ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলা হরফের ওপর শয়তানি আছর

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৭
বাংলা হরফের ওপর শয়তানি আছর

১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ শিক্ষক-ছাত্র-জনতার সঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দিনের আট দফা চুক্তি হয়। এ চুক্তির পর সরকার লোক-দেখানো কিছু পদক্ষেপ নেয়। আপাত দৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনও কিছুটা স্থিমিত হয়ে পড়ে বলে মনে হলেও ছাত্র-জনতা ভাষা আন্দোলনের চেতনা ঠিকই জিইয়ে রেখেছিল। ওদিকে সরকারও বাংলার বিরুদ্ধে তার ষড়যন্ত্র চালিয়ে গেলো।

পাকিস্তান সরকার নানামুখী ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকলো। এসব ষড়যন্ত্রের মধ্যে অন্যতম হলো, আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রচলন।

পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব ফজলুর রহমান ইসলামি আদর্শের দোহাই দিয়ে বাংলা ভাষার জন্য আরবি হরফের প্রস্তাব করেন। আসলে তারা ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলা ও বাঙালিকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। ১৯৪৮ সালে করাচিতে নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে শিক্ষা সচিবের এমন প্রস্তাবে বাঙালি হতবাক হয়। ১৯৪৯ সালের পেশোয়ারে কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সভায়ও আরবিকে পাকিস্তানের ভাষা সমূহের একমাত্র হরফ করার জোর সুপারিশ করা হয়। বাংলা ও বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতেই মূলত তারা এ প্রকল্প হাতে নেয়।

ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের বাংলায় পবিত্র কোরানের হরফ প্রচলনের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। এতে করে প্রকারান্তরে তারা চেয়েছিল উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্টভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এ লক্ষ্যে একটি বর্ণমালা বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করা হয়। এ দলে দেশবরেণ্য অনেক শিক্ষাবিদকে ভেড়ানোর চেষ্টা করে সরকার। কিন্তু বাংলা ও বাঙালির পক্ষের কোনো শিক্ষাবিদ এতে অংশগ্রহণ করেনি।

বাংলার বিরুদ্ধে উপরোক্ত ষড়যন্ত্র প্রকল্পের অংশ হিসেবে তারা ১৯৫০ সালে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় আরবি হরফে বাংলা শিক্ষার কুড়িটি কেন্দ্র স্থাপন করে। অর্থাৎ নীল নকশা বাস্তবায়ন করতে তারা বাস্তবে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ অবাস্তব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সরকার লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে। কিন্তু বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তার পয়সা খরচের বাজেট নেই। তারা পূর্ব পাকিস্তান আরবি সংঘ নামে একটি সংঘও গঠন করে।

অতি উৎসাহী একটি গ্রুপ আবার আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করারও প্রস্তাব করে। আসলে তারা ভাষার সাথে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলেছিল। করাচিতে বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনে আরবি হরফবাদীরা এই অভিনব প্রস্তাব করেন। তারা আরবিকে রাষ্ট্রভাষা নয়তো বাংলাকে আরবিতে রূপান্তর করে মুসলমানের ভাষা হিসেবে নতুনরূপে প্রচলন করতে চায়। ভাষা রূপান্তরের এ প্রকল্প বিশ্বে শুধু পাকিস্তানিরাই নিয়েছিল। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তারা ‘পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি’ নামে একটি কমিটিও গঠন করে দেয়। তাদের বাংলাকে মুসলমানি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

অভিনব কায়দায় বাংলাকে মুসলমানিকরণের কাজে মদদ জুগিয়েছেন মিজানুর রহমান ও জুলফিকার আলী। বাংলা ভাষার কোথায় কতটুকু থাকবে বা থাকবে না তার দায়িত্ব দেওয়া হয় এ উর্দু কমিটিকে। পরবর্তীতে সরকার জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থা (Bureau of National Reconstruction) নামে একটি সংস্থা গঠন করে। তাদের কাজ ছিল বাংলাকে আরবি বা উর্দুতে রূপান্তর করা। বাংলাকে কেটে ছেটে উর্দুকরণই ছিল তাদের দায়িত্ব। সে সময়ে বাঙালি ছাত্ররা এই সংস্থাকে বঙ্গ সংস্কৃতির গোয়েন্দা বিভাগ বলে অবিহিত করতেন। একইভাবে তারা একটি ‘ভাষা সংস্থা কমিটি’ গঠন করেছে। বাঙালিরা একে বলতো ‘ভাষা সংহার কমিটি’। এভাবে তারা সংগঠিতভাবেই বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। ফলে বাঙালির আর রাজপথ ছাড়া উপায় রইলো না।

উর্দুভাষীরা বোঝাবার চেষ্টা করলো, “হাজার মাইল দূরের হলেও সিন্ধি, বেলুচি, পাঞ্জাবি, পেশোয়ারিরাই তোমার ভাই-বাড়ির পাশের অমুসলমানরা তোমার কেউ না। তাদের কৃষ্টি-কালচারের স্পর্শে তোমরা না পাক হইও না’। ভাষাকে তারা হিন্দু মুসলমান হিসেবে আখ্যায়িত করলো।

উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে জাহির করতে তারা প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত উর্দু অবশ্য পাঠ্য  করার ব্যবস্থা করে। এ লক্ষে তারা বইপুস্তক প্রকাশ করে টাকা পয়সা খরচ করতে কার্পণ্য করেনি।

বাঙালি শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীরাও এর বিরুদ্ধে কলমযুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। রাজপথ তো ছাত্র-জনতা দখল করেই রেখেছে। কলমযোদ্ধাদের অন্যতম সৈয়দ মুজতবা আলী তার নিবন্ধে বলেন, “বাংলাকে যারা ‘নাপাক’ ‘অপাক’ বলে কটাক্ষ করে তাদের একটা কথা স্পষ্ট বলতে চাই ‘ছুৎমার্গ ইসলামে নাই’; বন্ধুরা, ‘ভাষার ছুৎমার্গ নাই’। ‘নাপাক’ পার্সির সাথে ‘নাপাক’ হিন্দি মিলে উর্দু হইলো। সে আজ এতো পাক হইলো কীভাবে? হিন্দুয়ানি ভাষা বাংলা ব্যবহার করে এতদিনে পূর্ব পাকিস্তানি মুলমানরা কি নাপাক হইয়াছিল? এই নাপাকরা কি পাকিস্তানের জন্য লড়ে নাই? পাকিস্তানের স্বপ্ন কি সফল হইয়াছে শুধু লাহোর-লক্ষ্ণৌর কৃপায়?”

প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরা সেদিন পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। সোহরাওয়ার্দী বলেন, “রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য বা ভাষার দাবীবিতে সরকারের সমালোচনা করাকে শান্তিভঙ্গ মনে করে যদি ১৪৪ ধারা জারি করে মানুষকে অত্যাচার করতে হয়, জেলে পুড়তে হয়, মানুষ মারতে হয় তা হলে হিটলার সরকার কি দোষ করেছিল বোঝা শক্ত। ”

এমনকি মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিমও বলেন, “পাকিস্তানের বর্তমান কর্ণধারগণের যদি সমাজবিজ্ঞান সম্মন্ধে প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও থাকতো তাহলে তারা বুঝতো উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতিই দুশমনি করা। ”  (বাঙ্গালীর ভাষা আন্দোলন-মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান)।

আবদুল গফুর সাহেব বলেছিলেন,  “স্ত্রীবিদ্যা-স্ত্রীবুদ্ধির তিন মহারথী শিক্ষামন্ত্রী এবং তার সেক্রেটারি করিম ও ডেপুটি সেক্রেটারি মিজানুর রহমানকে জানিয়ে দিচ্ছি-বাংলা হরফের উপর কোনো শয়তানি হামলা বরদাস্ত করা হবে না। এদেশ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দেশ। তারা অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ কিন্তু তাই বলে ধর্মের নামে ভাষা বিভক্তি মেনে নিতে পারেনি। ভাষা আল্লাহর অন্যতম সৃষ্টি বৈচিত্র্যের একটি। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করে তার মুখে কথা দিয়েছেন। সব ভাষাই তার সৃষ্টি। কিন্তু পাকিস্তানিদের বোঝাবে কে?”

এদিকে ১৯৪৯ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের র্ধমঘটে ছাত্ররা নেতৃত্ব দেয়। ফলে ছাত্রদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়। অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে ২৭ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অলী আহাদ, উমাপতি মিত্র, সমীর বসু, আবদুল হামিদ, আবদুল মান্নানকে চার বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। জালালুদ্দিন, আবদুল মতিন, আবদুস সামাদ, মাহাবুব আলী, অরবিন্দু বসু জে: পত্র নবীশ, জামাল কোরেশির বিরুদ্ধে হল থেকে বহিষ্কারাদেশ দেওয়া হয়। কল্যাণ দাস, শেখ মুজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধু), মইনুদ্দিন, নাদেরা বেগম (মুনীর চৌধুরীর বোন), আবুদল ওয়াদুদের বিরুদ্ধে ১৫ টাকা করে জরিমানা করা হয়। জরিমানা না দেয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানকে বহিষ্কার করা হয় ও আরও কয়েকটি মামলায় তাকে জড়ানো হয়। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটানা জেলে আটক রাখা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে।

এভাবে একের পর এক জুলুম নির্যাতনে বাঙালি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতা। তারা ভাষার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৫২’র প্রথম থেকেই রাজপথ উত্তাল হতে থাকে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৭
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।