নেতাজি ভারতের স্বাধীনতার প্রসঙ্গেই কথাটি বলেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার সাথে রক্তের এ সম্পর্কের ইতিহাসে কোনো দেশকালের ভেদ নেই।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঔপনিবেশিক শাসনের জিঞ্জির ছিঁড়ে রাষ্ট্র তথা জাতীয়তাবাদের চেতনা ও বোধ যতোই জাগ্রত হতে থাকল স্বাধীন রাষ্ট্রচিন্তা ততোই ভিত্তি পেতে থাকল। এর আরেকটি কারণ হচ্ছে, ‘রাষ্ট্র’-র সনাতন ধারণার পরিবর্তন ঘটে গিয়ে নতুন চিন্তা ও ধারণার উন্মেষ। এর সাথে যোগ হয় ‘জাতি-রাষ্ট্র’ চেতনার। ফলে, সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতার কবর রচিত হতে থাকে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে। এরই রেশ ধরে মানচিত্রের এ প্রান্তে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও বৃটিশ ঔপনিবেশিকতার বিদায়।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঠিক জন্মলগ্ন দিন-তারিখের হিসেবে বলা মুশকিল। কোনো জাতীয়তাবাদী চেতনার ক্ষেত্রেই একথা বলা যায় না। কারণ, জাতীয়তাবাদের জন্ম ও বিকাশ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। একটি বিশাল সময়ের ব্যাবধানেই এর বেড়ে ওঠা। তাই আমরা হাজার বছরের ইতিহাস ঘাঁটলেও সেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপাদান খুঁজে পাই। অন্তত: বাঙালি বা বঙ্গাল বা বাঙ্গাল শব্দের উৎপত্তিগত ইতিহাস ঘাঁটলেও তার প্রমাণ মেলে। তবে, নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী জতিরাষ্ট্রে পরিণত হয় রাজনৈতিক ধারাবাহিতকার পথ ধরে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ইতিহাসে সেরকম দুটি রাজনৈতিক ধারবাহিতকতাই হচ্ছে ‘অবিভক্ত ভারত’ (বা ‘বৃটিশ ভারত’) ও ‘পাকিস্তান’।
বলাই বাহুল্য, এ দুটি রাজনৈতিক রাষ্ট্রীয় সত্তার জন্যই বাঙালিকে রক্ত দিতে হয়েছে। ‘বৃটিশ খেদাও’ আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল বাঙালি। এর কারণও রয়েছে। কারণ, বাঙালিদেরই বৃটিশ ভারতে সবচেয়ে বেশি হারাতে হয়েছে। অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনাই বাঙালিকে লড়াকু করেছে। আমরা বৃটিশ-ভারতে মহাত্মা গান্ধীকে দেখি অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন করতে। কিন্তু বাঙালি নেতা সুভাষ বসু, শেরেবাংলাসহ অসংখ্য বাঙালি নেতা-কর্মীই সে আন্দোলনের দ্বীপশিখাটি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। বাঙালি-অবাঙালি সবার রক্তেই বৃটিশ ঔপনিবেশিকতার বিদায়ঘণ্টা বাজে। সুভাষ বসু তাই জেনেবুঝেই রক্ত চেয়েছেন। কারণ, রক্ত দিয়েই স্বাধীনতার পথ রচিত হয়।
রক্তের ওই পথ ধরেই ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম। পরাধীনতার দু’শ বছর পর ১৯৪৭ এর মধ্য আগস্টের মধ্যরাতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র স্বাধীন হলো।
র্যাটক্লিফ (Cyril Radcliffe) একটি মানচিত্র নেহেরু আর জিন্নার হাতে দিয়ে জাহাজে চড়ে বসলেন। লাহোর প্রস্তাবের পথে না হেঁটে ভারত ও পাকিস্তানকে দুই টুকরা করে তারা বৃটিশ পতাকা নিয়ে ডান্ডির পথে রওয়ানা হলেন। ভারত এক টুকরাতেই সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে লাগলো। কিন্তু বাঙালির ওপর একের পর এক রাহু নেমে এলো।
রাষ্ট্রের নাম পাকিস্তান। অথচ জাতি এখানে দুইটি; একদিকে ‘বাঙালি’ আরেক দিকে ‘পাকিস্তানি’ অথবা ‘পাঞ্জাবি’। আমরা তাও মেনে নিলাম। নামে কিবা এসে যায়! কিন্তু পাঞ্জাবিরা তাতেও তুষ্ট নয়। বৃটিশ চলে গেল। মুখের ভাষাটিকেও কেড়ে নিতে চাইল। কিন্তু বাঙালি তো ততদিনে রক্ত দিতে শিখে গেছে। তারা রক্ত দিলো কিন্তু মুখের জবান কেড়ে নিতে দিলো না। রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বার আরো কত নাম! আসলে ঔপনিবেশিকতা চলে গেলেও ঔপনিবেশিকতার ভূত আমাদের ছাড়ল না। বলা হয়, কায়েদে আজম নিজে মনে-প্রাণে-দর্শনে ছিলেন একজন বৃটিশ।
১৯৪৭-এর স্বাধীনতার স্বাদ বাঙালি উপভোগ করতে পারলো না। ৫২’-র ভাষা, ’৬২-র শিক্ষা, ৬৬’-র ছয় দফা, ৬৯’-র গণঅভ্যুত্থান-এর সিঁড়ি মাড়িয়ে বাঙালি একটু একটু করে আবার নতুন করে স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হতে থাকল। ভারত স্বাধীন হলো, পাকিস্তান স্বাধীন হলো, পরাধীন রয়ে গেল কেবল বাঙালি।
পাকিস্তানিরা কোনো সমস্যারই রাজনৈতিক সমাধান চায়নি। তারা সামরিক কায়দায় রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমাদের জন্য সমস্যাটি কেবল রাজনৈতিক সমস্যা ছিল না। এটি আদতে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা ছিল। কারণ, ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত ভাগ হলেও, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অমিল ছিল লক্ষ্যণীয়।
প্রশ্ন আসতে পারে, ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের মধ্যে এমন পারস্পরিক অমিল তো আরো বেশি! তবে ভারত কীভাবে অক্ষত রইলো? ভারত ভাষার ওপর ভাষা, সংস্কৃতির ওপর সংস্কৃতি, গণতন্ত্রের ওপর সামিরিক শাসন ও জনগণের ওপর দু:শাসন চাপিয়ে দেয়নি। জিন্নাহ, খাজা নাজিমুদ্দীন, নুরুল আমিন, লিয়াকত আলী খানরা গণতন্ত্রের পথে হাঁটেননি। কিন্তু ভারতে গান্ধী, আবুল কালাম আজাদ, গোখলেরা গণতন্ত্রের পথে হেঁটেছেন। কায়েদে আজম বলি অথবা কায়েদে মিল্লাত, বাঙালিতেই তাদের যতো আপত্তি। নির্বাচন মানি, কিন্তু ফল মানিনা, গণতন্ত্র মানি কিন্তু গদি ছাড়বো না---এই ছিল পাকিস্তানের বদ খাসলত। কিন্তু বাঙালি তা মানবে কেন? আমরা যে ততদিনে রক্ত দিতে শিখে গেছি।
বাঙালি বৃটিশ খেদিয়েছে রক্ত দিয়ে। পাকিস্তান আদায় করেছে রক্ত দিয়ে। সুভাষ বসু রক্ত চেয়েছেন, অবিভক্ত ভারতবাসী রক্ত দিয়েছে। রক্ত দিয়েছে বাঙালি। ভারত স্বাধীন হলো। কিন্তু বাঙালি স্বাধীন হলো না। তবে কি বাঙালিকে আরো রক্ত দিতে হবে?
বাঙালির আরেক নেতা বললেন সেই কথা---‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্’। সবাই নেতা নন, কেউ কেউ নেতা। জাতির জীবনে তারা আসেন-বছর বছর নয়, বরং জাতির ক্রান্তিলগ্নে, ভ্রান্তিলগ্নে অথবা জন্মলগ্নে। বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতিরাষ্ট্রের জন্মলগ্নের সেই মহাপুরুষ।
কিন্তু বাঙালির যে রক্ত-ইতিহাসের কথা বলে গেছেন সুভাষ বসু ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার শুরুটা কোথায়? নজরুল জানিয়ে দিয়েছেন সেই কথা, ‘ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর/উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার’।
স্বাধীনতার যে সূর্য ডুবে গিয়েছিল রক্তাক্ত প্রান্তরে অথবা গঙ্গায়, তার দু’শ বছর পর গান্ধী-সুভাষের ডাকে রক্তের বিনিময়ে সে সূর্য ভারত-গগনে উদিত হলো। আর তার দুই যুগ পর বঙ্গবন্ধুর ডাকে এ বঙ্গভূমিতে সে সূর্য আবার উঠলো ‘আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার’।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০২ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৭
জেএম/