সাংবাদিক বন্ধুরা বিষয়টিকে যথাযথভাবে তুলে ধরায় সংশ্লিষ্ট সবার নজরে তা ভালোভাবেই এসেছে। আর সরকার রাষ্ট্রীয় চ্যানেলে এই দুর্যোগের বিষয় অবগত হয়ে গরিব-দুঃখী মানুষের দুর্দশা লাঘবে পদক্ষেপ নিচ্ছে।
হাওরবাসীর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক। প্রকৃত পরিমাণ গবেষণার মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে। তবে সংবাদ মারফত খবর থেকে জানা যায়, ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যদি তাই হয়, এ কদিনের ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হবে বলে ধারণা করা যায়।
দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বন্যায় সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের ৬২টি উপজেলায় ৫শ ১৮টি ইউনিয়নের আট লাখ ৫০ হাজার ৮৮টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুই লাখ ৪৯ হাজার ৮শ ৪০ হেক্টর জমির বোরো ফসল নষ্ট হয়েছে এবং ১৮ হাজার ২০৫টি বাড়িঘরের ক্ষতি হয়েছে। এসব এলাকায় ত্রাণ বিতরণের জন্য ৫শ ৮৭টি ত্রাণকেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইতোমধ্যে চার হাজার ২শ ২৪ মেট্টিক টন জিআর চাল এবং দুই কোটি ২৫ লাখ ৯৭ হাজার টাকা মানবিক সাহায্য হিসেবে দুর্গত ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভিজিএফ কর্মসূচিও চালু করা হয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমের খবর।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২৯ মার্চ থেকে ০১ এপ্রিল পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টিপাতে এসব হাওরে ১৫-১৬ফুট পর্যন্ত পানি বেড়ে যায়। ফলে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরূপ অবস্থায় হাওর রক্ষা বাঁধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনো অন্যায়-অনিয়ম পাওয়া গেলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের মানুষ বহু বছর থেকে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সংগ্রাম করে ফসল উৎপাদন করে আসছে। এবার অকালে হঠাৎ করে বন্যা শুরু হওয়ায় হাওরবাসী মানুষ একটু বেশি বিপাকে পড়েছে। এবার ফসলহানি ছাড়াও বিস্তীর্ণ হাওরের মাছ শেষ হয়ে যাচ্ছে।
হাওর রক্ষাবাঁধ নির্মাণে কারও গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি ৩০ এপ্রিল দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বন্যাদুর্গত হাওর এলাকা পরিদর্শনকালে সারজমিনে বন্যা পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করে দুর্গতদের কষ্ট লাঘবের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেন। কিছুদিন আগে মহামান্য রাষ্ট্রপতিও কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ পরিদর্শন করে গেছেন।
এদিকে, বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ২৪ এপ্রিল নেত্রকোণার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় মন্ত্রী ও সচিবরা জেলার কর্মকর্তাদের সরেজমিনে বন্যা এলাকা ঘুরে এসে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দেন।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, হাওরের মানুষের জন্য সময়টি খারাপ হয়েছে নানা কারণে। হাওরের কৃষকরা বস্তুত মহাজনি ঋণের জালে বন্দি থাকেন। ব্যাংকের চেয়ে অনেক বেশি সুদে তারা জমি চাষের জন্য কার্তিক মাস থেকেই ঋণ নিতে থাকেন। মহাজনদের এ ঋণ শোধ করা হয় ধানে। মহাজন ও ব্যাংক থেকে উত্তোলিত ঋণ কেবল চাষাবাদের জন্য নয়, সাংসারিক ও ব্যক্তিগত অনেক কাজেই তা ব্যবহৃত হয়। ধান কাটার পর কৃষক ঋণ পরিশোধ করেন। আবার নতুন করে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। দীর্ঘকাল ধরে এ অবস্থা বিরাজ করছে।
সুনামগঞ্জ হাওর অঞ্চলের মানুষের ব্যবসায়ও মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে। বলতে গেলে তাদের আর্থ-সামাজিক জীবন আজ অনেকটা বিপর্যস্ত। কৃষকের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের দাবি, গৃহীত ঋণের সুদ যেনো মওকুফ করা হয়। সুনামগঞ্জ প্রায় ২৫ লাখ মানুষের জেলা। বছরে তাদের মোট খাদ্যচাহিদা চার লাখ ৫০ হাজার মেট্টিক টন। গত বছর তারা উৎপাদন করেছেন প্রায় নয় লাখ মেট্টিক টন। বাংলাদেশের খুব কম অঞ্চলেই এতো বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত ধান উৎপন্ন হয়। এই ধান উৎপন্ন হয় সুনামগঞ্জ সুনামগঞ্জের হাওরে। এবার এক লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে ধান লাগানো হয়েছিল; কিন্তু বলতে গেলে পুরোটাই নষ্ট হয়েছে। অবশ্য অপেক্ষাকৃত কিছু উঁচু জমিতে (৫০ হাজার হেক্টর) ধান লাগানো হয়েছে। তবে সেসব জমিতে এবার কেমন ফলন হয় তা দেখার বিষয়।
হাওর অঞ্চলের মানুষের প্রতি আমার আলাদা টান রয়েছে। তাদের অনেকের সঙ্গে আমার রয়েছে ব্যক্তিগত জানাশোনার সম্পর্ক। আমার এক সহকর্মীর বাড়ি নেত্রকোণা জেলায়। বলতে গেলে প্রতিদিনই দাফতরিক কাজের বাইরে ব্যক্তিগত অনেক প্রসঙ্গে আলাপ হয়। কিছুদিন আগে তিনি কথা প্রসঙ্গে জানালেন, আমরা ভাইরা মিলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কামলা খাটিয়ে পারিবারিক জমির চাষাবাদ করেছিলাম। ভেবেছিলাম, এবার ভালো ফলন পাবো। কিন্তু অকাল বন্যায় সব স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জ অঞ্চলের মানুষের অবস্থা তো আরও খারাপ। এ অঞ্চলের পরিচিতদের কথা হলো, বন্যায় আমাদের সবকিছু নিয়ে গেছে, বাস্তবতা আমাদের জন্য বড়ই কঠিন। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে সুনামগঞ্জের মানুষ দিনাতিপাত করছে। ভবিষ্যতই বলে দেবে তাদের প্রকৃত ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ব্যক্তিগত জীবনের কিছুটা স্মৃতিচারণ করতে হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখার পাঠ শেষ হওয়ার পর প্রায় এক বছর বেকার জীবনই কাটাই। সেসময়ে ধান ব্যবসাতে মনোনিবেশ করি। আমার দুলাভাই জনাব আব্দুল লতিফ চৌধুরী দিলদরিয়া মানুষ। তার অনুপ্রেরণায় ধান ব্যবসাতে আমার যোগদান। পার্টনার হিসেবে আরও ছিলেন মজিদ মিলের ম্যানেজার মো. সাইফুল্লাহ। আমাদের ধান-চালের ব্যবসা ভালোই চলছিল। এক পর্যায়ে ১৯৯৪ সালের কোনো একদিন সরাসরি মহাজনদের কাছ থেকে ধান কেনার জন্য সুনামগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়। কৃষক ও গ্রামের মহাজনদের ব্যবহার আমাদেরকে মুগ্ধ করে। তাদের কথা আজও আমার মনে রয়েছে। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার পথে জাউয়া বাজারের কাছে পৌঁছাতেই টেপি চালের ভাতের ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে আসে। বাজারে নেমে দেখি হোটেলগুলোতে মানুষজন টেপি চালের ভাত মাছ দিয়ে খাচ্ছে, এ ঘ্রাণে মুগ্ধ হয়ে আমিও লোভ সামলাতে পারলাম না। খুব একটা খিদে না থাকা সত্ত্বেও আমিও তাদের সঙ্গে আয়েশ করে হোটেলে খাই। তাও আজ মনে পড়ছে।
হোটেলে খেয়েদেয়ে আবার সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে ধানী ফসলি জমি ঘুরে দেখতে গেলাম। অনেকটা রাস্তা হাঁটার পর বিশ্বম্বরপুর উপজেলার মহাজন বাড়িতে যাই। মহাজন ভদ্রলোক অনেক সমাদর করে খাওয়ালেন। আপ্যায়ন শেষে ব্যবসায়িক আলাপের পর সিলেটে ফিরে আসা হয়।
এ অভিজ্ঞতা আমাকে হাওর অঞ্চলের সঙ্গে মেলবন্ধন রচনা করে দেয়। ফলে, আজ একটু দূরে থেকেও তাদের দুর্গতির অবস্থাটা সম্যক উপলব্ধি করতে পারি। জাতীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে তাদের অবদান কোনো অংশে কম নয়। গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত কৃষির উপর নির্ভর।
হাওরের উন্নয়ন ও গবেষণা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর মতে, হাওর অঞ্চলের ক্ষতির প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতির উপর। দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে (জিডিপি) হাওরের অবদান ছয় শতাংশ। ব্যক্তি, সমাজ, পারিবারিক জীবন হাওর অঞ্চলের ধান থেকে আয়ের উপর নির্ভরশীল। তাইতো দেখা যায়, গ্রাম থেকে শহরাঞ্চলে কাজ করতে আসা জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ধান কাটার মৌসুমে গ্রামের বাড়িতে কিছুদিনের জন্য চলে যায়। ধান কেটে সাময়িক সময়ের বাড়তি আয় শেষে তারা আবার শহরে স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরে আসে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন হাওরবাসীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সরকার অসহায় হাওরববাসীকে বিপদমুক্ত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। সমাজের ধনী অংশকেও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যবসায়ী শিল্পপতি, পেশাজীবী, ব্যাংক, বীমা, অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদের হাওরবাসী বিপন্ন মানুষের পাশে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন, দেশি ও বিদেশি উন্নয়ন সংস্থার ভূমিকাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আশাকরি সরকারসহ সবার সম্মিলিত প্রয়াসে হাওরবাসী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা অচিরেই লাঘব হবে। তারা মূল জীবনধারায় আবার ফিরে আসবেন।
সৈয়দ ছলিম মোহাম্মদ আব্দুল কাদির
অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩২ ঘণ্টা, মে ০৩, ২০১৭
এসএনএস