একটি দেশ জাতি ও সমাজ তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যে বিশ্বাস, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, দক্ষতা ও নৈতিকতা বোধ দিয়ে গড়ে তুলতে চায় সেই কাজটা সম্পন্ন করেন সম্মানিত শিক্ষকরা। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার ও জাতীয় উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।
মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ অর্থাৎ হেফাজত করার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের, যা সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে এবং এই মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ১০২(১) বিধান মোতাবেক সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মামলা করতে পারবেন। আইনগত অধিকার না থাকায় ন্যায্য প্রাপ্য পাওয়ার জন্য বেসরকারি শিক্ষকদের রাষ্ট্রের করুণার উপর নির্ভর করতে হয়। এটি একেবারেই অনভিপ্রেত।
বেসরকারি শিক্ষকদের অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারী উদ্যোগ এবং পর্যাপ্ত সমর্থন না থাকায় তারা সর্বদাই বঞ্চিত হন। উদাহরণস্বরূপ দেখা যায়, বেসরকারি শিক্ষকদের বাড়িভাড়া পান ১০০০টাকা। এই টাকায় বাড়ি ভাড়াতো দূরের কথা বাড়ির বারান্দাও পাওয়া সম্ভব নয়। তারা চিকিৎসাভাতা পান ৫০০ টাকা। তা নিতান্তই অপ্রতুল; তারা উৎসবভাতা পান স্ব-স্ব স্কেলের ২৫ ভাগ। বেসরকারি স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা কোনো শিক্ষাভাতা, টিফিনভাতা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পাহাড়িভাতা পান না। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পদোন্নতির কোনো সুষ্ঠু বিধি ব্যবস্থাও নেই। যেমন, বেসরকারি কলেজে এমন অনেক মেধাবী শিক্ষক/শিক্ষিকা আছেন যারা এস.এস.সি থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যন্ত অনেক বিষয়ে প্রথম শ্রেণী প্রাপ্ত এবং তাদের অনেকেই আবার এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রির অধিকারী হয়েও পদোন্নতিতে অনুপাত থাকার কারণে সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন না। তাদের এত উচ্চ মানের ডিগ্রি থাকার পরও ট্রাজেডিটা হলো, অনেক হতভাগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকাকে পুরো চাকুরীজীবনে প্রভাষক হিসাবে জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। বেসরকারি কলেজে পদোন্নতির কোনো সুব্যবস্থা না থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখন এই সম্মানিত পেশায় আসতে চরম অনীহা প্রকাশ করেন। পৃথিবীর কোনো উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে এমন তুঘলকি প্রথা আছে বলে আমাদের জানা নেই।
দেশের মেধাবীদের এই পেশায় আনার জন্য মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়ে আসছেন। কিন্তু তাঁর এই ঘোষণা ঘোষণা হিসাবেই থেকে গেল; কখনো আর আলোর মুখ দেখল না। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন করার মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মানে অগ্রগামী ভূমিকা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শিক্ষকদের বেতন ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা আমাদের দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আর. এম দেবনাথ দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় তাঁর এক নিবন্ধে লিখেন, ভারতবর্ষে হাইস্কুলের একজন শিক্ষক তাঁকে জানালেন নির্দিষ্ট ডিগ্রি নিয়ে হাইস্কুলে একজন শিক্ষক এখন যোগদান করলেই ২০-২৫ হাজার ভারতীয় রূপি পান। যা চাকুরীতে যোগদান করলে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষকও পান না। তাই স্বাধীন দেশের একজন শিক্ষক যখন তার জন্য নির্ধারিত সম্মানীর মাধ্যমে পরিবারের ভরনপোষণ করতে ব্যর্থ হন, বা এই মহান পেশা ছেড়ে দিয়ে জীবন জীবিকার তাগিদে অন্য কোনো পেশায় চলে যেতে বাধ্য হন তখন স্বাধীন জাতি হিসাবে আমাদের লজ্জিত হওয়ারই কথা। এজন্য অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতার পেশায় আগ্রহী করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে অবশ্যই তাদের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তার দিকটা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই দেশে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে এবং যোগ্য নাগরিক তৈরি পথ প্রশস্ত হবে।
কোনো জাতি যদি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় তাহলে সে-জাতির পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে না। প্রায় ৩ দশকের যুদ্ধে বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬.৬ শতাংশ বিনিয়োগ করে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ শিক্ষাখাতে আমাদের বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন---মাত্র ২.২ শতাংশ। জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ ও জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ করলে আমরা সার্কভূক্ত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবো।
ইউনেস্কোর হিসাব অনুযায়ী শিক্ষাখাতের ব্যয় ৬.৬% হওয়া উচিত। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শিক্ষাখাতে বাজেটের ২১ শতাংশ বরাদ্দ থাকত, এখন তা কমিয়ে ১১ শতাংশে নামানো হয়েছে । সারাবিশ্বে যখন শিক্ষা বাজেট বাড়ছে আমাদের তখন ক্রমেই কমতে শুরু করেছে। অথচ দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির জন্য জন্য শিক্ষাকেই সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল। কারণ একমাত্র শিক্ষাই পারে দেশকে পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্ত করতে। শিক্ষামন্ত্রী নিজে প্রায়ই বলেন, আমরা শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন দিতে পারি না। তাহলে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক যে, কিভাবে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হবে?
ভারত ও নেপালে শিক্ষাখাতে মোট দেশজ সম্পদের ৪% শ্রীলংকায় ৫শতাংশের বেশি, ভুটানে ৫ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৮শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ১২ শতাংশ, ব্রাজিল এবং চিলিতে ৪ শতাংশের মতো।
আবার শিক্ষাখাতের বরাদ্দ ঠিকভাবে ব্যয়িত হলে তা দেশের উৎপাদনশীল কার্যক্রমকে গতিশীল করে এবং রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনায় দক্ষ মানব সম্পদের যোগান দেবার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মানবসম্পদ যোগানোতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা,’ডটার অব পিস’ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, দক্ষ ও সফল শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বর্তমান সরকার সমাজের সকল স্তর ও চিন্তার মানুষের মতামত গ্রহণ করে জাতির প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি, আকাঙ্ক্ষা ও লক্ষ্যের প্রতিফলন ঘটিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ সালে প্রণয়ন করেছেন। কিন্তু একই সরকার কেন তা দ্রুত বাস্তবায়ন পদক্ষেপ নিতে পারছে না? এটা অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। শিক্ষা-বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষাখাতে অধিকতর বাজেট বরাদ্দ দেয়া আবশ্যক।
আমরা আশা করি, বর্তমান সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ও ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে নিতে হলে শিক্ষকসমাজের ন্যায্য পাওনা (যেমন সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতো বর্তমান স্কেলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাড়া, পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাভাতা, উৎসবভাতা,বৈশাখীভাতা, টিফিনভাতা, পাহাড়িভাতা, শিক্ষাভাতা, পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট) দেওয়ার ব্যবস্থা অবশ্যই সুনিশ্চিত করতে হবে।
সর্বশেষে শিক্ষাবান্ধব সরকার বেসরকারি এমপিওভুক্ত পাঁচ লাখ শিক্ষকের অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণ করবেন বলে মাননীয় শিক্ষকবৃন্দ, শিক্ষার্থী ও অভিবাবকসহ সমাজের অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ দৃঢ় আশাবাদী ।
লেখক:
মো. আজিজুর রহমান আযম,
সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, দালালবাজার ডিগ্রি কলেজ,
লক্ষ্মীপুর জেলা
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৭
জেএম