কিন্তু বাঙালির পরিচয়বাহী এই ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করতে শুরু করলো।
পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ছিল হাজার মাইলের ব্যবধান। মাঝখানে বিশাল ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিভক্ত দুই পাকিস্তান। সেই সাথে অন্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবধানতো ছিলই।
আয়তনের ক্ষেত্রেও দুই পাকিস্তানের মধ্যে পার্থক্য ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ছয়গুণ বড়। ভূ-বৈচিত্র্যগত পার্থক্যও ছিল লক্ষণীয়। ছিল জনসংখ্যার ঘনত্বের পার্থক্যও। ১৯৬১ সালের আদমশুমারির হিসেবে পশ্চিমের জনসংখ্যা ছিল চার কোটি তিরিশ লাখ আর পূর্বের লোক সংখ্যা ছিল পাঁচ কোটি দশ লাখ।
তার মানে পূর্ব পাকিস্তান একদিকে যেমন আয়তনে ছোট, তেমনি তার জনসংখ্যা বেশি। তদুপরি অর্থনৈতিক দিক দিয়েও সে দুর্বল। তার ওপর রাষ্ট্রীয় বৈষম্যযোগে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নাভিশ্বাস অবস্থা। সার্বিক বৈষম্যদৃষ্টে এটাই স্পষ্ট যে পশ্চিমারা আমাদের ওপর এক ধরনের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ চাপিয়ে দিয়েছে। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রায় একই রকম বর্ণনা পাই লে. জেনারেল জে এফ আর জেকবের লেখা ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা-একটি জাতির জন্ম’ বইটিতে।
জেনারেল জেকবের ভাষ্যমতে, ‘১৯৬০ সালে প্রবৃদ্ধির উচ্চতর বার্ষিক হার ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি’। অর্থাৎ, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের কোনো লক্ষ্যণীয় উদ্যোগই পাকিস্তান সরকার গ্রহণ করেনি। ফলে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রেও দেখা দেয় বৈষম্য। অর্থনীতির অপরাপর সূচক বিবেচনায় নিলে বৈষম্যের এ তালিকা পাহাড় সমান।
এরকম হাজারো বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতেই বাঙালি তার ছয় দফা দাবি উত্থাপন করে। জাতির পক্ষে আওয়ামীল লীগ সেই ছয় দফা দাবি পেশ করে। ছয় দফা ছিল মূলত বাঙালি মুক্তির ম্যাগনাকার্টা।
ছয় দফায় প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ছাড়া সব বিষয়ে বাঙালি প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন চেয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তান যেমন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসতে চেয়েছে, ছয় দফায় বাঙালি সে রকম দাবি তুলেনি। পাকিস্তানের মূল সমস্যা ছিল গণতন্ত্রহীনতা। এ সমস্যা পাকিস্তানকে আজও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এই গণতন্ত্রহীনতার জন্যই পাকিস্তান আজও ব্যর্থ রাষ্ট্রের দায় থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
আমরা ছয় দফার প্রথম দফাতেই বললাম, ‘ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের ফেডারেশনরূপে গড়তে হবে। তাতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকবে। সব নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভাগুলোর সার্বভৌমত্ব থাকবে। ’ অন্য পাঁচটি দফাতেও পাকিস্তানকে একটি সফল গণতান্ত্রিক ফেডারেশ হিসেবে গড়ে তোলার দাবি করা হয়।
কিন্তু পাকিস্তানিরা গণতন্ত্রের পথে হাঁটলো না। তারা স্বৈরাচারে পথেই পা বাড়ালো। তারা ছয় দফাকে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করলো। দেশোদ্রোহিতার দায় চাপালো বাঙালির ওপর, শেখ মুজিবের ওপর। একবছর পরেই তারা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ভারতের সহায়তায় সরকার পতন আন্দোলনের সূচনা করার অভিযোগে মামলা দায়ের করে। কিন্তু এ হামলা-মামলাই হলো পাকিস্তানের কাল। কারণ, এই মামলা শেখ মুজিবকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গেলো। বাঙালির স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনকে স্বাধীকার আন্দোলনের দিকে ধাবিত করলো। সে মামলার তোড়ে আইয়ুব খানের গদিও নড়বড়ে অবস্থা।
শেষে আইয়ুব খান বাধ্য হয়ে ১৯৬৯ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে এক গোলটেবিলের আয়োজন করেন। লৌহমানব আইয়ুবের গদির গরম ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে রাওয়ালপিন্ডিতে দাওয়াত দিলেন। সে আলোচনা ব্যর্থ হয়। অবশেষে আইয়ুব দশকের সমাপ্তি ঘটে ও তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। আইয়ুব খান বিদায় বেলাতেও সামরিক সমাধানের পক্ষে ওকালতি করতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘I am left with no option but to step aside and leave it to the defence forces of Pakistan, which today represent the only effective and legal instrument to take over full control of the affairs of the country’।
পাকিস্তানি শাসকচক্র যে কতোটা সামরিক-পূজারি ছিলেন তা আইয়ুবের বিদায়বেলায় বক্তব্য থেকেও পরিষ্কার। তিনি সামরিক শক্তিকেই পাকিস্তানের শেষ রক্ষাকর্তা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। দেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সামরিক শক্তিকেই তিনি আইনগত ও একমাত্র বৈধ কর্তৃপক্ষ মনে করছেন। শুধু তাই নয়, একমাত্র সামরিক কর্তৃপক্ষই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে বলে তার বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের পথ ধরেই তিনি ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেন।
১৯৬৯-এ ইয়াহিয়া ক্ষমতায় এসেই পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এ নির্বাচনে পাকিস্তানের দুই অংশেই আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশ দিতে টালবাহানা করেন। ১৯৭১ এর জানুয়ারিতে তিনি ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের সঙ্গে এক বৈঠক করেন। সেখানে তিনি কৌশলে শেখ মুজিবের সঙ্গে এক চুক্তিতে আসতে চেষ্টা করেন। সেখানে তিনি শাসনকর্মে সামরিক বাহিনী ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার অবস্থানটা যাতে টিকে থাকে সে বিষয়ে একটা বোঝাপড়া করতে চেয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে কৌশলের অংশ হিসেবে তিনি পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে মুজিবকে পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু এটা তার মনের কথা ছিল না। আসলে ভেতরে ভেতরে বাঙালিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ফন্দি আঁটছিলেন। তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের ব্যাপারে কোনো কথা বললেন না। পাকিস্তানে গিয়ে তিনি ভুট্টোকে ঢাকায় পাঠালেন মুজিবের সঙ্গে আপসরফা করার জন্য। কিন্তু তিনিও সেই একই টালবাহানার পথ ধরলেন। ভুট্টোও ব্যর্থ হয়ে ঢাকা ছাড়লেন।
একদিনে আলোচনার নামে টালবাহানা আর অন্য দিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তারা শ্রীলঙ্কা হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য সমাবেশ শুরু করতে থাকে। মার্চের প্রথম থেকেই তারা এ অংশে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। মার্চের ১ তারিখ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য মূলতবি করে দেন। বাঙালির মনে আর কোনো সন্দেহ রইলো না। তারা বুঝলো যে ইয়াহিয়াচক্র শান্তিপূর্ণ উপায়ে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এদিকে তিনি মেজর জেনারেল ইয়াকুব খানকে পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গর্ভণর হিসেবে নিয়োগ দিলেন। এ বিষয়টি বাঙালি ভালোভাবে নিলো না। আওয়ামী লীগ এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গণ-অসহযোগের ডাক দিলো। এবার ইয়াহিয়ার নতুন ফন্দি। তিনি ইয়াকুব খানকে সরিয়ে তার জায়গায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভণর করার ঘোষণা দেন। তিনি ২৫ মার্চ অধিবেশনের তারিখ ঘোষণা করলেন। এই টিক্কা খান বেলুচিস্তানের বিদ্রোহ দমনে নিষ্ঠুরতার জন্য পরিচিত।
টিক্কা খানকে গর্ভণর আর ২৫ মার্চ অধিবেশ -বাইরে এমন ঘোষণার অন্তরালে মূলত বাঙালি নিধনের অপারেশনের নীলনকশা চুরান্ত করা হয়। ইয়াহিয়া খান টিক্কা খানের বেলুচিস্তানের অভিজ্ঞতা ও রাও ফরমান আলীর অভিজ্ঞা কাজে লাগিয়ে বাঙালিকে একটা কঠিন শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা করেছেন তলে তলে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৩ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৭
এএ
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন