ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিদায় হে দিশারি ! বিদায়!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৬
বিদায় হে দিশারি ! বিদায়! আল্লামা জালাল উদ্দীন আল কাদেরি

ছোটবেলা থেকে খতিব জালাল উদ্দীন হুজুরের চিন্তা-ভাবাদর্শ আমার এবং আমার অনেক বড় ভাই ও ছোট ভাইদের জীবনকে প্রভাবিত করেছে।  উনার ওয়াজ-নসিহত শুনেছি।  উনার পিছন পিছন জশনে জুলুছে গিয়েছি।  উনার জজবা ছিল তীব্র।  ওগুলোর কিছু আমাদের মধ্যেও এসেছে।  যে জজবা বা আবেগ পরবর্তীতে আমাদের আমাদের অপরাপর ধর্মচর্চাকে ছুঁয়ে গেছে।  ঈদ বা জুমার নামাজের শেষে কিংবা শবে বরাত ও শবে কদরের মত বিশেষ রজনীতে খতিব দরুদসহ কেয়াম করতে পছন্দ করতেন। 

ছোটবেলা থেকে খতিব জালাল উদ্দীন হুজুরের চিন্তা-ভাবাদর্শ আমার এবং আমার অনেক বড় ভাই ও ছোট ভাইদের জীবনকে প্রভাবিত করেছে।   উনার ওয়াজ-নসিহত শুনেছি।

  উনার পিছন পিছন জশনে জুলুছে গিয়েছি।   উনার জজবা ছিল তীব্র।   ওগুলোর কিছু আমাদের মধ্যেও এসেছে।   যে জজবা বা আবেগ পরবর্তীতে আমাদের আমাদের অপরাপর ধর্মচর্চাকে ছুঁয়ে গেছে।   ঈদ বা জুমার নামাজের শেষে কিংবা শবে বরাত ও শবে কদরের মত বিশেষ রজনীতে খতিব দরুদসহ কেয়াম করতে পছন্দ করতেন।

ছোটবেলায় উনার সাথে অনেকবার কেয়াম করেছি।   কিছুদিন আগেও উনার পিছনে জুমার নামাজ আদায় করেছি।   কিন্তু সময়ের স্বল্পতার  জন্য বাদা'ল জুমা পড়ে চলে এসেছি কেয়ামে শরীক না হয়ে।   তাছাড়া বয়স বাড়ার সাথে সাথে জশনে জুলুস ও কেয়ামের ব্যাপারে আমার মধ্যে হুজুরের চেয়ে ভিন্নতর ধারণা গড়ে উঠেছে।   তথাপি জশনে জুলুস ও কেয়াম সম্পর্কে হুজুরের ধারণা, চর্চা ও অবস্থানকে কখনো অপ্রয়োজনীয় মনে হয়নি।   বরং এই বিষয়ে হুজুরের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে আমি শ্রদ্ধা করি।  

মহানবী(স:) এর জন্মদিবসকে তিনি সবচেয়ে আনন্দের দিন মনে করতেন।   তিনি দিনটিকে ঈদের দিন মনে করতেন।   এই বিষয়ে তিনি বিস্তারিত বয়ান করতেও পছন্দ করতেন।   এ বিষয়ে উনার বয়ানের সবকিছু আমি বুঝতাম না।   কারণ তিনি আরবি ফার্সি ও উর্দু থেকে প্রচুর রেফারেন্স টানতেন।   ঐ ভাষাগুলোর উপর আমার কোনরূপ দখল না থাকায় ভাবতাম-ভাষাগুলো শিখে হুজুরের বয়ান বুঝার চেষ্টা করি। হুজুরের জীবদ্দশায় তা আর হয়ে উঠল না। খুব খারাপ লাগছে।   যাই হোক উনার সব কথা না বুঝলেও এতটুকু বুঝতাম-হুজুর নবীপ্রেমে দেওয়ানা-মজনু ছিলেন।   কাজেই রাসুল (স:)-এর জন্মদিনে ঈদ উদযাপন আশেক-মাশেকের মধ্যকার খাস ব্যাপার বলেই ধরে নিলাম।   

মানুষ উনাকে ভালোবাসত।   উনিও আল্লাহ্ পাকের বান্দাদের ভালোবাসতেন মনপ্রাণ দিয়ে।   মানুষের সুখ-দু:খের সাথী হতেন।   উনার ছাত্রদের উনি সন্তানের মতো স্নেহ করতেন।   কেউ মারা গেলে জানাজা পড়তেন।   নিজেও অসংখ্য জানাজার নামাজ পড়িয়েছেন।

মানুষে মানুষে বিভেদ হোক সেটা তিনি খুব অপছন্দ করতেন।   রাষ্ট্র ও সমাজে উগ্রপন্থার উদ্ভব বা বিস্তার হোক তা তিনি চাইতেন না।   এ ব্যাপারে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সোচ্চার ছিলেন।

মুহাম্মদ (স:)-এর উম্মতদের মধ্যে কোনরূপ বিভক্তি বা রক্তপাতকে তিনি ঘৃণা করতেন।   এজন্য জাতির এক ক্রান্তিকালিন সময়ে কিছু সংখ্যক উচ্ছৃংখল ও অপরিণামদর্শী ব্যক্তি মসজিদের অভ্যন্তরে তাঁর উপর ন্যাক্কারজনক আক্রমণ করলেও ধৈর্য ও সাহস হারাননি।   তাঁর সামান্যটুকু ধৈর্যচ্যুতিতে চট্টগ্রাম শহরে রক্তগঙ্গা বয়ে যেত।   সেই সময় অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতি সামাল দেন।

কওমিদের মধ্যে তাঁর ব্যাপারে কিছু অস্বস্তি কাজ করতো।   কিন্তু তিনি তাঁদেরকেও কাছের ভাবতেন।   অনেকেই মনে করেন তিনি তাবলিগের কাজকে পছন্দ করেন না।   এটা ঠিক নয়।   এ সম্পর্কে একটা কাহিনী বলতেই হয়।   একদিন নগরীর লাভ লেইনে এক কাজে গেলাম।   এক মুরুব্বীর সাথে দেখা।   এক কথা, দু কথা, অনেক কথা।   হঠাৎ খতিব সাহেব হুজুরের প্রসঙ্গ উঠল।  

মুরুব্বী বললেন, ‘একদিন এক লোক এসে নিজেকে নও মুসলিম পরিচয় দিয়ে আল্লাহ্র রাস্তায় যেতে চাইলেন।   আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম তাঁকে কে পাঠিয়েছেন।   জবাবে তিনি বললেন যে খতিব সা'ব হুজুর তাঁকে কলেমা পড়িয়েছেন এবং তবলিগে যেতে বলেছেন। ’

মুরুব্বি বলতে থাকেন।

আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য হুজুরকে কল দিলাম।   হুজুর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জবাব দেন, ‘ঈমানি কিছু হতাবার্তা ফুনক এনা।   সুরা-কেরাত কিছু শিখক।   পাঠাই দ্য আল্লাহর রাস্তাত। ’ (কিছু ঈমানি কথাবার্তা শুনুক। সুরা-কেরাত শিখুক। পাঠিয়ে দাও আল্লাহর রাস্তায়। )

আরেকটি ঘটনা না বললেই নয়।   আমি তখন চট্টগ্রামে মহানগর হাকিম হিসেবে কর্মরত। আমলি আদালতে ধর্মীয়ভাবে স্পর্শকাতর ইস্যুতে একটি মামলা হয়।   আমি রিপোর্ট তলব করি ওই বিষয়ের একজন স্কলারের কাছে।   তিনি এড়িয়ে যান।   পরে কয়েকজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার কাছে রিপোর্ট চেয়েও পাওয়া যায়নি।   । কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন খতিব সা'ব হজুর।   তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীলতা নিয়ে যথা সময়ে চমৎকার তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন দাখিল করেন।   তিনি যুগপৎ সাহসী ও যৌক্তিক ছিলেন।

পিরোজপুরে থেকেও আমি বুঝতে পারছি -চট্টগ্রামের মানুষ তাঁদের অন্যতম সেরা সন্তানটির জন্য কাঁদছেন।   তিনি চলে গেলেন-এটা চিরন্তন সত্য।   কিন্তু এই সৌম্যদর্শন মানুষটির শূন্যতা কোনদিনও পূরণ হবার নয়।

লেখক
বিচারক, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল, পিরোজপুর

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৬

টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।