৫০/৬০ বছর আগেও ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বা ‘ভুবনগ্রাম’ শব্দগুলোর কথা কেউ জানতো না। মানুষ পরিচিত ছিল এই শব্দের সঙ্গে।
‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বা ‘ভুবনগ্রাম’ ধারণাটি বাস্তবের কাছাকাছি অতিদ্রুত চলে আসে ‘স্নায়ূ যুদ্ধ’ বা ‘ঠাণ্ডা লড়াই’-এর পর, গত শতাব্দীর নব্বুই দশকে। নব্বুইয়ের দশকের গোড়ায় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে নব্য-সৃষ্ট ‘গ্লোবালাইজেশন’ বা ‘বিশ্বায়ন’ এই ভুবন গ্রামের প্রলম্বিত ছায়াকে কায়ায় রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে ধাবিত হতে থাকে। সে কারণেই বিশ্বজুড়ে জোট বাঁধার, ঐক্যের, নিজের মধ্যে যুক্ত হওয়ার প্রয়াস লক্ষণীয়। জগতময় মিলন আর ঐক্যের জোরালো আওয়াজে মানুষ মিলতে থাকে মানুষের সঙ্গে; একদেশ আরেক দেশের সঙ্গে; অঞ্চল অঞ্চলের সঙ্গে।
ঐক্যের বাতাবরণে বিভক্ত জার্মান জাতি ঐক্যবদ্ধ তো হয়েছেই; বরং বিভক্তকারী বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলার দু‘ দশকও সাড়ম্বরে উদযাপন করেছে। শত-শত বছরের যুদ্ধ ও বিভেদের কালাপাহাড় ডিঙিয়ে ইউরোপ রাজনৈতিক এককে শামিল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন গঠন, অভিন্ন ইউরো মুদ্রার প্রচলন, মসৃণ যাতায়াত ব্যবস্থার উদ্ভাবন এবং আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিনিময় ইউরোপের অখ- সাধনার ফলিত রূপ স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়েছে।
ইউরোপের বাইরেও সারা পৃথিবীর সবাই দেখছে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা। মানব সভ্যতার বর্তমান ও ভবিষ্যতের নানা বাঁকের দিকে ঐক্যের হানছানি দেখা যাচ্ছে। মানব সমাজের সামনে ওৎ পেতে থাকা অজস্র আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-পরিবেশগত সমস্যার মোকাবেলায় পৃথিবীর মানুষ ক্রমেই একাট্টা হচ্ছে। বাস্তবতার কারণেই প্রয়োজন পড়েছে গোটা পৃথিবীর মানুষকে ও রাষ্ট্রসমূহকে এক সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ও একাট্টা হয়ে সঙ্কট মোকাবেলায় কাজ করবার। ঐক্যের এতো প্রচ- উন্মাদনা পৃথিবী আগে আর কখনোই এতোটা দেখে নি।
বিশ্বব্যাপী যখন ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে ঐক্যের পরিস্থিতি, তখন এই একতার মন্ত্রে নিজেদের মজবুত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আমাদের সামনে তো বাধা থাকার কথা নয়। নিজেদের মধ্যে এবং বিশ্বের সঙ্গে ঐক্যের প্রয়াসে বাংলাদেশ বসে থাকতে পারে না। দ্রুততার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পারে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বা ‘ভুবনগ্রাম’-এর পথে প্রান্তরে।
ভাষায়, জাতীয়তায়, ধর্মে, সংস্কৃতিতে, রাজনীতি ও সমাজ বিকাশের ঐতিহাসিকতার একীভূত চৈতন্যই আমাদের ঐতিহ্যগত ভিত্তি। ঐক্যই বাংলাদেশের অন্তর্লোকের বাণী। এই ঐক্যবাণী যখন মুদ্রিত হয় জাতিসত্ত্বার হৃদয়ে তখন স্বাধীনতা ও জাগৃতির সর্বশক্তি এসে ভর করে আমাদের দেহ-মন-অস্তিত্বে। জাতির এই চৈতন্যগত শক্তিই সকল সমস্যা ও সঙ্কট মোকাবেলা করে আলোকিত হওয়ার প্রেরণা দেয়; সামনে এগিয়ে চলার শক্তি দেয়।
এভাবেই ঐক্যচেতনায় অতীতে আমরা ব্রিটিশ-উপনিবেশিকতাকে প্রত্যাখ্যান করি; এবং আধা-উপনিবেশ পাকিস্তানকে পরাজিত করার জন্য যুদ্ধ শুরু করি। ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীন সত্ত্বা সর্বব্যাপী বিঘ্নকে হটিয়ে বিজয়ের ঊর্ধ্বমুখী পতাকার মতো উড্ডীন হয় সার্বভৌম আকাশে। সকল ক্ষুদ্র রাজনীতির স্বার্থের অবসান ঘটিয়ে আমরা সকলের স্বার্থের দিকে ধাবমান হই। আমরা বৃহত্তমের মধ্যে মিলিত হয়ে সকলের সঙ্গে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ঝরণাধারায় ঋদ্ধ ও প্লাবিত হই।
কিন্তু যখন আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের কোনো কোনো পর্যায়ে দল বা গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতা এসে চেপে বসে, তখন সেটা শুধু রাজনৈতিক ঐক্যকেই ক্ষয়িষ্ণু ও দুর্বল করে না; বরং আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধির ধারা ও মানব-উন্নয়ন প্রচেষ্টাতেও প্রবল ক্ষয় ঘটায়। রাজন্যের অনৈক্যে জনগণ আলগা গাঁথুনির মতো নড়বড়ে হয়ে যায়। জমাট জাতীয় শক্তিও বরফের মতো গলতে থাকে। এতে লাভ হয় শত্রুপক্ষের। এ কথা শুধু আমাদের জন্যই নয়, সকল দেশের জন্যই সত্য।
অতএব পৃথিবীর ইতিহাসের শিক্ষা এটাই যে, খ-তার অবসান ও একতার স্থায়িত্বই জনশক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে অক্ষুণœ রাখতে পারে। জাতীয় শক্তিকে করতে পারে ইস্পাত-দৃঢ় এবং শত-শত্রুর বিরুদ্ধে আনতে পারে অপরাজেয়Ñবিজয়। কারণ একতার সাধনার মধ্যেই নিহিত আছে পূর্ণতার সিদ্ধি। আবার পূর্ণতার মধ্যেই দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের বীজ উপ্ত আছে; তাকে খ-ন করে ক্ষুদ্র ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার পরিণতি আত্মঘাতী। দলীয় রাজনীতির স্বার্থে জনগণকে ভেঙে ভেঙে ভাগ করার মাধ্যমে অপশক্তি যেন তলে তলে জাতীয় শক্তিকে ম্লান করার বিন্দুমাত্রও সুযোগ না পায়; দলীয় প্রতিযোগিতা যেন জনগণকে বিভেদ ও দ্বৈরথে ঘোরাক্রান্ত করতে না পারে; তা নিশ্চিত করাই ভবিষ্যতমুখী রাজনীতিবিদদের জাতীয় কর্তব্য। দেশপ্রেমিকতা ও জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে ব্যক্তিস্বার্থ, দলস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থসহ সকল ক্ষুদ্রতার বিসর্জন দেওয়াও জরুরি।
বিশেষত, বিশ্ব যখন ঐক্যের পথে সীমাহীন সমস্যার সমাধান করে সফল হচ্ছে, তখন আমাদের সামনেও ঐক্যের বিকল্প নেই। একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বা ‘ভুবনগ্রাম’-এর পথে প্রান্তরে বিকশিত হওয়ার রাজনীতি। জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সঙ্কট মোকাবেলা করে নিজেদের উন্নতি ও প্রগতিকে অবারিত করার রাজনীতিই বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির জ্বলন্ত বাস্তবতা। ব্যক্তি-গোষ্ঠী-দলের স্বার্থান্ধ-ক্ষুদ্রচিন্তায় এই চরম সত্য কোনোভাবেই বিস্মৃত হওয়া চলে না।
মানুষ যখন ঐক্যবদ্ধ হতে চায়, উন্নতি-অগ্রগতির পথে এগিয়ে গিয়ে নিজের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে উজ্জ্বলতর করতে চায়, রাজনীতির কাজ তখন তাকে সাহায্য করা; বাধা দেওয়া নয়। জনমুখী রাজনীতি কখনোই বিভেদের পথে যায় না; ঐক্যের প্রেরণা জাগায়। ঐক্যের মাধ্যমে জনতার স্বপ্নকে সফল করার এবং বিশ্বব্যাপী উন্মোচিত করার প্রয়াসে রাজনীতি সকলকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, মানুষ চলমান-গতিশীল বিশ্ব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে এমনটিই প্রত্যাশা করে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, কবি ও লেখক। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০৭২৭ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৭
ওএইচ