৩৩২ পৃষ্ঠার বইটিতে বঙ্গবন্ধুর ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত কারাস্মৃতি স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৯৮তম জন্মদিন উপলক্ষে আত্মজীবনীর এই দ্বিতীয় গ্রন্থটি চলতি বছরের ১৭ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।
বইয়ের এক জায়গায় জাতির জনক বলেছেন, “মার খাও। তোমাদের জাত ভাইয়ের লাঠির বাড়ি ও বন্দুকের গুলি খাও। জেল-জুলুম তোমাদের কপালে আছে। কারণ তোমরা তো পরাধীন বাঙালি জাতি। লেখাপড়া করতে ইচ্ছে হয় না। সময়ও কাটে না। জেলে রাতটাই বেশি কষ্টের। আবার যারা আমার মতো একাকী নির্জন স্থানে থাকতে বাধ্য হয়- যাকে ইংরেজিতে বলে Solitary Confinement- তাদের অবস্থা কল্পনা করা যায় না।
তিনি আরও বলেছেন, ‘‘আমার ওপর সরকারের কড়া নজর। জেলের ডিআইজি সাহেবকে বলেছি, জেলের আইন ভেঙে আমাকে একা রেখেছেন। জেল আইনে কাউকে বিনা অপরাধে Solitary Confinement করে রাখার নিয়ম নেই। এটা আইন বিরুদ্ধ, তবুও আপনারা আইন ভঙ্গ করে চলেছেন’’।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার একটা ছোট্ট উদাহরণ হলো, Solitary Confinement।
ছয়দফা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অনন্য এক স্থান দখল করে আছে। যিনি এই ইতিহাস রচয়িতা তার মুখ থেকে এই ইতিহাসের গল্প শোনা বা পড়া এক অন্যরকম অনুভূতি জাগায়। আমি এখানে কারাগারের রোজনামচা থেকে কিছু ইতিহাস তুলে ধরছি মাত্র।
বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘‘সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম রাতে কয়েকজন গ্রেফতার হয়ে এসেছে। বন্দি, সিপাহীরা আলোচনা করছে। ব্যস্ত হয়ে গেলাম; বুঝতে বাকি রইলো না আওয়ামী লীগের নেতা এবং কর্মীদের নিয়ে আসা হয়েছে, ৭ জুনের হরতালকে বানচাল করার জন্য”।
বঙ্গবন্ধু এসময় কিছু রাজনীতিবিদের মুখোশও খুলে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, “এক অভিনব খবর কাগজে দেখলাম, মর্নিং নিউজ কাগজ ন্যাপ নেতা মি. মশিয়ুর রহমানের ফটো দিয়ে একটা সংবাদ পরিবেশন করেছে। ইত্তেফাক ও অনান্য কাগজেও খবরটি উঠেছে। তিনি ছয়দফার দাবি নিয়ে তার মতামত দিয়েছেন। তার মত- ছয়দফা কর্মসূচি কার্যকর হলে পরিশেষে এটি সমস্ত দেশে এক বিচ্ছিন্নতাবাদ জাগিয়ে তুলবে। এমনকি তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হতেন, তাহলে ছয়দফা বাস্তবায়িত হতে দিতেন না’’।
৭ জুন ১৯৬৬ সালের হরতাল:
কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে খবর আসলো দোকানপাট, গাড়ি, বাস, রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলছে। এই সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাচ্ছে। আবার খবর এলো টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে, লাঠিচার্জ হয়েছে সারা ঢাকায়। ১২টার পর খবর পাকাপাকি পাওয়া গেলো হরতাল হয়েছে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয়দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, কৃষকের বাঁচার দাবি তারা চায়- এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেলো। বিকেলে আবার গুজব শুনলাম গুলি হয়েছে, কিছু লোক মারা গেছে। ১৪৪ ধারা দেওয়া হয়নি, গুলি চালাবে কেন? একটু পরেই খবর এলো ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। ছয়দফা যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি- পশ্চিমা উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকশ্রেণি যে আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরিব জনসাধারণকে শোষণ বেশি দিন করতে পারবে না, সে কথা আমি এবার জেলে এসেই বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে ৭ জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রাম, গ্রামের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফেটে পড়েছে, কোনো শাষকের চোখ রাঙানি তাদের দমাতে পারবে না। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য শাষকশ্রেণির ছয়দফা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র তৈরি করা উচিত। যে রক্ত আজ আমার দেশের ভাইদের বুক থেকে বেরিয়ে ঢাকার পিচঢালা কালো রাস্তা লাল করলো সে রক্ত বৃথা যেতে পারে না।
ছয়দফা থেকে ৮ দফা:
জহিরুদ্দিনের ইচ্ছে আর সালাম সাহেব চান পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএমে যোগদান করুক। যেভাবে পিডিএম প্রস্তাব গ্রহণ করেছে তাতে আছে ৮ দফার বিপরীত কোনো দাবি করা যাবে না। অর্থ হলো, ৬ দফা দাবি ছেড়ে দিতে হবে। আমি পরিষ্কার আমার ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। ৬ দফা ছাড়তে পারবো না । যেদিন বের হবো ৬ দফারই আন্দোলন করবো। এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে ৬ দফা আন্দোলনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের এই অনমনীয় ও আপসহীন মনোভাবই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল। আমাদের দেশের ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে ছয়দফা আন্দোলন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা নেই। কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি, কারাগারের রোজনামচা বইটি থেকে ছয়দফা আন্দোলনের পুরোপুরি ইতিহাস বাংলাদেশের সব শ্রেণির ইতিহাস বইতে সংযুক্ত করা হোক।
পরিশেষে এটুকু বলতে চাই, কারাগারের রোজনামচা বইটি পড়ে আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প পড়ার পর যে অনুভূতি হয়, ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’, ঠিক সেরকম অনুভূতি হয়েছে।
লেখক: নাট্যকার ও এনজিওকর্মী।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৭
আইএ