সাব্বির খানের দাবি, একটি সময় আসবে প্রবাসীরা দেশের জন্য কি করেছে, কতটুকু করছে তা গবেষণার বিষয় হবে। আর একদিন তা গর্বেরও বিষয় হবে।
এখন যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান নিয়ে গর্ব হয়, দেশ গড়ার জন্য আমাদের অবদান নিয়েও সেদিন গর্ব হবে, বলেন সাব্বির খান।
‘বিদেশে আমাদের অবস্থান একটি বাস্তবতা, কিন্তু দেশ আমাদের আবেগ। ’
কথাগুলো যখন বলছিলেন তখন কিন্তু মোটেই আবেগতাড়িত ছিলেন না সাব্বির খান। বরং বেশ স্ট্রেইট ফরোয়ার্ডই মনে হচ্ছিলো তাকে। বলছিলেন, যেটা আবেগের তাকে স্ট্রেইট ফরোয়ার্ডই বলতে হয়। তাতে আমি যেটা বলতে চাই সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলানিউজ কার্যালয়ে সাব্বির খান বৃহস্পতিবার এসেছিলেন তার সদ্য প্রকাশিত বই ‘পোড়া মৃতদেহের রাজনীতি ও সময়ের গল্প’র একটি কপি হাতে। আনকোরা বই। সাব্বির খানের প্রথম গ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭ উপলক্ষে।
যারা দীর্ঘসময় ধরে সাব্বির খানের লেখালেখির সাথে পরিচিত তা বুঝেই নেবেন এটি তার সেই সব নিবন্ধের সমাহার যা দেশের দৈনিক, সাপ্তাহিক আর অনলাইন পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। আসলেই তাই। ‘পোড়া মৃতদেহের রাজনীতি ও সময়ের গল্প’ ২০০১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সাব্বির খানের লেখালেখির একটি সংকলিত রূপ।
কে এই সাব্বির খান? সে প্রশ্ন কেউ কেউ নিঃসন্দেহে করতে পারবেন। তাদের জন্য জানাচ্ছি- ১৯৬৬ সালে গোপালগঞ্জে জন্ম নেওয়া মানুষটি এখন একজন বাংলাদেশি সুইডিশ। আশির দশকের শেষভাগে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন বলে শেষভাগে দেশত্যাগে বাধ্য হন। সেটি ১৯৮৯ সাল। মোটে এইচএসসি সমাপ্ত করেছেন। বাম রাজনীতির ছাত্র ইউনিয়ন ও সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচি ও নাট্টদল পদাতিকের সক্রিয় সদস্য। তেমনই সময় দেশ ছেড়ে সুইডেন। সেখানেই পরবর্তী লেখাপড়া। কম্পিউটার প্রকৌশলে উচ্চশিক্ষা আর অতঃপর একজন সফল সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কাজ করছেন দেশটিতে অবস্থিত একটি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে।
বাস্তবতা বুঝতে বিশ্বায়নের চাহিদা বুঝতে হবে, আর সে পথেই নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে, তবেই প্রতিষ্ঠা লাভ, এত সাফল্যের পেছনের চেতনাকে এভাবেই ব্যাখ্যা করছিলেন সাব্বির খান।
সুইডেনে সব আছে কিন্তু বাংলাদেশ নেই, আর সে কারণেই পদে পদে দেশে ফিরে আসা। দেশকে নিয়ে ভাবা, বললেন তিনি।
‘বাংলাদেশের সাথে কোনও কিছুরই তুলনা হয় না। ’
বিদেশ-বিভূঁইয়ে থেকে দেশকে কিভাবে দেখতে পান? সে প্রশ্নের জবাবে বললেন, সুইডেন থেকে আমার বাংলাদেশে তাকানোটা স্যাটেলাইটের মতো কাজ করে।
কতটা প্রত্যয় থাকলে এ কথা বলা যায়! সাব্বির খান আস্থার সাথেই সে দাবিটি করলেন, আর বললেন, যে কেউ আমার এই বইটি পড়লে বুঝতে পারবে আমি গতটা গভীর থেকে, কতটা মন দিয়ে আমার দেশকে দেখেছি।
বইয়ের আলোচনায় না থেকে বরং তার কথাই বেশি শোনা হলো। সাব্বির খান বললেন, তিনি আসলে একটি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকেই দেখতে চান। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা দেখতে চান।
সঙ্গে সঙ্গে এও বললেন, এই বক্তব্য দিয়ে আমাকে রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বী বলে যে কেউ ভেবে বসতে পারেন কিন্তু সোনার বাংলা সেতো সর্বজনীন। দেশের প্রতিটি মানুষেরই এই চাওয়া থাকতে হবে।
সুইডেন বিশ্বের সেরা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ সেই তালিকায় পেছনের সারিতে সে প্রসঙ্গে বললেন, সুইডেনের জীবন গোছানো। ওখানকার জীবনের জন্য প্রয়োজন স্রেফ অভ্যস্ততা। আর বাংলাদেশে প্রতিদিনকার জীবন প্রতিদিনের। এখানকার প্রতিটি দিনই আলাদা, ইউনিক।
এতো সমস্যার দেশকে এতটা ইতিবাচক ভাবে দেখছেন! বাংলানিউজের এই বিস্ময়ে তিনি বলেন, এত মানুষের দেশে অনেক কিছুই সম্ভব হয়ে ওঠেনা, যা সুইডেনে সম্ভব। চল্লিশটি বছর কত শত সংকটের মধ্য দিয়ে পার করেছে বাংলাদেশ তা আমাদের বিবেচনা করতে হবে।
আগেই বলেছি, বিদেশ থেকে আমরা স্যাটেলাইটের চোখ দিয়ে দেখি, ফলে বুঝতে পারি কতটা অমিত সম্ভাবনায় ভরা আমাদের এই দেশ। আর সে সব সম্ভাবনা জাগ্রত করার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়, বলেন তিনি।
সম্পূর্ণ সততার সাথে দেশকে অনুভব করেন, এমনটা উল্লেখ করে সাব্বির খান বলেন, মনের ভেতরে থাকে এটা আমারই দেশ। উদাহরণ টেনে বলেন, বাবা-মায়ের কোনও একটি বিষয় পছন্দ না হলেও তা যেমন আমরা বড় করে দেখিনা ঠিক তেমনই আমাদের দেশ-মাতৃকা। দেশ মায়ের কোনও অপছন্দের বিষয়ও আমি বড় করে দেখতে চাইনা। বরং সম্ভাবনাগুলোকেই বড় করে দেখতে চাই।
বর্তমান সরকার দেশটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সে কথা স্বীকার করে নিতে অসুবিধা কোথায়? নিজেকেই প্রশ্ন করেন এই প্রবাসী বাংলাদেশি।
বললেন, আমার মা বলতেন, একটি মুখ হলে সোনার চামচ দেওয়া সম্ভব কিন্তু দশটি মুখ হলে রুপার চামচ দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে। এ থেকেই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
হঠাৎ ছেলেবেলায় ফিরে গেলেন। বললেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিলো ছয় বছর। আমার মনে আছে বাবা-মায়ের হাত ধরে কোথায় কোথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছি। অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশ। এখানে যুদ্ধাপরাধীরা বিএনপির সঙ্গে জোট গড়ে এত বছর ধরে দেশকে শত বছরের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার যে বাংলাদেশে হচ্ছে সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় আবেগের। একটি বিষয় বলতে চাই, এই চক্রান্তকারীরা থেমে নেই। বিএনপিকে আমি জামায়াতের অংশই মনে করি। এরা সারাক্ষণই সরকারকে বিপাকে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ওদের হাতে টাকারও অভাব নেই।
তবে পাশাপাশি এও মনে করি, ওরা টাকা দিয়ে করে আর আমরা আত্মা দিয়ে করি। আর সে কারণেই ওদের চেয়ে আমরা অনেক বেশি শক্তিধর।
তবে এসবই আবেগের কথা, দেশকে সত্যিকারের উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করা। তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত যেমন করতে হবে, তেমনি প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব দরবারে চলার যোগ্য করে তুলতে হবে। দেশকে চেনাতে হবে, প্রকৃতিকে চেনাতে হবে। তার জন্য বাবা-মায়ের দায়িত্ব আছে বটে, কিন্তু একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনাও জরুরি। যে দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
পাঠ্যপুস্তকে ভুলের সমাহার এই ভবিষ্যত প্রজন্ম গঠনের পথে বাঁধা হবে বলেই মনে করেন তিনি। তবে তার চেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন এসব বইয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মৌলবাদী গোষ্ঠীর চাওয়া-পাওয়ার প্রয়োগ দেখতে পেয়ে। সাব্বির খান বলেন, কোমলমতি শিশুদের এই মৌলবাদের রাহুমুক্ত করতেই হবে।
সরকার তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাকে বাধা দিচ্ছে না, এটা ঠিক কিন্তু আমার মনে হয়, এসবে সরকার খুব একটা গা-ও করছে না। এটা খারাপ। বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। যে করেই হোক সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন হওয়া চলবে না, বলেন সাব্বির খান।
আবার বইটির প্রসঙ্গ এলো। সাব্বির খানের কাছে প্রশ্ন ছিলো, নিবন্ধ-প্রবন্ধের বাইরে সাহিত্যধর্মী কিছু লেখালেখি করেন কি না? উত্তরে বললেন, রাজনৈতিক নিবন্ধও একটি সাহিত্যকর্ম। এখানেও শব্দ নিয়ে খেলতে হয়। তবে আমি গল্প-কবিতা লেখি না।
‘পোড়া মৃতদেহের রাজনীতি ও সময়ের গল্প’ তেমনই ভাবনা সৃষ্টি করবে বলে বিশ্বাস সাব্বির খানের। তিনি বলেন, এটি মূলত একটি আর্কাইভ হিসাবে কাজ করবে। অনেকের কাছে রেফারেন্স বই হিসেবে বিবেচিত হবে।
সৎভাবে সত্য বলাটাও এক ধরনের আর্ট, এই মন্তব্য করে তিনি বলেন, সত্য সুন্দরকে উপস্থাপন করে যাওয়াকে আমি আমার দায়িত্বের অংশ বলেই মনে করি।
আর মানুষের মধ্যে ভাবনার পথ তৈরি করে দিতে একধরনের অ্যাগ্রেসিভনেস আমার মধ্যে কাজ করে। সে কারণেই প্রবন্ধগুলো লেখি। লেখাগুলো মানুষকে ভাবতে সাহায্য করে। আর সেটাই আমার প্রাপ্তি।
বাংলাদেশ সময় ২০২৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৭
এমএমকে