংকার করার কথা। কিন্তু নিজের পিতা ও তার রাজনৈতিক দর্শনকে নিয়ে রুদ্রর লেখায় উঠে আসা হতাশা ও হাপিত্যেস বিপ্লবী পিতার প্রতি ছেলের অবিচার কিংবা রুদ্র নিজে যে নামটি ধারণ করে আছেন, সেই নামের অমর্যাদা নয় কি?
দ্বিতীয়ত: রুদ্রর ভাষায়, ‘অনেকের মতো কেন্দ্রীয় নেতাদের শেখানো কথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শকে বুকে আগলে রাখতে গিয়ে তার পিতা ইঞ্জিনিয়ার নজীর রক্ষীবাহিনীর গুলিতে নিহত হন’। কিন্তু আমার জানা মতে ইঞ্জিনিয়ার নজীর অনেকের মতো সাধারণ মাপের রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না। তিনি ছিলেন নোয়াখালী অঞ্চলে জাসদের প্রথম সারির নেতা এবং গণবাহিনীর একজন সক্রিয় সংগঠক। কাজেই আমার বিশ্বাস, কারো শেখানো আদর্শের কারণে নয়, বরং নিজের শিক্ষা, দেশপ্রেম ও গণমানুষের প্রতি অঙ্গীকার ইঞ্জিনিয়ার নজীরকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ঠিক একই কারণে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শকে লালন করে তিনি গণমানুষের অধিকার আদায়ের আরেক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর নীতির প্রশ্নে কোনো আপস করেননি বলেই সুবিধাবাদীদের গুলিতে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। কারণ কোনোভাবেই সশস্ত্র সন্ত্রাসী নয়, ইঞ্জিনিয়ার নজীর ছিলেন সশস্ত্র বিপ্ল¬বী। আর প্রতিষ্ঠিত এই সত্যকে আড়াল করে নিজের অজান্তে রুদ্র কি তার বিপ্ল¬বী পিতার মহিমাকে ম্লান করছেন না?
তৃতীয়ত: রুদ্র তার লেখায় ‘জাসদ রাজনীতির কারণে নোয়াখালী থেকে ঢাকা পর্যন্ত অনেকের ভাগ্যের রাতারাতি পরিবর্তন ঘটেছে’ বলে উল্লে¬খ করেছেন। যদিও রুদ্রর নিজের বাড়ির পাশে জাসদ থেকে দুই দুই বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানসহ অসংখ্য জাসদ নেতার সততার কথা নোয়াখালীসহ গোটা দেশের মানুষের আলোচনায় রয়েছে। এসব নীতিবান রাজনীতিকদের একজনের কথাও রুদ্রর লেখায় আসেনি। মন্ত্রী থাকার সময় আ.স.ম রবের সঙ্গে চাকরির বিষয়ে কথা বলার জন্য দেখা করতে না পারার বিষয়টি রুদ্রর মনে দাগ কেটেছে। কিন্তু অন্যদিকে জাসদের প্রতিষ্ঠাকালীন সহ-সভাপতি কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমের মতো অসংখ্য জাসদ নেতার আত্মত্যাগের পর শত কষ্টের মধ্যে থেকেও ওইসব পরিবারের কাউকে তো জাসদ বা জাসদ নেতাদের চরিত্র নিয়ে কথা তুলতে শোনা যায়নি। রুদ্র মন্ত্রী আ. স. ম রবকে চিনলেন আর তার পিতার মতো অন্য আর দশজন বিপ্লবীর পরিবারকে চিনলেন না। তার মানে রুদ্রর সঙ্গে কেবল জাসদের সুবিধাভোগীদেরই পরিচয়!
চতুর্থত: রুদ্রর কথায় ‘জাসদ নেতারা না হয় ক্ষমতা আর হালুয়া রুটির ভাগাভাগির জন্যে আওয়ামী লীগের আচলের নিচে ঠাঁই নিলেন’। কিন্তু রুদ্র নিজের পিতার রাজনৈতিক দর্শন ও গণবাহিনী নিয়ে এত সমালোচনা করলেও যে রক্ষিবাহিনীর গুলিতে ইঞ্জিনিয়ার নজীরকে প্রাণ দিতে হয়েছে, সেই বাহিনী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিষয়ে রুদ্রর কণ্ঠ এতটা ম্রিয়মান কোন কারণে? রুদ্র কি জানেন, রক্ষীবাহিনী আগে হয়েছে, নাকি গণবাহিনী আগে গঠিত হয়েছে?
পঞ্চমত: রুদ্রর কথায় ‘বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের জন্য তার সন্তান শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হতে হয়েছে। ’ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- শেখ হাসিনা চরম দুঃসময়েও পিতার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি, আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে যাননি বলেই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তাছাড়া শেখ হাসিনা কিংবা তার পরিবার বরাবরই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। একইভাবে কর্নেল তাহেরের পরিবারও শুরু থেকেই শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও তাহেরের নির্মম হত্যাকা-ের বিচারের দাবিতে রাজনীতির ময়দানে ও বিচারালয়ে সংগ্রাম চালিয়েছে। রুদ্র অবশ্য তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, পিতার রাজনীতি তাদের দুই ভাইকে টানতে পারেনি। তাহলে পিতার রাজনীতি নিজেদের টানতে পারেনি বলেই কি রুদ্র পিতার হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয়ে সোচ্চার হচ্ছেন না? নাকি তাও কোনো বিপরীত রাজনৈতিক কারণে!
ষষ্টত: রুদ্র লিখেছেন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের বেহাল দেখে তার নাকি কষ্ট হয়! আর বুর্জোয়া কিংবা গণতন্ত্রের লেবাসধারীদের অবস্থা দেখে বুঝি তিনি বেশ আনন্দিত হন। এই গণতন্ত্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শুধু দু’টো কথা বলাতে ইঞ্জিনিয়ার নজীরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়, চৌকিদার, দফাদার ও দলীয় লোকজন তাকে ধরার জন্যে উঠেপড়ে লাগে!
অষ্টমত: বিপ্লবে নাকি সিরাজুল আলম খান, আ.স.ম রব. হাসানুল হক ইনুদের রক্ত ঝরেনি বলে রুদ্র লিখেছেন। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে, লড়াই সংগ্রামে উল্লেখিত তিন নেতাসহ জাসদের অনেক নেতারই অনেক রক্ত ঝরেছে। জীবনের বেশিরভাগ সময় তারা কারাগারে কাটিয়েছেন। তার মানে জাসদ রাজনীতির সঙ্গে দুরত্বের কারণে এসবের অনেক কিছুই রুদ্রর অজানা!
নবমত: রুদ্র কোনটাকে ব্যর্থ বিপ্লব বলছেন জানি না। কৌশলগত কারণে বিপ্ল¬বে দ্রত সফলতা না আসার অর্থ কি ব্যর্থতা? বিপ্লব তো একটি চলমান প্রক্রিয়া। ব্যক্তিগত পাওয়া না পাওয়ার সূচকে কি বিপ্লব কিংবা বিপ্ল¬বীর সাফল্য-ব্যর্থতা পরিমাপ করা যায়?
দশমত: রাষ্ট্র ক্ষমতায় জনগণের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদ যে সংগ্রামের সূচনা করেছে, সেই সংগ্রামে ইঞ্জিনিয়ার নজীরের মতো হাজারো বিপ্লবী জীবন দিয়েছেন। অনেকে জেল-জুলুম নির্যাতন ভোগ করে বেঁচে আছেন। লড়াইটা কিন্তু থামেনি। সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, পুঁজিবাদ ও অসম বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে ইঞ্জিনিয়ার নজীরের উত্তরসূরীদের লড়াই-সংগ্রাম কিছুই দেখছেন না রুদ্র।
শেষ: দেশে হাজারো ইঞ্জিনিয়ারের জন্ম হয়েছে। তাদের অনেকে স্বাভাবিক নিয়মে মারাও গেছেন। কিন্তু রুদ্রর পিতা ইঞ্জিনিয়ার নজীরের মৃত্যু ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। ইঞ্জিনিয়ার নজীর আহম্মেদ ইতিহাস হয়ে আছেন তার দেশপ্রেম, আদর্শিক রাজনীতি ও আমৃত্যু দ্রোহী চেতনার কারণে। আমার তো মনে হয়, এটাই রুদ্রর জন্য বড় সান্ত¡না। আর রাজনৈতিক দর্শন তো একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে অনেক মানুষের সম্মেলন ঘটে। এর মধ্যে কেউ কেউ আদর্শচ্যুত হতেই পারেন। তাতে পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলা কতটা যৌক্তিক তা-ও প্রশ্নের দাবি রাখে।
যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ঝাণ্ডা ওড়াতে গিয়ে রুদ্রর বাবা ইঞ্জিনিয়ার নজীর নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, ছেলে হয়ে সেই তত্ত্বের শত্রুদের সুরে কথা না বলে বাবার ওই আদর্শের ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখতে রুদ্রর ইতিবাচক মনোভাবই আমাদের প্রত্যাশা।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, মৃত্যুঞ্জয়ী ইঞ্জিনিয়ার নজীর লাল সালাম।
. লেখক: সদস্য, জাতীয় যুবজোট, কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১১