ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

যুক্তির জোর নয়, জোরের যুক্তিতেই পাকিস্তানিদের ভরসা

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৭
যুক্তির জোর নয়, জোরের যুক্তিতেই পাকিস্তানিদের ভরসা

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সর্বোস্তরে উর্দু প্রচলন করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। তারা গণপরিষদ ও গণপরিষদের বাইরে সে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। গণপরিষদ বিতর্কে জিন্নাহ-লিয়াকত আলীর বক্তব্য থেকেই তার প্রমাণ মেলে। গণপরিষদের বাইরেও তারা বিভিন্ন সভা-সম্মেলনে বাংলার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাতে থাকলো। আসলে তাদের প্রচার যতোটা না উর্দুর পক্ষে তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল বাংলার বিপক্ষে। 

বাঙালি ‘তমদ্দুন মজলিশ’র মতো আরো সংগঠিতভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য জোর দাবি করে আসছিল।  

তমদ্দুন মজলিশের মতোই বাংলার পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখেছিল ‘গণ আজাদী লীগ’ নামে একটি সংগঠন।

তারা ১৯৪৭ এর জুলাই মাসেই বাংলার পক্ষে জনমত গঠন করতে শুরু করে। এ সংগঠনটি পরে  ‘সিভিল লিবার্টি লীগ’ নামে পরিচিত হয়। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলার পক্ষে জনমত গঠন করতে থাকে। পত্র-পত্রিকায় ও বিভিন্ন পুস্তকে প্রবন্ধ লিখে তারা বাংলার পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখে।  

১৯৪৭ সালের ২২ জুন দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় আবদুল হকের কলাম। এছাড়া ২৯ জুলাই প্রকাশিত হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নিবন্ধ। উভয় লেখাতেই তারা বাংলাকে রাষ্ট্রের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন।  

সংগঠিতভাবে আরো অনেকেই বাংলার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ এর একটি সভা। এখানেও বাংলার পক্ষে বক্তব্য পেশ করা হয় এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করে।  

তমদ্দুন মজলিশের পুস্তিকা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র-ভাষা বাংলা-না উর্দু’তে যারা লেখেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অধ্যাপক এম. এ কাসেম, আবুল মনসুর আহমদ, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ। অধ্যাপক কাসেম তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোক্তাও ছিলেন।  

বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও ঘরোয়া বৈঠকেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হয়। যেমন, সেসময় পূর্ব-বঙ্গ সাহিত্য সমাজের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। তারা ৫ নভেম্বর একটি সভা করে। এদিকে তমদ্দুন মজলিশও ১২ নভেম্বর সভা করে। পৃথক পৃথক সভায় বাংলার পক্ষে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।  

তমদ্দুন মজলিশের পুস্তিকা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উর্দু’তে অধ্যাপক কাজী মোতাহর হোসেন লেখেন, ‘পাঠান রাজত্বে রাজভাষা ছিল পোস্তু, আর মোগল আমলে ফার্সি। মোগল-পাঠানেরা বিদেশি হলেও এদেশকে জন্মভূমিরূপে গ্রহণ করেছিলেন এবং দেশের অবস্থা জানার জন্য দেশীয় ভাষাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছিলেন’।  

তিনি একই প্রবন্ধে বলেন, ‘ইংরেজের স্থান যেন বৈদেশিক বা অন্য প্রদেশীয় লোকে দখল করে না বসে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা নিতান্ত প্রয়োজন। কুচক্রীলোকে যাতে শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে ভাষার বাধা সৃষ্টি করে নানা অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মানসিক বিকাশে বাধা না জমাতে পারে সে বিষয়ে নেতা এবং জনসাধারণকে সজাগ থাকতে হবে’।

গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্যকে জিন্নাহ-লিয়াকত আলী প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু  জনগণ বিষয়টিকে সাধারণভাবে নেয়নি। ঢাকায় ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। জিন্না-লিয়াকত আলীর  বক্তব্যের প্রতিবাদস্বরূপ তারা ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘটের ডাক দেন।  

এরই ধারাবাহিকতায় ১১ মার্চ বাংলার বুদ্ধিজীবী-ছাত্র-শিক্ষক-জনতা এক প্রতিবাদ দিবস পালন করেন। এতে তারা সভা-সমাবেশ-শোভাযাত্রা, সাধারণ ধর্মঘট, ক্লাস বর্জন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন। কিন্তু সরকার এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। সরকার এর বিরুদ্ধে লাঠিচার্জ, কাঁদানো গ্যাস নিক্ষেপ, ফাকা গুলি বর্ষণ ও প্রেপ্তার করে সংঘাতের পথে পা বাড়ায়। বেশকিছু ছাত্র-জনতাকে এদিনে গ্রেফতার করা হয়।  

যাদেরকে গ্রেফতার করা হয় তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম, রফিকুল আলম, শাহ মো. নাসিরুদ্দিন, নুরুল ইসলাম, কামারুদ্দিন প্রমুখ।

তাদের সহিংস অবস্থানের কারণে বাঙালি আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বাঙালি বিশ্বাস করে যুক্তির জোরে। আর পাকিস্তানিরা বিশ্বাস করে জোরের যুক্তিতে। তাই ৫৬ শতাংশ জনের ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা না করে পাকিস্তানিরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছে।  
  
অন্য আরো কয়েকটি সংগঠন বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করে; যেমন-রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ, সংগ্রাম কমিটি, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, খেলাফতে রব্বানী ইত্যাদি।  

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানে জনগণ ও সরকারের মধ্যে অবিশ্বাস দানা বাধে, দূরত্বও ক্রমেই বাড়তে থাকে। সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব আরো প্রকট হতে থাকে। ভাষার বিরোধটি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক বিরোধিতায় পরিণত হয়। জনগণও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।  

এমতাবস্থায় ১৯৪৮ সালের ৩ জুন এক শান্তি মিশন নিয়ে সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় আসেন। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকার তাকে উল্টো ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিহিত করে আটক করে। পরে ঢাকা ত্যাগ করার শর্তে তার আটকাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতাকেও তারা নাজেহাল করে। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে তারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কিন্তু নাজিমুদ্দিন তাতেও ক্ষান্ত হননি, তার পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। শুধু তাই নয়, তার গণ-পরিষদের সদস্যপদও বাতিল করেন!

গণতন্ত্রের মানসপুত্র পাকিস্তানে এভাবেই অপদস্ত হলেন। বাধ্য হয়ে তিনি অবশেষে ১৯৪৯ সালের মার্চে করাচি গিয়ে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এ ঘটনা বাঙালির মনে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। কারণ, বাঙালি হৃদয়ে সোহরাওয়ার্দীর আসন অনেক উপরে। মানসপুত্রের এ অবমাননা বাঙালি ছাত্র-জনতা-নেতারা ভালোভাবে নেয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৭
জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।