১৯৪৮ সালে যে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় তার আহ্বায়ক হন তমদ্দুন মজলিশ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যুগপৎ সদস্য শামসুল আলম আর যুগ্ম আহ্বায়ক হন আব্দুল মান্নান। এ পরিষদের সদস্য ছিলেন ২৮ জন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলার বুদ্ধিজীবী-ছাত্র-শিক্ষক-জনতা এক প্রতিবাদ দিবস পালন করে। এদিন ছাত্র-শিক্ষক-জনতা সভা-সমাবেশ-শোভাযাত্রা, সাধারণ ধর্মঘট, ক্লাস বর্জন ও বিক্ষোভ মিছিল করে। সরকার প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে ও শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম, রফিকুল আলম, শাহ মো. নাসিরুদ্দিন, নুরুল ইসলাম, কামারুদ্দিন প্রমুখকে গ্রেফতার করে।
১১ মার্চ আরেকটি ঘটনা ঘটে। এদিন সাধারণ ছাত্ররা ধর্মঘটে ক্লাস বর্জন করলেও অবাঙালি ডিন মাদানী সাহেবের ভ্রাতুষ্পুত্র ক্লাস বর্জন করতে রাজী না হয়ে ক্লাসে যোগদান করে। সাধারণ ছাত্রদের কয়েকজন তাকে মধুর ক্যান্টিনে ডেকে আনে ও ক্লাসে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু সে ক্লাস বর্জন করতে রাজী হয় না। বাদানুবাদ ও বচসার এক পর্যায়ে যদিও সে ক্লাস বর্জনে রাজী হয়, কিন্তু এ ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত জিন্নাহর কান পর্যন্ত পৌঁছায়। ভাষা নিয়ে বাঙালি-অবাঙালিদের এরকম আরো বিরোধের কথা জিন্নাহর জানতে পারেন, যার ইঙ্গিত তার পরবর্তী বক্তব্যগুলোতে প্রকাশ পায়।
আন্দোলনকারীদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করলেও ছাত্র-জনতা তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। প্রধানমন্ত্রীর বাস ভবন বা বর্ধমান হাউস, সেক্রেটারিয়েট ভবন ইত্যাদি স্থানে তারা প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। চাপের মুখে খাদ্যমন্ত্রী আফজাল হোসেন ও শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হামিদ পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হন। ধীরে ধীরে সাধারণ নাগরিকরাও এর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে।
একদিকে আন্দোলন ও অন্যদিকে মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের পরিপ্রেক্ষিতে খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবি মেনে নেন। সেই সঙ্গে তাদের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী ওই দিনই বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়।
এই চুক্তির আটটি দফা ছিল যা খাজা নাজিমুদ্দিন মেনে নিতে বাধ্য হন। এখানে বলা হয় (১) ভাষা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট সব-ছাত্র-ছাত্রীদের নি:শর্ত মুক্তিদিতে হবে। (২) একমাসের মধ্যে পুলিশি অত্যাচারের তদন্ত করতে হবে (৩) আসন্ন প্রাদেশিক পরিষদ অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করতে হবে ও পাকিস্তান আইন পরিষদে তা পেশ করতে হবে। (৪) সমস্ত পরীক্ষায় বাংলা ও উর্দুর সমান মর্যাদা নির্ধারণ করতে হবে ও ইংরেজি উঠে যাওয়ার পর সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার প্রচলন ও শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করতে হবে। (৫) আন্দোলনকারী কোনো ছাত্রের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। (৬) সংবাদপত্রের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে ও ১৪৪ ধারা উঠিয়ে নিতে হবে। (৭) অবৈধ দমননীতি ও হুলিয়া প্রত্যাহার করতে হবে ও (৮) প্রধানমন্ত্রী এই মর্মে ঘোষণা দিবেন যে-‘আমি নি:সন্দেহ যে ভাষা আন্দোলনকারীরা কোনো বহি:শত্রু বা দুশমন দ্বার প্রভাবিত হয় নাই’।
এভাবেই নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে পিছু হটলেন। কিন্তু তিনি চেয়ে থাকলেন জাতির জনক কায়েদে আযমের দিকে। জিন্নাহ ওই আটদফা চুক্তির চার দিন পর ১৯ মার্চ ঢাকায় আসেন। এসেই তিনি একের পর হুমকি-ধামকি দিতে থাকেন। দু’দিন পর ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশে তিনি আবার তার পুরনো কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। সমাবেশে তিনি বললেন, “এখানে দেখতে পাচ্ছি অবাঙালি মুসলমান সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব এবং বাংলা ভাষার প্রশ্নে উত্তেজনা। তাই একথা আপনাদের পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া আবশ্যক যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়। এ ব্যাপারে আপনাদের কেউ যদি বিভ্রান্তি করে তাহলে বুঝিতে হবে সে রাষ্ট্রের দুশমন”। এরপর ২৪ মার্চ কার্জন হলেও তিনি একই কথার পুনারাবৃত্তি করেন।
১৫ মার্চের চুক্তির পর সরকার লোক-দেখানো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফলে আপাত দৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনও কিছুটা স্থিমিত হয়ে পড়ে। বলা যায় ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন তেমিন গতি পায়নি। কিন্তু সরকার আসলে ভেতরে ভেতরে ‘বাংলা’ ভাষার বিরুদ্ধে তার পূর্ব সিদ্ধান্ত বদলায়নি। কিন্তু ছাত্র-জনতা ভাষা আন্দোলনের চেতনা ঠিকই জিইয়ে রেখেছিল। তারা ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করতে থাকে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৭
এসএইচ
**যুক্তির জোর নয়, জোরের যুক্তিতেই পাকিস্তানিদের ভরসা
**রাষ্ট্রভাষা নিয়ে ‘দুশমন’ ‘দরদী’ বিতর্ক
**বাঙালিমুক্ত শাসন, বাংলামুক্ত ভাষণ, তাই টেকেনি পাকিস্তান