মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। চিঠির শুরুতেই কয়েকটা গল্প বলি।
১. গ্রামে বড়লোকদের বাড়িতে ঘর-দোর পরিচ্ছন্ন ও কাপড়-চোপড় পরিষ্কারের কাজ করেন স্বামীহারা রাবেয়া বানু। তার ছেলেটা দেখতে দেখতে ইন্টারমেডিয়েট শেষ করে ফেলেছে। ঢাকার কী একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পাসও করে ফেলেছে। কিন্তু রাবেয়া যে বাড়িতে কাজ করেন, সে বাড়ির ছোটসাহেব বললেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নামে ওই প্রতিষ্ঠানে পড়তে গেলে অনেক টাকা লাগবে। ভর্তি হতেও টাকা, আবার সাড়ে ৪ বছর থেকে ৫ বছর পর্যন্ত বাসাভাড়া, খাওয়া ও নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচও লাগবে। অর্থাৎ মাসে অন্তত ৪-৫ হাজার টাকা। ছ’মাস পর সেটা ৭-৮ হাজার টাকাও ছুঁয়ে যেতে পারে। ছোটসাহেবের কথায় রাবেয়া বানু মুষড়ে পড়লেন। অথচ তাদেরই গ্রামের মাস্টারের বড় ছেলেটা বলেছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ সবাই পায় না, আপনার ছেলে সোনার টুকরো। সে সুযোগ পেয়েছে। দেখেন কী করা যায়!’ রাবেয়া বানুর স্বামীও তার জন্য কিছু রেখে যাননি যে সেটা বিক্রি করে হলেও ছেলেকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেবেন। কেউ তথ্য জানালো, কেউ সাহসও দিলো। কিন্তু এগিয়ে এলো না কেউই। রাবেয়া বানুর ছেলেটা এখন পড়ে উপজেলার কী একটা ডিগ্রি কলেজে। ফাঁকে বাজারের একটা দোকানে কাজ করে।
২. কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার পর অসীম পাস করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেধাতালিকায় সিরিয়ালও বেশ সামনের দিকে। বড় ভাইয়েরা বললেন, সে আইন বিষয় পাবে। পেলোও। তার শৈশবের স্বপ্ন, নিজের নামের সঙ্গে জজ যুক্ত হবে। লোকজন তাকে জজসাহেব ডাকবে। তার মা-বাবাকে সবাই জজসাহেবের মা-বাবা বলে চিনবে। কিন্তু বড় ভাইয়েরা বলতে থাকলেন অনেক পড়াশোনা করতে হবে। এদিক-ওদিক তাকানো যাবে না। অসীমের মাথায় চিন্তা ভর করে। সেতো ভর্তির আগে মা-বাবাকে বলেছিল, টিউশনি করে নিজের খরচ নিজে চালাবে। তার চিন্তা করতে হবে না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যা দেখছে, বাসাভাড়া, খাওয়ার খরচ, নিয়মিত ফি, অ্যাসাইনমেন্টের কাজে খরচ। এতো খরচ সে যোগাড় করবে কোত্থেকে? বড় ভাইয়েরা বলছেন সাধারণ পড়াশোনায় কুলিয়ে ওঠা যাবে না! পড়তে হলে সময় বের করতে হবে। টিউশনির পেছনে সময় গেলে পড়বে কখন? এরমধ্যে জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ এলো তার। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ বাবা চলে গেছেন না ফেরার দেশে! এখন মা আর ছোট ভাই-বোন দু’টো তার দিকে তাকিয়ে! অসীম ধীরে ধীরে জজসাহেব হওয়ার স্বপ্নটা ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়। সে মনোযোগ দেয় তার কোনোরকম পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া আর বাড়িতে কিছু টাকা পাঠানোর মতো উপার্জনের দিকে! খরচের ভার অসীমকে অনার্সও শেষ করতে দিলো না। সে জড়িয়ে গেল মধ্যম পর্যায়ের একটা চাকরিতে!
৩. ভর্তি পরীক্ষায় পাসের খবর শুনেই আশুতোষের বাবা বলেছিলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল নেই, সেখানে সব খরচ নিজের। সার্টিফিকেটটা কেবল সরকারি, বাকিসব বেসরকারি হিসাব। মধ্যবিত্ত লোকদের এই বেসরকারি হিসাবের পড়াশোনা না করলেও হবে। আশুতোষ বাবাকে জানায়, সে খবর নিয়ে দেখেছে, মাসে ২ হাজার আর ৬ মাস পর সেটা ৫ হাজার পর্যন্ত হলে চলবে। বাকিটা সে চালিয়ে নেবে। কিন্তু জগন্নাথে ভর্তি হয়ে আশুতোষ আর কূল পাচ্ছে না। টিউশনির জন্য অনেক দৌঁড়ঝাপ করেও হচ্ছে না, তার পড়ার সাবজেক্টটা অন্যদের তুলনায় একটু কম ভারী বলে। নিজের ব্যক্তিগত খরচ কমিয়ে পড়াশোনার খরচ যোগান দেওয়ার জন্য সে একসময় দু’বেলা ভাত খাওয়াও বন্ধ করে দেয়। এমনকি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় কখনো ফুসকা-ঝালমুড়ি খাওয়া হলে দুপুর বেলা একটা কলা খেয়েই মেসে এসে পড়ে। খাবারের এ অনিয়মে আশুতোষকে জন্ডিসে ধরে যায়। তাকে মেসের বড় ভাইয়েরা বাড়ি পাঠিয়ে দেন। নিজের শহরে ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখলো আশুতোষের হেপাটাইটিস বি জন্ডিস বেঁধে গেছে। মা-বাবা, আশুতোষ যেন অন্ধকার দেখতে থাকলো চোখে…
৪. তনিমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে এবং পড়াশোনা চালিয়ে যেতে মা-বাবা তাদের ভিটার পেছনের জায়গাটাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তাদের স্বপ্ন, মেয়েটা পড়াশোনা করে অনেক বড় কিছু হবে। তনিমা ঢাকায় এসে দেখলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে ওই ভিটে বিক্রির টাকা ঢাললেও তার পড়াশোনাটা নির্বিঘ্ন হচ্ছে না, খরচের বুলডোজার ক্রমেই তাকে পিষ্ট করে দিচ্ছে। মা-বাবার ওপর চাপ কমাতে সে টিউশনি পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করে। পায় না। একদিন সে অদ্ভূত এক সিদ্ধান্ত নিলো। সে যে বাসায় থাকে, সেখানে বুয়া রান্না-বান্না করে। তার জন্য বুয়াকে মাসে ২ হাজার টাকা দেওয়া হয়। তনিমা নিজেই রান্নার অর্থাৎ বুয়ার কাজ করতে প্রস্তাব দেয় বাসার বড় আপাদের, যেন ওই ২ হাজার টাকা তাকে দেওয়া হয়। আপারা প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে ওর বাস্তবতা বুঝে প্রস্তাব গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বান্ধবী-আপারা যখন ক্লাস শেষ করে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় ক্লান্তিতে, তনিমা লেগে যায় রান্না-বান্নায়। রাতে বান্ধবী-আপারা যখন মগ্ন থাকে পড়াশোনায় বা ল্যাপটপে নাটক-সিনেমা দেখায়, তনিমা তখন ঘাম ঝরায় রান্না-বান্নায়। তার বিসিএসের পড়াশোনা যে একসময় লাটে উঠতে শুরু করে, বাস্তবতার দেয়ালে তা আর দেখা হয় না তনিমার।
৫. ক্লাস শেষে গাড়িতে বাসায় ফিরছিলো মজিদ। গাড়ি তার গন্তব্য বরাবর এলে নামতে যায় সে, কিন্তু পেছনে আরেকটি প্রতিদ্বন্দ্বী গাড়ি আসছে বলে হুট করে টান দেয় মজিদের গাড়িটি। মজিদ পা ফেলে পারে না। বেশ কিছু দূর তাকে হেঁচড়ে নিয়ে যায় ঘাতক বাসটি। …বাড়িতে খবর আসে। তাদের মজিদ আর নেই। মা-বাবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ভাই-বোনেরা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এই মজিদ পড়াশোনা শেষ করে সব অভাব ঘোচাবে- এমন স্বপ্নে তার খরচ যোগাতে ভিটেটা পর্যন্ত বন্ধক দিয়ে রেখেছিলেন বাবা-মা…
৬. ক’দিন পরপর ভূমিকম্প হয়। অনিক থাকে আবার পুরনো ঢাকার কোনো একটি পুরনো বাড়িতে। সেজন্য মা-বাবার মন দুশ্চিন্তায় পড়ে থাকে সারাক্ষণ। এরমধ্যে সম্প্রতি যোগ হয়েছে জঙ্গি-সন্ত্রাসী ইস্যু। মেস-বাসাগুলোতে জঙ্গিরা আস্তানা গাড়ছে। জঙ্গি সন্দেহে অনেকে আটক হচ্ছে। রাত গড়ালেই অনিকের মা-বাবার কপাল যেন ঘামতে থাকে। রাতে কিছু হয়ে গেলো না তো? সকালে অনিককে ফোন দেন, বাবা নাস্তা করেছিস? অনিক বোঝে, ফোন নাস্তার খবর নিতে দেওয়া নয়, দুশ্চিন্তামুক্ত হতে। দুশ্চিন্তা করতে সে মানা করে, কিন্তু যতোদিন মেসে থাকবে ততোদিন কি আর মা-বাবার মন দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারবে?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এবার আমাদের আকুতির কথা বলি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৮০-৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী হতদরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ঘরের। এদের প্রায় সবার সংগ্রাম ওপরের ওই ছোটগল্পগুলোর মতো। কিন্তু এই গল্পকে ‘গুরত্বের’ সঙ্গে দেখার সময় কার আছে? কেইবা ভাববে এসব সত্যিই ‘গুরুত্বের’ সঙ্গে দেখা দরকার?
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব তার হল, হল উদ্ধার করে করেও ১০-১১ বছরে কিছু হয়নি, হল বানানো হচ্ছে হচ্ছে-ক্যাম্পাস বাড়ানো হচ্ছে হচ্ছে বলে ১০-১১ বছর গড়িয়ে যায়, বরাদ্দ পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস বৃদ্ধি এবং হল নির্মাণ না করে উপাচার্য (সাবেক) মহোদয়ের ব্যক্তিগত গাড়ি ক্রয় করা হয়- এমন কোনো অভিযোগ আমরা করবো না। আমরা আমাদের দুঃখ-কষ্টের গল্পগুলো আপনার সামনে তুলে ধরলাম।
আপনি চাইলে এমন হাজারো রাবেয়া বানুদের অভয় দিতে পারেন, তাদের ছেলেকে ভবিষ্যৎ জর্জ-ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে পারেন। আপনি চাইলে এমন হাজারো অসীম-আশুতোষ-তনিমাদের সংগ্রামটা কমতে পারে। আপনি চাইলে ক্লাস শেষে হলে যাওয়ার পরিবর্তে দূরের বাসায় যেতে গিয়ে অসংখ্য মজিদদের এভাব মারা পড়া বন্ধ করতে পারেন। আপনি চাইলে পারেন অনিক আর তার মা-বাবাকে একটি নিশ্চিন্ত ঘুমের রাত উপহার দিতে। সত্যিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার যে সুযোগ-সুবিধা থাকে, তা জগন্নাথে নিশ্চিত করে, আবাসিক ব্যবস্থাপনা এবং পড়াশোনার খরচের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা যারা জগন্নাথের জন্য হল চেয়ে, পড়াশোনার যথাসাধ্য সুযোগ সুবিধা চেয়ে আন্দোলন করছি, আন্দোলনে সমর্থন করছি, কারও পিটুনি খাচ্ছি-গালি শুনছি, তারা কি সেই হল দখল করবো? না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমরা আমাদের দুঃখ-কষ্ট-সংগ্রামের গল্প থেকে বুঝতে পারি, আমাদের পাশের ভাই-বোন-বন্ধু-বান্ধবীটা কেমন দুঃখ-কষ্ট করছে। আমাদের অনেকের পড়াশোনাও শেষ, তবু এ দাবি আদায়ে আজ আমরা আপনার দ্বারস্থ। কারণ আমরা চাই না, আমাদের কোনো ভাই-বোন-বন্ধু-বান্ধবী এভাবে দুঃখ-কষ্ট-সংগ্রামে মুষড়ে পড়ুক, তার স্বপ্ন ভাসিয়ে দিক, কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্ন আস্তে আস্তে নিঃশেষ হয়ে যাক।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, একজন নেতার সবচেয়ে বড় ঈর্ষণীয় প্রাপ্তি হলো, জনগণ সবাইকে অবিশ্বাস করলেও ওই নেতার ওপর আস্থা হারাবে না। কিছু অপ্রীতিকর হলেই মানুষ তার কাছে বিচার দেবে। তার কাছে সুরাহা চাইবে। বাংলাদেশে এখন যা ঘটছে, তার বিচার দেওয়া হচ্ছে বা তার সুরাহা চাওয়া হচ্ছে আপনার কাছে। আপনার এ গুণ বিশ্বের হাতেগোনা কয়েক নেতারই আছে। এই গুণ আপনি এমনি অর্জন করেননি, কাজে অর্জন করেছেন, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখিয়ে অর্জন করেছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা আপনার কাছে সেই আস্থা-বিশ্বাস-শ্রদ্ধার জায়গা থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সমস্যার সমাধান চাইছি। আমরা জানি, যে আমলাতান্ত্রিক ফাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন আটকে আছে, তা নিমিষেই উধাও হয়ে যেতে পারে আপনার এক ইশারায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের কাছে আপনার অবিসংবাদিত নেতৃত্ব আরও দৃঢ় অবস্থান করে নিক। আপনার কাছে জনগণের সুরাহা চাওয়ার জায়গা আরও সুপ্রশস্ত হোক।
লেখক
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী
ইমেলই: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৬