মুক্তিযুদ্ধে চীনের ভূমিকা নিয়ে মিত্র বাহিনী একরকম বিভ্রান্তির মধ্যই যুদ্ধ চালিয়ে যায়। মার্কিনিরাও এখানে নতুন মাত্রা যোগ করে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিনগুলোতে মুক্তিসেনারা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি সত্যি। কারণ, তখন যুদ্ধ-ট্রেনিং ও অস্ত্র কোনোটিই তাদের ছিল না। কিন্তু দিন যতই গড়াতে থাকে, পরিস্থিতি ততই মুক্তিসেনাদের অনুকূলে আসে।
জুন-জুলাই থেকেই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। সেপ্টেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী আরও শক্তিশালী অপারেশন শুরু করে। এ আক্রমণগুলো আগের তুলনায় অনেক সংগঠিত ও কার্যকর ছিল। অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের ফলেই রণাঙ্গনের চিত্র দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। এর ফলে ঢাকায় অবস্থানরত পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তা ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মনোবল একেবারে ভেঙে যায়।
এদিকে পাকিস্তান তার পক্ষে কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যায়। পাকিস্তানের প্রধান মিত্র ছিল চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা তেমন কোনো কাজে আসছিল না। কারণ, পাকিস্তান ব্যাপকভাবে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে পারেনি। জাতিসংঘ ও চীনের সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলপ্রসূ হয়নি। তারা চীনের কাছ থেকে ভারতে আক্রমণ করার জন্য কোনো প্রতিশ্রুতি আদায় করতে সক্ষম হয়নি। ভারত পাকিস্তানকে আক্রমণ করলে চীনের তরফ থেকে ভারত আক্রমণের কোনো নিশ্চয়তা পেতে তারা ব্যর্থ হয়।
আসলে মুক্তিযুদ্ধে চীনের ভূমিকা ছিল অনেকটাই রহস্যময়। তাই চীন প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তান কেউ সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। ভারতের জেনারেল জ্যাকব তার ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’য় এর কারণ হিসেবে চীনাদের সহজাত প্রজ্ঞার দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, ‘চীন হয়তো বাংলাদেশের আসন্ন স্বাধীনতার বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছিল। তাই তারা এই নতুন দেশের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়নি। ’
জেনারেল জ্যাকব তার বইয়ে আরও বলেন, ‘চীনের মতো যুক্তরাষ্ট্রও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় আগে থেকেই অনুধাবন করেছিল। ’ হেনরি কিসিঞ্জারকে উদ্ধৃত করে জ্যাকব বলেন, ‘পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক স্বায়ত্বশাসন যে অবধারিত, এটা কিসিঞ্জার ব্যক্তিগতভাবে ভারতকে জানিয়েছেন। ’
যদিও দিল্লিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিং নিউইয়র্কে হেরাল্ড ট্রিবিউনকে যে সাক্ষাৎকার দেন (৬ জানুয়ারি ১৯৭২) তাতে এ ধরনের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে জেনারেল জ্যাকব ওয়াশিংটনে তদানীন্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল কে ঝাঁকে এই প্রশ্ন করলে তিনিও এ ব্যাপারে তার অজ্ঞতা প্রকাশ করেন। (৭ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ প্রদত্ত কিসিঞ্জারের প্রেস ব্রিফিং এবং কেনেথ কিটিংয়ের মন্তব্য)
রাষ্ট্রদূত কিটিং ওই সময় ফোর্ট উইলিয়াম পরিদর্শন করেন। সে সময় আর্মির কমান্ডার ট্যুরে থাকায় কিটিংকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি –বিশেষত শরণার্থী সমস্যা ও পাকিস্তানিদের ব্যাপক নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত করেন জেনারেল জ্যাকব।
কিটিংকে জেকব বলেন, ‘আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশের সরকার (যুক্তরাষ্ট্র) কেন একটি নিষ্ঠুর উৎপীড়নকারী সামরিকতন্ত্রকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, যারা পূর্ব-পাকিস্তানের নির্বাচনের ফলাফলকে সম্পূর্ণ অসম্মান করেছে। ’
জেনারেল জ্যাকব বলেন, ‘কূটনীতিক হিসেবে কিটিং ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র ও মার্জিত। তার সংবেদনশীল মুখ একটু লাল হয়ে উঠলেও তিনি আমরা কথায় বিরক্তি প্রকাশ করলেন না বা তার সরকারের অবস্থানের পক্ষেও কোনো কথা বললেন না। সম্ভবত স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিক্সনের পাকিস্তান-প্রীতির বিরোধিতা করার মতো ঘনিষ্ট ছিল না। ’
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৩৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৭
এইচএ/
আরও পড়ুন
** নিক্সন-কিসিঞ্জারের ‘ড্রেস রিহার্সেল’
** ইন্দিরা গান্ধীকে সাফল্যের নিশ্চয়তা জেনারেল মানেক শ’র
** নিক্সনের কাছে ইয়াহিয়ার নালিশ
** টিক্কা বললেন, আমরা আগে গুলি চালাইনি
** ‘টাইগার নিয়াজী’ হয়ে গেলেন ‘বাংলার শৃগাল’
** ইয়াহিয়াকে নিকোলাইয়ের হুমকি, সমর্থন চৌ এনলাইয়ের
** ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন
** ২৫ মার্চ অধিবেশন! অন্তরালে অপারেশন সার্চ লাইট
** ‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন
** শক্তির ভারসাম্য খেলায় দৃষ্টি যখন বাংলাদেশে
** স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা