ক’দিন আগে সন্ধ্যায় কমলাপুর মসজিদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। এক টিভি মেরামতের দোকানের সামনে বেশ কিছু লোকের জটলা।
জানলাম সুলতান সুলেমান অসম্ভব জনপ্রিয় সিরিয়াল। যদিও এর আগে আমি এর নাম জানতাম না। বুঝলাম, কখন একজন পথচারী হাঁটা থামিয়ে রাস্তার পাশের দোকানে টিভি পর্দায় আটকা পড়তে পারে। কতোটা জনপ্রিয় হলে এটা সম্ভব হয়।
বোধহয় তার দু’দিন পরেই পত্রিকায় দেখলাম বাংলাদেশি কিছু অভিনেতা, নির্মাতা বা কৌশলী এসব বিদেশি সিরিয়াল প্রচারের বিরুদ্ধে ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা নিউজ দেখলাম ভারতীয় টিভিতে বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন বন্ধের দাবি তুলেছেন টিভি ফোরামের নেতারা (টিভি চ্যানেলের কর্তা ব্যক্তিগন)। টিভির লোক, মিডিয়ার লোক সহজেই সংবাদে কাভারেজ পান ভালো। তারা সহজেই তাদের ভালো না লাগার কথা বলে দেন। কিন্তু আমরা যারা দর্শক আমাদের বলার অনেক কিছু ভালো লাগে না।
আমাদেরও অনেক কথা থাকে। কিন্তু আমরা বলি না। আমার মনে হয় আমাদের কিছু বলা উচিত। বলা উচিত এসব নির্মাতারা যেসব অনুষ্ঠান বানান তা আমাদের হজমের অযোগ্য। এতোটাই মানহীন যে, আমরা দর্শকরাও একদিন টিভি মালিকদের বিরুদ্ধে, টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করা উচিত, তাদের শাস্তি চাওয়া উচিত। তারা আমাদের বস্তাপচা অনুষ্ঠান খাওয়াচ্ছে। এতে আমাদের রুচি নষ্ট হচ্ছে। হৃদয়ের জৌলুশ নষ্ট হচ্ছে।
সুলতান সুলেমান বা অন্য সিরিয়ালগুলো এদেশের দর্শকদের জীবনে নির্মল বিনোদন এনে দিয়েছে। দিয়েছে দু’দণ্ড শান্তি। যে সব নির্মাতা ও অভিনেতা এগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে তাদের লজ্জা হওয়া উচিত। তারা মেধা খাটিয়ে অনুষ্ঠান বানালে এটা হতো না। নিজেদের নপুংশকতার জন্য, নিজেদের অক্ষমতার জন্য ঘর থেকেই বের হওয়া উচিত নয় তাদের। তারা ভালো টিভি পণ্য বানাতে পারেন না। তাই বলে অন্যদের প্রোগ্রাম দেখানো যাবে না? তারা সম্ভবত ভুলে গিয়েছেন, এটা ইন্টানেটের যুগ। টিভিতে না দেখালেও ইউটিউবে দেখে নিতো। মানুষ বিনোদন চায়। বস্তাপচা সস্তা প্রোগ্রাম চায় না।
বাংলাদেশে যেসব প্রোগ্রাম হচ্ছে কয়টা মেধা খাটিয়ে বানানো হয়? একটাও না এই মুহূর্তে। সেই একই ট্যানট্যানানি প্রেম, ভাঁড়ামি, কিছু আঞ্চলিক ভাষার ডায়ালগ মিশিয়ে নাটক হচ্ছে। এছাড়া নতুন হচ্ছে কি? নাটকে বা সিরিয়ালে গল্প কই? নাটকে নাটকীয়তা নেই। সব নাটকের একই রেসিপি। অভিনেতা একই। একই চেহারা কতো ভালো লাগে?
কলকাতার মীরাক্কেলের অনুকরণে বাংলাদেশে একটা শো হয় দেখলাম। এদেশের এই অনুষ্ঠানের প্রেজেন্টেশন দেখলে দর্শক হিসেবে নিজেরই লজ্জা লাগে। রিয়েলেটির শোর নামে এদেশে অনেকে গেম শো, গান নাচ শো, দিদি-বৌদি শোও হয়। যাই দেখি, আমাদের মনে হয় আমরা বাংলাদেশিরা প্রেজেন্টেশান বুঝি না। কোনো উপস্থাপকই সাবলীল আনন্দ দিতে পারেন না। রসিকতা করতে পারেন না। রিয়েলিটি শো গুলাতে যেসব সেলিব্রিটিদের আনা হয় তারা হাসতে পর্যন্ত পারেন না। তাদের হাসি ঠাট্টা সব নকল। তাদের টাকায় কেনা ভাঁড় মনে হয়। প্রত্যেককেই। দর্শকরা খুব চালাক। এসব ধরে ফেলে। টিভি হলো ম্যাজিক বক্স। যে ম্যাজিক পাবলিক ধরে ফেলে তারা দেখবে কেন? তাই তারা দেখে না।
তাই বাংলাদেশের দর্শক এদেশের টিভি দেখে না। বিজ্ঞাপনদাতারাও এদেশের টিভিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এদেশের উৎপাদনকারীরা তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন বিদেশি চ্যানেলে নিয়ে যাচ্ছে। কেনই বা নেবে না। বরং এটাতে দু’টি লাভ। এক. পণ্যের বিদেশি বাজার ধরা যায়। দুই. দেশি বস্তাপচা প্রোগ্রামে স্পন্সর করে টাকা জলে না ফেলা। পাবলিক ঘুরে ফিরে সেই বিদেশি চ্যানেলই দেখে। অতএব দেশের চ্যানেলের চেয়ে বিদেশি চ্যানেলই উত্তম। যে সব চ্যানেল এর হর্তা ও কর্তারা এর প্রতিবাদে আন্দোলন করছেন তাদের বলি, আন্দোলনে যে সময়টা ব্যয় হবে সেটা ভালো প্রোগ্রামের জন্য ব্যয় করুন। তাতে মঙ্গল হবে। বিদেশি প্রোগ্রাম আর টিভি চ্যানেলকে হিংসা করে জ্বলে পুড়ে মরে লাভ কী?
ঘরে বসে ভাবুন, পাবলিক কেন আপনাদের চ্যানেল দেখবে। খবর, সব চ্যানেলেই দেখাচ্ছে আপনার চ্যানেলে আলাদা কি আছে। সব চ্যানেলই টক শো দেখায়, টক শোতে একই চেহারা, একই স্টাইলের নাটক, একই স্টাইলে গানের অনুষ্ঠান। বাংলাদেশে কোন বিশেষ চরিত্রের চ্যানেল নাই। সব চ্যানেল সংবাদ, টকশো, নাটক, গান, আর ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান এগুলো মিক্সড করে ২৪ ঘণ্টা দেখায়। এ কাজতো পাড়ার প্রাইভেট চ্যানেলও করে।
কখনো কি একবার ভেবেছেন, আপনার চ্যানেল বলতে দর্শক বুঝবে এটা খেলার চ্যানেল বা সিনেমার চ্যানেল বা মেগা সিরিয়ালের চ্যানেল কিংবা ধরুন আপনার টিভি বলতে দর্শক বুঝবে এখানে চমৎকার সব রিয়েলিটি শো হয়।
একবার ভাবুন, আপনার চ্যানেল কেন অন্যদের চেয়ে আলাদা করে পাবলিক দেখবে? কোনোদিন কি বসে হোম ওয়ার্ক করেছেন? কোনো চ্যানেলই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেনা। চ্যানেলের লোগো মুছে দিলে তারা নিজেরাই আলাদা করতে পারবে না কোনটা তার চ্যানেল। এই হলো বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলের করুণ অবস্থা। এখানে মেধাবী লোক নাই। কার্যত এখানে সবাই চাকরি করে। শিল্পচর্চা করে ক'জন। চাকরি আজ এই চ্যানেল তো কাল ওই চ্যানেল ।
মালিকরা তাদের যে বেতন দেন, একটু মেধা খাটিয়ে সেটা হালাল করার চিন্তা কোনো টিভি কর্তারই নেই।
মনোয়ার রুবেল
ইমেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৬
এএ/