এরপর আরও বহুবার ভারতের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। ৩১ মার্চ এরকম একটি আলোচনায় ইন্দিরা গান্ধী আবার লোকসভায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বক্তব্য দেন।
ইন্দিরা গান্ধীর এ দিনের বক্তব্যের একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। এখানে তিনি বলেন, “পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক জাগরণ যে শেষ পর্যন্ত সাফল্য অর্জন করবে, এই সভা সে ব্যাপারে তার দৃঢ় আশাবাদ নথিভূক্ত করছে। এই সভা এই মর্মে তাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে, তাদের সংগ্রাম ও ত্যাগে তারা সবসময় ভারতের জনগণের আন্তরিক সহানুভূতি ও সহযোগিতা লাভ করবে। ”
ভারতের মতো রাশিয়াও এ বিষয়ে তার উদ্বেগের কথা জানায়। ২ এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি চিঠি লিখে গণতান্ত্রিক পন্থায় ও রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের আহবান জানান। পদগর্নি বলেন, ‘সম্মানিত মিস্টার প্রেসিডেন্ট, ঢাকায় আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষিতে সামরিক প্রশাসন চরম ব্যবস্থা গ্রহণকে যথাযথ বলে মনে করেছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে তারা সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করেছে, এই সংবাদে সোভিয়েত ইউনিয়ন শঙ্কিত। ” পাকিস্তানের জনগণের ক্ষয়ক্ষতিতে সোভিয়েত জনগণের উদ্বেগের কথাও জানান পদগর্নি। তিনি আরও বলেন, “সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সমর্থনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার ও নির্যাতনে সোভিয়েত ইউনিয়ন উদ্বিগ্ন। ”
পদগর্নি আরও বলেন, “আমরা সবসময়ই মনে করি, পাকিস্তানে সম্প্রতি যে জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, তার সমাধান অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে এবং সামরিক শক্তির প্রয়োগ না করেই করতে হবে। রাশিয়া অবিলম্বে পাকিস্তানে দমন-পীড়ন বন্ধ করার আহবান জানায়। ” পদগর্নি তার চিঠিতে বলেন, “আমরা আন্তরিকভাবে কামনা করি সম্ভাব্য ন্যূনতম সময়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক। ”
এভাবে ভারত ও রাশিয়া ইয়াহিয়াকে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ বন্ধের আহ্বান জানায়। কিন্তু ইয়াহিয়া আমেরিকা ও চীনের জোরে সে কথায় কান দিতে চাইলেন না। উপরন্তু আরও ব্যাপকভাবে সামরিক শক্তি প্রয়োগ অব্যাহত রাখলেন। ভারত তাই বিষয়টি জাতিসংঘের কাছে নিয়ে যায়। এপ্রিলে ভারত জাতিসংঘকে জানিয়ে দেয়, বাংলাদেশের জনগণের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের নির্যাতন এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে, তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার মনে করে নিশ্চেষ্ট হয় বসে থাকার সময় নেই।
জাতিসংঘের মহাসচিব তখন উ থান্ট। ভারত তার এই উদ্বেগের কথা উ থান্টের কাছে জানান। জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন ভারতের পাঠানো এ চিঠিটি পেশ করেন। মহাসচিব উ থান্টও বিষয়টির ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেন। এ চিঠিটি জাতিসংঘ তথা জোটের সদস্য দেশগুলোর কাছে প্রচার করা হয়। পরে জাতিসংঘের একটি ইশতেহার হিসেবে তা প্রকাশ করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে সংযত না করলে এবং আন্তর্জাতিক অভিমত বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি সহানুভুতি ও সমর্থনসূচক না হলে এই উপমহাদেশে উত্তেজনা ক্রমশই বাড়বে।
এদিকে এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে চীন। এক চিঠিতে সেদেশের প্রেসিডেন্ট চৌ এনলাই বলেন, “Your excellency may rest assured that should the Indian expansionists dare to launch aggression against Pakistan the Chinese government and people will, as always, firmly support the Pakistan government and people in their just struggle to safeguard state sovereignty and national independence.” আমেরিকা ও পাকিস্তানের সঙ্গে একাট্টা হয়ে চীনের প্রেসিডেন্টও এভাবে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধিতা শুরু করেন।
পাকিস্তানকে চীনের সমর্থনের জবাবে ১৪ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক জান্তার প্রতি চীনের প্রকাশ্য সমর্থন আমাদের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আনবে না। ” তিনি বলেন, “We should not interfere in the internal matter of the other countries, what was happening in in East Bengal, could not be described as purely internal affairs of Pakistan.”
৭ মে সকালে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধামন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বৈঠকে বসেন। প্রায় সবাই বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। সবার কথা শুনে ইন্দিরা গান্ধী বললেন যে, বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তার সমর্থন অব্যাহত থাকবে। তবে কূটনৈতিক সহায়তা বা স্বীকৃতি এখনই নয়। অবশ্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবির বিরোধিতা করেন বিকানীরের মহারাজা ড. করণ সিং।
তিনি বাদে ভারতের অধিকাংশ বিরোধীদলীয় নেতাও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে জোর দাবি জানান। তারা বলেন, বাংলাদেশ এক বাস্তব সত্য। স্বীকৃতি দিয়ে ভারতীয় সরকার শুধু সেই সত্যটিতেই মেনে নেবে।
অন্যান্য যেসব নেতা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানানোর দাবি করেন, তারা হলেন- ইন্দ্রজিত গুপ্ত (সিপিআই), একে গোপালন (সিপিএম), কে মনোহরণ (ডিএমকে), অটল বিহারি বাজপেয়ী, চিত্ত বসু, ত্রিদিব চৌধুরী (আরএসপি), এন জি গোরে (পিএসপি) ও এস এন মিশ্র (আদি কংগ্রেস)।
১৫ এপ্রিল ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তান নাম ব্যবহার না করে এর বদলে পূর্ববঙ্গ নামটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতীয় এলাকার মধ্যে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণ এবং কর্তব্যরত সিপাহীদের অপহরণ করার প্রদিবাদলিপিতে এই নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্নে সেসময়কার ভারতীয় একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “সেই পুরাতন স্বীকৃতির প্রশ্নটা মাঝে মাঝে চকিতে আশার রেখা দেখাইয়া যেন মরীচিকার মতো মিলাইয়া যাইতেছে। সরকারের ওপর চাপ প্রবল, প্রায় সমস্ত বিরোধী দল বারে বারে একবাক্যে বলিতেছে, ‘বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিন’। ”
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৭
এইচএ/
আরও পড়ুন
** ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন
** ২৫ মার্চ অধিবেশন! অন্তরালে অপারেশন সার্চ লাইট
** ‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন
** শক্তির ভারসাম্য খেলায় দৃষ্টি যখন বাংলাদেশে
** স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা