না, ঐতিহাসিক এসব ঘটনার কোনোটাই দেখিনি। কোনো মিছিলে যাইনি, জনসভায় যাইনি।
কারণ আমার জন্ম ৭১-এর অনেক পরে। কিন্তু মার্চ এলেই ফিরে যাই বাংলাদেশের স্বপ্নের সেই মাসে। আমার কাছে মাসটি আসলেই স্বপ্নের মাস। কল্পনা ভেসে গিয়ে সাত কোটি বাঙালির স্বপ্ন ছুঁয়ে আসার মাস। হালকা শীতে ভাবনায় ওম দিয়ে সেই মাসের উষ্ণতা অনুভব করার মাস। তাই মার্চ এলেই স্বপ্নাতুর হয়ে যাই। স্বপ্ন দেখি আমি আছি সেই মিছিলে। সেই যুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর সেই জনসভায়।
সবার সঙ্গে আমিও হাঁটছি। স্লোগানে স্লোগানে উত্তপ্ত করে তুলছি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বসে আছি মঞ্চের ঠিক সামনে। দেখছি বঙ্গবন্ধুকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি তার ভাষণ!
চোখে না দেখলেও পরে জেনেছি ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৩টি মহিলা আসনসহ জাতীয় পরিষদে আসন সংখ্যা ছিল ৩১৩টি (৩০০+১৩= ৩১৩)। এর মধ্যে অবিভক্ত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল-পূর্ব পাকিস্তানের আসন সংখ্যা ছিল ১৬৯টি (১৬২+৭= ১৬৯)। অর্থাৎ, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি আসন। ওই নির্বাচনে বহু রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। সামরিক আইনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় ওই নির্বাচন। এতে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন পাওয়ার পর বাকি ২টি আসন পায় পিডিপি (পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি)। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন।
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস পার্টি) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ও পাকিস্তান সামরিক চক্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে অর্থাৎ, আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ষড়যন্ত্রকারীদের হাতের পুতুলে পরিণত হলেন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ১টা ৫ মিনিটে আকস্মিক এক বেতার ঘোষণায় ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত হওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গর্জে ওঠে বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান)।
৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের সভায় প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার স্বাধীকার আন্দোলন যেন থেমে না থাকে। বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি না থাকলে আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব দেবেন। তাদেরও যদি হত্যা করা হয়, যিনি জীবিত থাকবেন তিনিই নেতৃত্ব দেবেন। যেকোনো মূল্যে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে- অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ’
বঙ্গবন্ধু আগেই ঘোষণা করেছিলেন, ৭ মার্চ রোববার রেসকোর্স ময়দানে তিনি পরবর্তী কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন। ৪ থেকে ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত সারা দেশে হরতাল পালনের আহ্বান জানালেন বঙ্গবন্ধু। তার নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে আন্দোলন এগিয়ে চললো। দেশের শতকরা ৯৮ জন মানুষের ভোটে নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সামরিক শাসন চালু থাকলেও সামরিক সরকারের কথা তখন কেউ শুনছে না। শেখ মুজিবের কথাই যেন তখন আইন।
সেই আন্দোলনমুখর পরিস্থিতিতে ঘনিয়ে এলো ৭ মার্চ। ওই দিন বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানে পূর্ব নির্ধারিত জনসভায় যোগদানের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লাখ লাখ মানুষ রওয়ানা দেয়। বাস, লঞ্চ, স্টিমার, নৌকা ও হেঁটে বিপুল বিক্রমে রাজধানী ঢাকার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। আমিও যেন তাদের সঙ্গে রওয়ানা দেই। আমিও আসতে থাকি ঢাকায়। ইতিহাস মতে ২৬ ঘণ্টার হাঁটা পথ পেরিয়ে গামছায় চিড়ে-গুড় বেঁধে ঘোড়াশাল থেকেও বিরাট মিছিল এসেছিলো সেই সভায়। বহু নারী, ছাত্রছাত্রী এমনকি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদেরও একটি মিছিল এসেছিলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য।
জনসভা শুরু হতে তখনও অনেক বাকি। বাঁধভাঙা মানুষের স্রোতে দুপুর হতে না হতেই ভরে ওঠে রেসকোর্সের ময়দান। রেসকোর্স বৃহত্তর পরিসর ময়দান পেরিয়ে জনস্রোত ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে কয়েক বর্গমাইল এলাকা জুড়ে। মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়েছে জনসমুদ্রের উত্তাল কণ্ঠ। লক্ষ কণ্ঠে এক আওয়াজ। বাঁধ না মানা দামাল হাওয়ায় সওয়ার লক্ষ কণ্ঠের বজ্র শপথ। লক্ষ হস্তে শপথের বজ্রমুষ্ঠি উত্থিত হচ্ছে আকাশে। বাতাসে পত পত করে উড়ছে বাংলার মানচিত্র অঙ্কিত সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের পতাকা। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্যের সঙ্গে দুলে উঠছে বাঙালির সংগ্রামের প্রতীক লক্ষ লক্ষ বাঁশের লাঠি।
মঞ্চ থেকে মাঝে মাঝেই স্লোগান তুলছেন সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ‘জয় বাংলা’। ‘‘আমার দেশ তোমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘পরিষদ না রাজপথ-রাজপথ রাজপথ’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো। ’ ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো’’ এই হলো রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সভার দৃশ্য।
যে সভায় আমি ছিলাম না। অথচ যেন দেখতে পাই আমি সেখানে ছিলাম। আমিও তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্লোগান দিচ্ছি। বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্য ঠেলেঠুলে মঞ্চের সামনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি। বঙ্গবন্ধুকে একপলক দেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু আফসোস!
এদিকে বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার না করার প্রতিবাদে বেতারে কর্মরত বাঙালি কর্মচারীরা তাৎক্ষণিক ধর্মঘট শুরু করায় বিকেল থেকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বেতার কর্তৃপক্ষ রেসকোর্স থেকে সরাসরি সম্প্রচারের পূর্ব ঘোষণা দিয়ে পরে তা বাতিল করে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার করা হবে এ ঘোষণার পর সারা বাংলার শ্রোতারা অধীর আগ্রহে রেডিও সেট নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। বেলা ২টা ১০ মিনিট থেকে ৩টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ঢাকা বেতারের দেশাত্মবোধক সংগীত পরিবেশন করা হয়। রবীন্দ্র সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমার ভালোবাসি’’ পরিবেশনের পর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার মুহূর্তে আকস্মিকভাবেই ঢাকা বেতারে তৃতীয় অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
সামরিক সরকারের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার না করার প্রতিবাদে ঢাকা বেতারের কর্মীরা কাজ করতে অস্বীকার করলে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধু মঞ্চে ওঠেন ৩টা ২০ মিনিটে। কিন্তু ফাল্গুনের সূর্য ঠিক মাথার উপর ওঠার আগে থেকেই এই স্লোগান চলছে। মঞ্চে মাইকে স্লোগান দিচ্ছেন ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহ্জাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। স্লোগান দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আবদুর রাজ্জাক। স্লোগানের ফাঁকে ফাঁকে নেতারা দিচ্ছেন টুকরো টুকরো বক্তৃতা।
এরপরই স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাইকের সামনে এসে দাঁড়ান। লক্ষ জনতার স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত তখন ঢাকার আকাশ-বাতাস। সে গগনবিদারী স্লোগান চলা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ‘ভাইয়েরা আমার,আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি-’ এই কথা বলে তার ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেন।
ভাষণের এক পর্যায়ে স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে ভাষণের শেষাংশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। ’ মহার্ঘ্য এই বাক্যটি বলতে বঙ্গবন্ধুকে এর আগে প্রায় একশটি বাক্য বলতে হয়েছে। শব্দ উচ্চারণ করতে হয়েছে এক হাজার বিরাশিটি। আর বঙ্গবন্ধুর মাত্র আট সেকেন্ডের ঘোষণায় শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাত্র ১৯ মিনিটের এই ভাষণে ৭ কোটি বাঙালির মনের মণিকোঠায় ছবি হয়ে গেলেন শেখ মুজিব। গড়ে উঠলো দুর্বার ঐক্য, গড়ে উঠলো সংগ্রামী চেতনা। তৈরি হলো জীবন উৎসর্গের প্রেরণা। যেন সেই থেকে ৭ সাত কোটি বাঙালি মানে শেখ মুজিব, ৭ কোটি বাঙালি মানে দেশ প্রেমের আদর্শ সৈনিক। ৭ কোটি বাঙালি মানে সমগ্র বাংলাদেশ।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক সেই ভাষণ ছিলো বাঙালি জাতির জন্য মুক্তির আহ্বান। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে আকাশস্পর্শী তর্জনী উঠিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে দেখিয়েছিলেন মহামুক্তির দূর-দিগন্ত। যে দিগন্তে ছিল আশার আলো। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার দৃপ্ত শপথ।
হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বঙ্গবন্ধু এ জাতিকে দিয়েছেন কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন, নিপীড়ন থেকে মুক্তিকামী মানুষ পেয়েছে বিশ্বের বুকে উন্নতশিরে দাঁড়াবার সম্মান। পৃথিবীতে কেউ কেউ আসেন ইতিহাসের অধ্যায় হতে। বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন ইতিহাস হয়ে। মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাসের পাতায় তার মহৎ কর্মকাণ্ড সংগ্রামী জীবনের ইতিকথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রিয় মাতৃভূমির মাটি, মানুষের ভালোবাসায় তিনি ধন্য। তার কালজয়ী কীর্তি ঐতিহাসিক স্মৃতি হয়ে থাকবে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। পৃথিবীর মানচিত্রে যতদিন পদ্মা-মেঘনা, গোমতী-গড়াই, তুরাগ-তিতাস, মধুমতির অস্তিত্ব থাকবে ততদিন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। খুনিচক্র ভুল করেও ভাবতে পারেনি, জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু বাঙালির হৃদয়ে আরও বেশি শ্রদ্ধার আসন করে নেবেন। জয়তু মুজিব।
মানুষের সাম্রাজ্য তার কল্পনা। এজন্য আমি আমার চিন্তালোকে, কল্পনালোকে, ভাবনালোকে, জ্ঞানলোকে, স্বপ্নলোকে শেখ মুজিবকে দেখি। শেখ মুজিবের ভাষণ শুনি। তার হাত ধরে হাঁটি। তাইতো তার হাত ধরে হাঁটার ইচ্ছেটা স্বপ্ন হয়েই আসে, আসুক। ঐতিহাসিক সেই জনসভায় উপস্থিত হওয়ার বাসনা আকাশ নীলে ভাসুক।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৪ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৭
এএ