১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হওয়ার আগে বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। বর্তমান পাকিস্তানেরই অংশ, তখন তাদের পশ্চিম পাকিস্তান বলা হতো।
তেজি, অসীম সাহস, দূরদর্শিতা, দেশপ্রেম, মানুষকে বুঝার অতি মানবিক গুণাবলী আর ত্যাগের অসামান্য মহিমা তার আসল নামটি সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিতি পায় ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে।
স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন তিনি। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তান নামের অঞ্চলটি যখন বাংলাদেশে রূপ নেয় তখন তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। মুক্তি পেয়ে বিজয়ের ২৫ দিন পর দেশে ফিরে তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। তখন তার বয়স ৫৫ বছর।
তার সমসাময়িক ছিলেন এশিয়ার দুই আধুনিক রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের জনক প্রয়াত রাষ্ট্রপতি লি কুয়ান ও মালয়েশিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি মাহাথির মোহাম্মদ। লি কুয়ান মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে।
মাহাথির এখনও বেঁচে আছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়েছিল তখন মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক চেহারা ছিল বাংলাদেশের মতোই হতদরিদ্র। এই দুই দেশ থেকে কিছুটা এগিয়েছিল লি কুয়ানের সিঙ্গাপুর। এখন তুলনামূলক অথনৈতিক চিত্র হলো এরকম: সিঙ্গাপুরের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৫৬ হাজার ২৮৬ মার্কিন ডলার, মালয়েশিয়ায় ১২ হাজার ৭০০ মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৩১৬ ডলার। মাত্র দুই বছর আগে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১১৮০ ডলার।
তিন দেশের মধ্যে আকাশ-পাতাল অর্থনৈতিক ব্যবধান। জীবনযাত্রা, সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা, উন্নয়ন, যাতায়াত, পর্যটন, ব্যবসাবাণিজ্য আর শিল্পায়নে চোখ ধাঁধানো অগ্রগতি সিঙ্গাপুর- মালয়েশিয়ার। যোগ্য নেতৃত্বের কারণে তারা এগিয়ে গেল, আমরা পিছিয়ে পড়লাম। লি কুয়ান প্রায় ৪০ বছরেরও বেশি সময় শাসন করেছেন সিঙ্গাপুরকে। আর ২২ বছরের শাসন মাহাথিরের। আমাদের পিছিয়ে পড়ার কাহিনী ট্র্যাজেডিতে ভরা। সেই ট্র্যাজেডিরও মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
সপরিবারে তাকে নশংসভাবে খুন করে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী অফিসার। নির্মম সেই হত্যার পরের কাহিনী আরও দুর্ভাগ্যজনক। সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও নানা কারণে পুরো বাহিনী্র অবস্থান তখন খুনিদের পক্ষেই ছিল। বঙ্গবন্ধুর নিজের দলের কেউ কেউও সেই দলে ভিড়ে গেলেন।
বিদেশে অবস্থান করায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬। মাঝখানে ব্যবধান ২১ বছর। এই ২১ বছর পরে বঙ্গবন্ধুর গড়া দল তার মেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। পাঁচ বছর পরের নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় বিএনপি। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল তারা। মাঝখানে দুবছর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ে আবার শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসে। তৃতীয় মেয়াদে এখনও তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ টানা ৮ বছর। এই ৮ বছরে আমাদের দেশের বাজেটের পরিধি বেড়েছে। বিদেশি সাহায্যনির্ভরতা কমেছে।
শিক্ষায় অগ্রগতি হয়েছে। রিজার্ভ বেড়েছে। রপ্তানি আয় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্প পুরো বিশ্বকে শাসন করার জায়গায় পৌঁছতে শুরু করেছে। জনশক্তি রপ্তানির বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ এখন অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অনেক স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগে ঘাতকের বুলেট তাকে নি:শেষ করে দেয়। অথচ তার সমসাময়িক দু্ই নেতা লি কুয়ান ও মাহাথির মোহাম্মদ তাদের দেশকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেলেন শুধু বেঁচে থাকার কারণে। উন্নয়নের এই দুই সুপারস্টারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বয়সের ব্যবধান ছিল মাত্র ৫ বছর। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এখন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার প্রাণপ্রিয় আদরের মেয়ে শেখ হাসিনা। তার সামনেও অনেক ঝুঁকি। বিগত ২৮ বছরে মৃত্যু তাকে ছুঁয়ে গেছে বারবার, তা-ও দমে যাননি। সাহস তার বাবা বঙ্গবন্ধুর মতোই। দেশ আর মানুষের কল্যাণে জীবন তার উৎসর্গ করা। তিনিও চান বাংলাদেশ এগিয়ে যাক, অন্য দেশকে ছাড়িয়ে যাক।
এটি তার কথায়-বক্তব্যে প্রায় ফুটে উঠে। অন্যদের ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য নিজের কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রেও অনেক কৌশলী হতে হচ্ছে তাকে।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তিনটি নিবেদন করতে চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। আজ ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ৪১ তম মৃত্যুবার্ষিকী। শোককে শক্তিতে রূপান্তর করার মন্ত্রণাও পাওয়া দরকার। আন্তরিকতা, নিষ্ঠা আর ত্যাগের অসাধারণ গুণাবলী থাকারও পরও অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে না পারায় কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা স্বপ্ন বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়েছি। তাই তিনটি বিশেষ প্রস্তাব আমার এই শোকের দিনে।
এক. বিশ্বের অন্যতম সভ্য এবং উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত সুইডেনের বিমানবন্দর থেকে রাজধানী স্টকহোম যেতে গাড়ি ছাড়া রাস্তায় হাঁটা কিংবা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কোন জনমানবের চিহ্ন দেখা যায় না। তাদের জন্মহারও খুব কম। ফলে সেখানে জনশক্তি রপ্তানির বাজার কি আছে সেটি পর্যবেক্ষণ আর যাচাই করা দরকার। শুধু সুইডেন নয়, ইউরোপ-আমেরিকা- মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই জনশক্তির বাজার বিস্তৃত ও সম্প্রসারিত হচ্ছে। সেই বাজারে এখনও একক আধিপত্য প্রতিবেশী ভারতের। তাদের কূটনীতিক লেভেল আমাদের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয়। মধ্যপ্রাচ্যের কুয়েত- কাতার-সৌদিআরব- আরব আমিরাতের শ্রমবাজারেও ভারত এগিয়ে। পাইপমিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ান, ড্রাইভার, সেলসম্যান সব জায়গায় ভারতীয় নাগরিক। তাদের ইংরেজি ভাষাজ্ঞান আমাদের তুলনায় অনেক ভাল। কম্পিউটারেও তারা দক্ষ।
দুই. এসব গুরুত্বপূর্ণ দেশে যারা বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পান তাদের অনেকেরই কোন স্বপ্ন থাকে না, থাকে না দেশ নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষাও। দূতাবাসে যারা কাজ করেন তাদের অনেকেই জড়িয়ে পড়েন আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে। সেখানে বসবাসরত বাঙালি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন অকারণে। অথচ সেইসব দেশের শ্রমবাজারে অসংখ্য বাংলাদেশিদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে তাদের তৎপরতা খুব কমই চোখে পড়ে।
তিন: দেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার সময় কিংবা বিদেশ থেকে দেশে আসার পর বাংলাদেশের বিমানবন্দর কর্মীদের বিশেষ করে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের অতি উৎসাহ প্রবাসীদের মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অকারণে তারা সময় নষ্ট করে। গণহারে ব্যাগেজ তল্লাশি করে। ইমিগ্রেশনে এমন সব স্টাফ দেয়া হয় যারা একজনের পাসপোর্ট দেখে ছাড় করতে অনেক বেশি সময় নেয়।
ইমিগ্রেশন আইনও অনেকে জানেন না। কম্পিউটার জ্ঞানও তাদের সীমিত। প্রতিবেশি ভারতের কলকাতায় যেখানে একজন পর্যটককে এক থেকে দুই মিনেটের মধ্যে ইমিগ্রেশন স্টাফ ক্লিয়ারেন্স দেয় সেখানে আমাদের লাগে মিনিমাম পাঁচ থেকে সাত মিনিট।
বিশ্ববাজারে অর্থনীতির অন্যতম শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পাঁচ বছরের একটি বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া যেতে পারে। ৬৪ জেলায় ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে পাইপিমিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ান, ড্রাইভারসহ দক্ষ জনশক্তি গড়া যেতে পারে। একইসঙ্গে শেখানো যেতে পারে ইংরেজি ভাষাজ্ঞানও। বিমানে চড়ার কায়দাকানুনও তাদের শিখিয়ে দেয়া যায় অনায়াসে। এই পাঁচ বছরে দক্ষ জনশক্তি গড়ার পাশাপাশি বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস-মিশনগুলোকেও সরকারের স্বপ্ন আর ইচ্ছার কথা জানিয়ে দিয়ে আগের তুলনায় শক্তিশালী করা উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৫৬ হাজার মার্কিন ডলার থেকে ১৩ হাজার ডলারের ব্যবধান অনেক। আর এক হাজার তিনশ ডলার একেবারেই নগন্য। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতোই অর্থনৈতিক গতির যাত্রী হতে চায় বাংলাদেশও। দ্রুত বিকাশমান সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার অর্থনীতির চালক ছিলেন দুই রাজনৈতিক শক্তিধর দূরদর্শী মেধাবী নেতা লি কুয়ান ও মাহাথির মোহাম্মদ। সেটি টানা নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পাওয়ারই সুফল। আমাদের তো মহান নেতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, আমরা এগুবো কোনদিকে, কোনপথে? আমাদের নতুন দিশা, নতুন স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার এখন এক মোক্ষম সময়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ছায়া তারই কন্যা শেখ হাসিনার মাঝে উদ্ভাসিত। বাবার মতোই তিনি পুরোদমে বাঙালি। দেশকে ভালবাসেন। মানুষকে বোঝার অসাধারণ ক্ষমতা তার। সাহসী, উদার, স্বাপ্নিক শেখ হাসিনার দয়া-মায়া- মমতার অনেক নিদর্শন জানেন যারা তাকে কাছ থেকে দেখেছেন। এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছ থেকে গল্প শুনেছিলাম, উত্তরবঙ্গ সফর শেষে গভীর রাতে ঢাকায় ফিরে সফরসঙ্গী সংবাদকর্মীদের নিজ হাতে রান্না করে খাইয়েছিলেন শেখ হাসিনা। না খেয়ে
ফিরে যেতে চাইছিলেন সাংবাদিকরা। তাদের থামিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, অত রাতে কোথায় খাবার পাবে, কে খাওয়াবে?
রফিকুল বাহার: আবাসিক সম্পাদক, একুশে টেলিভিশন, চট্টগ্রাম। [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৬
জেডএম/