ক্রিকেট পাগল এই জাতিকে লাল সবুজের এই দলটা হয়তো প্রত্যাশা অনুযায়ী সেরাটা দিতে পারেনি, কিন্তু যা দিয়েছে এই পর্যন্ত তাই বা কটি খেলা দিয়েছে? কিংবা অন্য কোন সে ক্ষেত্র- যেখান থেকে গোটা জাতি পেয়েছে একযোগে এমন আনন্দের উপলক্ষ?
বরং আছে উল্টো চিত্র। বাঙালির ললাটে একের পর এক কলঙ্ক লেপে দিচ্ছে জঙ্গি কার্যক্রম, প্রশ্নফাঁসের প্রতিযোগিতায় গোটা শিক্ষা খাতকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে একটি চক্র, বখাটেপনা আর কিশোর অপরাধের নতুন নতুন ঘটনা চিন্তায় ফেলে দিয়েছে জাতির ভবিষ্যৎ কান্ডারিদের নিয়ে, যখন তখন জাতিক জিম্মি করছে রাস্তার ড্রাইভার থেকে নিয়ে উচ্চ শিক্ষিত ডাক্তার! এতসব নেতিবাচকতার মাঝে একটু যা ইতিবাচক সে তো এদেশের ক্রিকেট।
শততম টেস্টে বাংলাদেশ যে জয় তুলে আনতে যাচ্ছে সে রোমাঞ্চ অনেকে প্রথমদিন থেকেই অনুভব করা শুরু করেছে। অনেকের ভেতরেই প্রজাপতির নাচন শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রথমদিন থেকেই। এই যেমন কাজী মাসুদ নামে এক বন্ধু ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রথমদিন বিকেলেই লিখেছে সমুদ্রপাড়ে বাঘের গর্জন শুনতে পাচ্ছি’। অনুভূতি জানিয়েছে ফিলিং হোপফুল এভাবে। অর্থাৎ সে আশাবাদী ছিল একেবারে প্রথম থেকেই! কী তাকে আশাবাদী করেছে? অবশ্যই মুশফিকদের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স।
এ বিষয়ে লিখতে গেলে অনেকে আবার মৌমাছির মতো সমালোচনার বাণী দিয়ে হুল ফোটানো শুরু করেন। তাদের অনেকের বিশ্বাস বাংলাদেশ এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি। অর্থাৎ নিয়মিত জয় পাওয়ার পর্যায়ে যায়নি। আমি মোটামুটি নিয়মিতই বলে আসার চেষ্টা করছি, বাংলাদেশ তাদের অতীত ফেলে এসেছে। এই বাংলাদেশ অন্য এক বাংলাদেশ। এরা এখন যে কাউকে, যেখানে সেখানে হারাতে পারে। বেশি না, সবশেষ দুবছরের খতিয়ানটা সামনে মেলে ধরেন, নৈরাশ্যবাদীরা হেরে যাবেন টাইগারদের পারফরম্যান্সের কাছে। হারের চেয়ে জয় কিন্তু বেশি। হ্যাঁ, সেটা ওয়ানডে ম্যাচসহ।
টেস্টেই বা একবারে খারাপ কী খেলেছে? দেশের মাটিতে তো ইংল্যান্ডকে দুই ম্যাচেই ধরাশায়ী করতে করতে শেষ পর্যন্ত এক জয়ে সিরিজ ড্র করল। আজ (১৯ মার্চ) শ্রীলঙ্কার মাটিতে রচনা করলো নতুন ইতিহাস। এর আগে খেলা নিউজিল্যান্ড ও ভারতের মাটিতেও প্রতিটি ম্যাচে জয়ের কাছাকাছি গিয়ে হেরেছে বাংলাদেশ। তা বিদেশের মাটিতে কোন দল কতটা ম্যাচ এখন জেতে? বাংলাদেশের সমস্যা ছিল ধারাবাহিকতায়। সে সমস্যা গত দুই বছরে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপের পর থেকে, এতটাই ওভারকাম করেছে যে, কেউ যদি দুই বছর কোন খোঁজ খবর না নিয়ে থাকেন কোন কারণে, পরসংখ্যান দেখে তিনি লাফিয়ে উঠবেন? আমি নিশ্চিত। তাঁর অনুভূতি হবে- এত ভালো খেলল বাংলাদেশ!
বাংলাদেশের সমর্থকদের আবেগের চেহারাটা বড্ড টালমাটাল মনে হয় আমার কাছে। আজকেই ফেসবুক পাতাটা একটু ওপেন করে দেখুন, শতকরা অন্তত ৯০ জনের বেশি আনেন্দের আতিশয্যে ফেটে পড়ছেন। আমি নিশ্চিত এদের মধ্যেই কেউ কেউ ৮২ রানে আউট হওয়ায় তামিমকে গালি পেড়েছেন! এবং আজ যদি কোনো কারণে বাংলাদেশ হেরে যেত, তাঁরা এগারো জনের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতেন। আমি বুঝি, এগুলো ভালোবাসার গালি। ভালোবাসা যত বেশি তত কটু নিন্দার ভাষা।
তবুও সমর্থক হিসেবে আমাদের কি আরো পরিণত আবেগের পরিচয় দেয়া উচিত নয়? আবার যখন টাইগাররা ঠিকঠাক হুংকার ছাড়েন তখন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এতো গদগদ হয় যে, কে কার চেয়ে বেশি তা প্রকাশ করতে পারে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা লেগে যায়! এর সেরা উদাহরণটা আজই পেয়ে যাবেন। শুধু কষ্ট করে একটু টিভিতে আর পত্রিকায় চোখ রাখতে হবে।
কলম্বোর পি সারা ওভালে যে ইতিহাস আজ লিখেছে টাইগাররা, তা এদেশের অনেক গণমাধ্যমকর্মীর জন্যেও একটা সমুচিত জবাব। এমনকি ২০ বছর সাংবাদিকতা করেও এদেশের অনেক ক্রীড়া সাংবাদিক ঠুনকো বিষয়ে এমন সব সমালোচনার বাণী লিপিবদ্ধ করেন, তা সত্যিই বিস্ময়ের। ক্রিকেটাররা হয়তো তাৎক্ষণিক সংবাদপত্র পড়েন না বা টিভি দেখেন না। কিন্তু নিকটজনের মাধ্যমে খবরটি কিন্তু তার কাছে ঠিকই চলে যায়। ভাবুন তো, একজন ক্রিকেটার যদি সিরিজ চলা অবস্থায় তাকে নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশের খবর পায়, তার মনের অবস্থা কী হয়? কিংবা গোটা দল যখন সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হয় তখন মাঠে তাদের পারফরমেন্সে কি প্রভাব পড়ে না?
ব্যতিক্রমী সংবাদকর্মীও আছেন। আমার মনে হয় বাংলাদেশ দলের সাফল্যে তাদের ইতিবাচক সংবাদের অনেক অবদান আছে। এই যেমন বেসরকারি একটি টেলিভিশনের এক কর্মীকে দেখেছি, এই সফরের প্রতিটা মুহূর্তে ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করেছেন তিনি। প্রজাপতির নাচন তার ভেতরেও সম্ভবত আগে থেকে কাজ করছিল!
প্রজাপতির নাচন’ একটা শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলাম এই টেস্ট শুরুর আগের দিন অন্য একটি লেখায়। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ যেদিন শততম ওয়ানডেতে জিতে যায় ভারতের বিপক্ষে, সেদিন স্টেডিয়ামে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মনের ভেতর প্রজাপতির নাচন শুনতে পেয়েছিলাম! শততম টেস্টেও যেন এক যুগ আগের সেই শততম ওয়ানডের পুনরাবৃত্তি হয় সে প্রত্যাশা নিয়ে লিখেছিলাম। শেষ পর্যন্ত প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি মিলে গেল এক বিন্দুতে!
প্রাপ্তির এই মুহূর্তটা কতটা আনন্দের, কতটা ভালো লাগার, কতটা আবেগে ভেসে যাওয়ার তা একটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। আইডিয়াল স্কুলের ১ম শ্রেণির এক শিশু শিক্ষার্থী বাবার কোলে বসে খেলা দেখছিল। বাবার তালির সঙ্গে সেও তালি দিচ্ছিল আর লাফিয়ে লাফিয়ে বাংলাদেশ-বাংলাদেশ স্লোগান দিচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরপর সে বাবার কাছে জানতে চাচ্ছিল বাবা, আর কত রান, আর কত রান? অফিস ফাঁকি দিয়ে খেলা দেখতে বসা তার বাবা প্রতিবারই ধৈর্য ধরে তার উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন- এই যে বাবা আর ৪০ রান, আর ৩০ রান এভাবে।
পরে যখন ম্যাচ জিতে গেল বাংলাদেশ, শিশুটি তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, আর খেলা নেই’। বাবা বললেন, আজ তো আর নেই। সে খানিকটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বললো, কেন নেই বাবা, আমি তো আরো খেলা দেখতে চাই। শিশুর মনস্তত্ত্বে একটা জয় আর তার উচ্ছ্বাস কতটা প্রভাব ফেলেতে পারে তা এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। আজকের শিশু যদি আগামীর ভবিষ্যত হয়, এ শিশুর জন্য এমন অমালীন হাসি আর আনন্দ উপহার দেয়াটাও আজকের শততম টেস্ট জয়ের আরেকটি প্রাপ্তি।
শততম টেস্ট জয়ের এই প্রাপ্তি তাই বহুমুখী। মাঠের বাংলাদেশ দলকে যেমন এই জয় দিয়েছে অপরিসীম সাহস আর অনুপ্রেরণা, তেমনি মাঠের বাইরের ৫৬ হাজার বর্গমাইলেও এটি দিয়েছে শান্তির পরশ, দিয়েছে স্বস্তি। ১৬ কোটি মানুষের ঠোঁটে আজ লেগেছে হাসির ঝিলিক। আজ গোটা বাংলাদেশ হাসছে। হাসছেন অফিসের বস-কর্মচারি, হাসছেন হাসপাতালের রোগী-চিকিৎসক, হাসছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এমনকি হাসছেন কারাগারের কয়েদিও।
এই যে হাসির উপলক্ষ গোটা জাতি পেল, বড্ড প্রয়োজনীয় সময়ে, এটা কিন্তু ক্রিকেটারদের মুষ্টিবদ্ধ প্রতীজ্ঞারই ফসল। জাতিকে হাসি-আনন্দের উপলক্ষ এনে দিতে সাকিব-মুশফিকরা প্রতিটি মুহূর্ত লড়াই করেন ২২ গজে। নিজের যদি এতটুকু কমতি হয়ে যায়, তা নিয়ে ভোগেন অনুশোচনায়। বিশ্বাস হয় না? আজকের খেলাটা আবারো দেখুন।
মুশফিকের বিরুদ্ধে যখন একটা এলবিডব্লিউ আউটের সিদ্ধান্ত এলো- যে বলটি তিনি না খেলে ছেড়ে দিয়েছিলেন, শতভাগ রক্ষণাত্মক খেলা, কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি এটি প্যাডে আঘাত করবে-সেই সময়ে তার চেহারার দিকে একটু তাকান, আবার তাকান, তারপর আরেকবার তাকান-হেলমেটের লোহার বেষ্টনির ফাঁক গলেও আপনি দেখতে পাবেন, একরাশ দুশ্চিন্তায় ফুলে ফুলে ওঠা কপালের ভাঁজ!
এই দুশ্চিন্তা কার জন্য, কিসের জন্য? আশার ভেলায় ভেসে টিভির সামনে বসা ১৬ কোটি মানুষের জন্য নয় কি? কী হবে ব্যক্তি মুশফিকের, যদি সে আউট হয়ে যায়? কিন্তু দল তো হেরে যাবে, মানুষের আশা তো ডুবে যাবে- অধিনায়কের কপালের প্রতিটি ভাঁজের ভাষা কি এটি নয়? এই ভাষাহীন ভাষা কি আমরা পড়তে পারি?
সুতরাং আসুন আমরা আমাদের স্বপ্নসারথিদের সাহস দিই, ভালোবাসা দিই- যেন তারা আমাদের আরো বেশি বেশি হাসি আনন্দের উপলক্ষ এনে দিতে পারেন, আমরা যেন আরো বেশি করে লাফাতে পারি, লাফিয়ে লাফিয়ে যেন খাট-সোফা সব ভেঙে ফেলি! জঙ্গিবাদের অন্ধকারসহ শত নেতিবাচক খবরের মাঝে দু’একটা খবর যেন আমরা পড়ি বিজয়ের, জয়ের উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার! জয়তু টাইগারস।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৯ ঘণ্টা, ১৯ মার্চ, ২০১৭
এমআরএম/এমআরপি