নব্বুই দশকের শুরুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে তাঁকে পেয়েছিলাম। মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন বর্ণাঢ্য মানুষেরা শিক্ষকতায় যুক্ত ছিলেন। প্রফেসর আরআই চৌধুরী, সিকান্দার খান, আলী ইমদাদ খান, হামিদা বানু, মর্তুজা বশীর, জিয়া হায়দার, হায়াত হোসেন, মনিরুজ্জামান আরো কতজন! সমাজবিজ্ঞান বা হিসাব বিজ্ঞান অনুষদের জন্য আলাদা ভবন তখনো তৈরি হয়নি। পুরাতন কলা ভবনে বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগগুলো ছাড়া অন্য সকল বিভাগের ক্লাস আর শিক্ষকদের বসার জায়গা নির্ধারিত ছিল। বিজ্ঞান অনুষদের ছিল আলাদা ভবন। পুরাতন কলা ভবনে অনেক চাপাচাপি ছিল। আর ছিল স্থান সঙ্কুলানের সমস্যা। তারপরও সকলের মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণ উন্মাদনায় সেইসব দিন ছিল অনেক বেশি আন্তরিক, রঙিন এবং প্রাণবন্ত। সকলের মধ্যে যোগাযোগ আর আদান-প্রদান ছিল নিবিড় ও হৃদয়ছোঁয়া।
আমার কর্মক্ষেত্র কলা ভবনের তিন তলার রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে যাতায়াত করি প্রথম তলার চারুকলা বিভাগের পাশ দিয়ে। চারুকলায় তখন শিল্পকলা ও নাট্যকলা নামে দুটো গ্রুপ ছিল। এখন অবশ্য অনেকগুলো আলাদা বিভাগ ও স্বতন্ত্র ইন্সটিটিউট হয়েছে। তখন নাটকের দিকগুলো দেখতেন জিয়া হায়দার ও রহমত আলি। শিল্পকলার মধ্যে প্রিন্টিং, পেইন্টিং, গ্রাফিক্স, ভাস্কর্য ইত্যাদি বিভাগগুলো সামলাতেন মতুর্জা বশীর, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, আবুল মনসুর, মিজানুর রহিম, ফয়েজুল আজিম জ্যাকব ও তরুণতম ঢালী আল মামুন। সকালে ক্লাসের ফাঁকে কিংবা দুপুরে লাঞ্চের সময় নানা বিভাগে কর্মরত শিক্ষকদের সবাই মিলিত হই টিচার্স লাউঞ্জে। আড্ডা, আলোচনা, কথা, তর্ক, বিতর্ক ইত্যাদিতে চারপাশ ভরে থাকে। নিত্য অনুভব করি বহমান আলোর বন্যা।
নিজের লেখালেখির সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পী ও সাহিত্যিক ঘরানার অধ্যাপকদের সঙ্গে ঘনিষ্টতা হতে বিলম্ব হয় না। ততদিনে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ফলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ছড়ানো-ছিটানো সহকর্মীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করতেই হয়। পেশাগত যোগাযোগ ও সম্পর্কের বাইরেও কারো কারো সঙ্গে হৃাদিক সংযোগ সাধিত হয়। সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ তেমনই একজন। ঋজু, অকপট, প্রতিবাদমুখর চরিত্রের জন্য তিনি শুধু আমারই নন, সকলের শ্রদ্ধা, সমীহ ও মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তাঁকে ভালোবাসার ও পছন্দ করার লোকের অভাব ছিল না ক্যাম্পাসে।
ক্যাম্পাসে বা তাঁর বাসায় নিয়মিত যোগাযোগ ও আড্ডা-আলোচনায় মিলিত হয়ে লক্ষ্য করেছি, তাঁর মধ্যে বিরাজমান প্রবল দ্রোহ। কোনো অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজন বা অঞ্চলপ্রীতি তিনি মোটেও বরদাশত করতে না। অনেকের মতো মিনমিনে প্রতিবাদ করে দায় সারতেন না তিনি। অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি সংক্ষোভে ফেটে পড়তেন। প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতেন। প্রয়োজনে আইন-আদালতের আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠিত হতেন না। আমার মনে হয়েছে, মজ্জাগত দিক থেকে আপাদমস্তক-প্রতিবাদী ছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে ‘অপরাজেয় বাংলা’র মতো প্রতিবাদমুখর-দ্রোহী ভাস্কর্য নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। ঘটনাবহুল সে নির্মাণকালের পরতে পরতেও নানা কাহিনি রয়েছে। যেখানেও তাঁর দ্রোহ ও সংক্ষোভ লুক্কায়িত থাকেনি। শিল্পীর স্বাধীনতা ও স্বকীয়তার প্রশ্নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেই আপোসহীনভাবে ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন তিনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি বেশ কিছু শৈল্পিক কাজ করেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গাতেও তাঁর অনেকগুলো নান্দনিক শিল্পকর্ম রয়েছে। প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রেই তিনি ভুল সমালোচনা বা অন্যায় হস্তক্ষেপকে পরাজিত করেই বিজয়ী হয়েছেন। শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে আরোপিত পরামর্শ বা কারো বায়না নয়, শিল্পীর স্বপ্ন, কল্পনা ও স্বাধীনতাই যে শেষ কথা, এই বিশ্বাস তাঁর পুরোপুরিই ছিল এবং সেই বিশ্বাসের বাস্তবায়নে তাঁর ছিল অনমণীয় দৃঢ়তা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তেমন শির-উঁচু-করা উদাহরণ অনেক ক্ষেত্রেই রেখেছেন। এবং এই শক্ত-পোক্ত মেরুদণ্ডের জন্য তিনি মানুষ হিসাবে বিশিষ্টতা এবং সকলের শ্রদ্ধা ও মর্যাদা অর্জন করেছেন। বাংলাদেশের ভাস্কর্য চর্চার ইতিহাসে তাঁর নাম অবশ্যই অম্লান হয়ে থাকবে এবং সেটা থাকবে সকলের চেয়ে আলাদাভাবে। তাঁর ঐতিহাসিক ও বিশিষ্ট শিল্পকর্মসমূহ এবং অনন্য ব্যক্তি-চারিত্র্যের কারণেই তিনি সকলের মধ্যে আলাদা ও অগ্রগণ্য হয়ে থাকবেন। থাকবেন বাংলাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসের স্বর্ণালী অংশ হয়ে।
দ্রোহী-শিল্পী আবদুল্লাহ খালিদকে যারা কাছ থেকে অন্তরঙ্গ আলোকে দেখেছেন, তারা জানেন, কতটা অবৈষয়িক, উদাসীন, আনমনা ও আবেগপ্রবণ ছিলেন তিনি। জীবন-যাপনে রোমান্টিক ও বোহেমিয়ান ধরনের ছিলেন তিনি। ছিলেন বেখেয়ালি। আর ছিলেন প্রচণ্ড মুডি। না বললে না, হ্যাঁ বললে হ্যাঁ, এমন ছিল তাঁর চারিত্রিক দৃষ্টান্ত। চেপে ধরে বা তদবির করে তাঁকে দিয়ে কিছু করানো ছিল অসম্ভব। অথচ অন্তর্গত সত্তায় তিনি ছিলেন সরল, শিশুর মতো, প্রাণখোলা। সবার সঙ্গে মিশতেন না। যাদের সঙ্গে মিশতেন, হৃদয়-মন উজাড় করেই মিশতেন।
কাছে থেকে দেখেছি শিল্প ও কবিতার প্রতি অন্তঃপ্রাণ ছিলেন তিনি। ভালো শিল্পকর্ম ও কবিতার সমঝদারিতে মোটেও কসুর করতেন না। প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রতি তাঁর ছিল অপরীসীম মায়া ও ভালোবাসা। চট্টগ্রাম শহরের মেহেদীবাগে তাঁর বাসায় অসংখ্য ক্যাকটাসের সংগ্রহ ছিল। বারান্দায়, ড্রয়িং রুমে, খোলা জায়গায়, মাটিতে বা ঝুলন্ত ক্যাকটাসে ভরে ছিল তাঁর পুরো বাড়ি। বহু প্রজাতির, বহু ধরনের ক্যাকটাস তিনি সংগ্রহ করে সযত্নে লালন করেছেন। অনেকবার তাঁর বাসায় গিয়ে দেখেছি, তিনি এবং কুলসুম ভাবী শত শত ক্যাকটাসের পরিচর্যা করছেন। নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন তিনি এইসব কণ্টকাকীর্ণ উদ্ভিদগুলোকে। কাছে নিয়ে একটা একটা করে দেখাতেন। বোঝাতেন, কোনটা কোন প্রজাতির। কোনটা কোন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করেছেন। কোনটার পরিচর্যা কিভাবে করতে হয়। ক্যাকটাস ভালোবেসে তিনি যেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানকেও ভালোবেসে ফেলেছিলেন। একজন বিজ্ঞ উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর মতোই তিনি বুঝিয়ে বলতেন গাছগুলো সম্পর্কে। আমাদের সামনে স্বাচ্ছন্দে উন্মোচিত করতেন উদ্ভিদের মধ্যকার অন্তর্নিহিত অপূর্ব রহস্য।
সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের সঙ্গে বহু দিনের বহু স্মৃতির মধ্যে একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি অমলিন হয়ে আছে আজো। ১৯৯৬ সালে আমি আমার প্রথম কাব্য গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করি। বইয়ের নাম ঠিক করি, ‘আমার সামনে নেই মহুয়ার বন’। তখনকার ছোট্ট ক্যাম্পাসে আমার গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ চাপা থাকে না। বাংলা বিভাগের ভূঁইয়া ইকবাল বা ময়ূখ চৌধুরীর সঙ্গে আমার বই নিয়ে আলাপের কিছু অংশ তিনি হয়ত শুনে থাকবেন। একদিন শিক্ষক লাউঞ্জে আমাকে পেয়ে ডেকে নিলেন, ‘আপনি কবিতার বই বের করছেন?’ আমি সলাজ সম্মতি জানাই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সরাসরি বললেন, ‘আপনার পাণ্ডুলিপিটি দ্যান, পড়ে দেখি। ” আমি তখন সর্বশেষ পরিমার্জনা করে পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঢাকা রওয়ানা হওয়ার অপেক্ষায়। বললাম, ‘ক‘দিন পরেই বই হয়ে বের হবে। ছাপানো বই-ই না হয় দেবো। ’ তিনি রাজি হলেন না। পাণ্ডুলিপিই দেখতে চাইলেন। আমি লাউঞ্জ থেকে ওঠে আমার রুম থেকে পাণ্ডুলিপি এনে তাঁকে দিলাম।
পরদিনই দুপুর বেলা আবার লাউঞ্জে পেয়ে আমাকে ডাকলেন। কাছে যেতেই কোনো ভনিতা ছাড়াই সরাসরি বললেন, ‘ভালো লিখেছেন। আপনার বইয়ের প্রচ্ছদ আমি করবো। ’ বিস্ময়ে-বিমূঢ় হয়ে আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। কথা বলতে পারি না। তাঁর মতো একজন বড় ও গুণী শিল্পী নিজে থেকে আমার বইয়ের প্রচ্ছদ করতে চাচ্ছেন, এতো আমার পরম পাওয়া। আনন্দ ও কৃতজ্ঞতায় আমি বাকরুদ্ধ।
আমার এবং অনেকেরই জানা আছে যে, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ সাধারণত বইয়ের প্রচ্ছদ করেন না। অনেককেই তাঁর পিছু নিতে দেখেছি প্রচ্ছদের জন্য। তিনি অবলীলায় তাদের ফিরিয়ে দিতেন। জীবনে চার-পাঁচটির বেশি বইয়ের প্রচ্ছদ তিনি করেন নি। এ তথ্য তিনি নিজেই জানিয়েছেন। তিনি আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থে প্রচ্ছদ করেছেন, ভাবলেই শিহরিত ও রোমাঞ্চিত হই।
তখন কম্পিউটারের এতোটা প্রচলন ও সহজলভ্যতা ছিল না। মধ্য নব্বুই দশকের প্রচ্ছদ শিল্প পুরোটাই ম্যানুয়েল ছিল। কয়েক দিনের মধ্যে তিনি একটি চিত্রকর্মসহ নিজের হাতের লেখা নামপত্র দিয়ে চমৎকার প্রচ্ছদ তৈরি করেন। এবং আমাকে সঙ্গে করে আন্দরকিল্লার এক ছাত্রের অফিসে গিয়ে প্রচ্ছদের কিছু টেকনিক্যাল কাজ সম্পন্ন করে আমার হাতে তুলে দেন। আমি অভিভূত হয়ে দীর্ঘক্ষণ প্রচ্ছদটির দিকে তাকিয়ে থাকি। অনেকক্ষণ পর আমি প্রচ্ছদের সম্মানী প্রসঙ্গ তুললে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘টাকার জন্য এই প্রচ্ছদ আমি করি নি। ’ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় আমার ভেতরটা আর্দ্র হয়ে এলো।
তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে শেষ রাতের ঘুমন্ত পৃথিবীতে আমার লেখার অক্ষরগুলো বার বার বেদনার্ত হয়ে ওঠছে। আলোছায়ার রহস্যময়তায় তাকিয়ে দেখি, নিথর বুক সেলফের এক কোণে মুখ বাড়িয়ে রয়েছে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ অঙ্কিত আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আমার সামনে নেই মহুয়ার বন’। গভীর মমতায় বইটি টেনে নিলাম। হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। টুপটাপ শব্দে রাতের নির্জনতা ভেঙে ক’ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ে অমলিন প্রচ্ছদে। আমি আঙুলের স্পর্শে আমার বইটির সর্বাঙ্গে সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের জীবন্ত স্পর্শ পাই। প্রিয়জন, আমাদের অদেখা ভুবনে আপনি ভালো থাকুন। সুখী ও কল্যাণময় হোক আপনার অনন্ত যাত্রা।
ড. মাহফুজ পারভেজ, কবি ও লেখক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৫০৫ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৭
আরআই