রাজনীতির এই গুণগত পরিবর্তন হয়েছে সচেতন, শিক্ষিত ও উদ্যোগী জনমানুষের তীব্র প্রত্যাশার কারণে। প্রাচীন রাষ্ট্রবিজ্ঞানি অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ‘মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী’।
বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশেও গতানুগতিক অতীতধারা বিদায় নিয়েছে রাজনীতির ময়দান থেকে। কোন্দল, হানাহানি ও নেতিবাচকতায় পরিপূর্ণ ক্ষতিকর রাজনীতি মানুষ গ্রহণ করেনি। মানুষ বিশ্বায়নের চোখে অগ্রসর দেশের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাহসী, উদ্যোগী, কার্যকর রাজনীতির প্রত্যাশী। মানুষ রাজনীতির স্রোতে সুশাসন ও উন্নয়নের মোহনায় পৌঁছুতে আগ্রহী। রাজনীতির নামে ক্ষুদ্র স্বার্থ, ব্যক্তি-পরিবারতন্ত্র ও গোষ্ঠীবাদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অগ্নিগর্ভ অন্ধকূপে বন্দি হয়ে থাকতে চায় না কেউই। মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই শান্তি, স্থিতি, সমঝোতা ও উন্নয়ন চায়। মানুষ নিজের উন্নয়ন-অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ ও অগ্রগামিতা চায়। একজন মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবনের মূল চেতনাই হলো সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তা। সুখে, শান্তিতে, নিরাপদে থাকার ইচ্ছা মানুষের ন্যায্য অধিকার। রাজনীতিকে মানুষের সেইসব অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। মানুষকে অধিকারহীন করে পেছনের দিকে টেনে নেওয়া রাজনীতির কাজ হতে পারে না। অগ্রসরমান মানুষ এমন পশ্চাৎপদ রাজনীতিকে গ্রহণ করতে মোটেও রাজি নয়।
রাজনীতির মতোই রাজনীতিবিদ সম্পর্কেও মানুষের একটি মানদণ্ড রয়েছে। প্রচলিত অর্থে, সেরা রাজনীতিবিদ বলতে মানুষ কাকে মান্য করে বা কাদের শনাক্ত করে এবং সেটা কেন বা কি কারণে করে? মূলত যাঁর উদ্ভাবিত কৌশলের সামনে এসে বিপক্ষ দলের কৌশল নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। যাঁর কৌশল যত বেশি কার্যকর ও ফলপ্রসূ, যিনি যত বেশি সাফল্য আনতে পারেন, তিনি তত বড় রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন। এটাই এখনকার দস্তুর বা রেস্ত। এটাই সেরা রাজনীতিবিদ হিসাবে পরিগণিত হওয়ার চিহ্নিত পথ ও পন্থা।
রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের মানুষ সর্বক্ষণ পরীক্ষা করে। তাদের কথা ও কাজের মধ্যকার মিল-অমিল যাচাই করে। কোন কোন রাজনীতিক দল ও রাজনীতিবিদের যথাযথ কাজটি করার প্রকৃত সক্ষমতা আছে, সেটা খতিয়ে দেখে মানুষ। কাজ করার জাতীয়, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক সামর্থ আছে কোন দলের ও নেতার, সেটা জনগণ ঠিকই লক্ষ্য রাখে। এবং নির্বাচনের সময় মানুষ সেটা ভোটের বাক্সে জানিয়ে দেয়। ফলে রাজনীতি ও নির্বাচন হলো একটি পরিপূরক সত্তা। একটিকে ছাড়া অন্যটিকে কল্পনাও করা যায় না।
রাজনীতি নির্বাচনমুখী হলে আরেকটি বিষয় আরম্ভ হয়। তা হলো সংলাপ। মানুষ নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন দল ও নেতার ভালো ও মন্দ কার্যক্রম নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে। সাংবিধানিক বাক-স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার বলেই মানুষ রাজনৈতিক বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা, আলাপ-আলোচনায় আগ্রহী হয়। নিজের রাজনৈতিক অধিকারকে প্রয়োগের পূর্বে মানুষ এভাবেই প্রস্ততি গ্রহণ করে। নির্বাচন কমিশনও আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপের সূচনা ঘটায়। সামনের সংসদ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এসব কাজ শুরুও হয়ে গেছে। আগামী জুলাইয়ের দিকে নির্বাচন কমিশনও দলগুলোকে ডাকবে এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে মান্য করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এবং জনগণের মনোভাব ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটানোর লক্ষ্যে নির্বাচনী রাজনীতিকে সফল করবে। এটাই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ধারা।
নির্বাচনী রাজনীতির প্রাক্কালে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে মানুষের মধ্যে একটি গতিবেগের সঞ্চার হয়েছে। ভোটের রাজনীতিতে দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নির্বাচনী আসনগুলো ক্রমেই সরব ও মুখরিত হচ্ছে। পুরাতন ও নতুন প্রার্থীরা মানুষের কাছাকাছি হচ্ছেন। মানুষও মনে মনে যাচাই-বাছাই শুরু করেছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের এলাকায় গিয়ে জনগণের সমর্থন নিয়ে আসার জন্য স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন। দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি’র উৎসাহী নেতা-কর্মীরাও মাঠে-ময়দানে সরব হচ্ছেন। গণতন্ত্রের আওতায় রাজনীতি করতে হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া ভিন্ন পথ নেই, এই বাস্তব উপলব্ধি দলটির মধ্যেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একবার নির্বাচনের ট্রেন ফেল করে তারা যে পিছিয়ে পড়েছেন, তা-ও অনুধাবণ করতে পারছেন নেতৃবৃন্দ। বার বার নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলে নেতা-কর্মীদের ভবিষ্যতের সঙ্গে সঙ্গে দলের ভবিষ্যতও যে অন্ধকার হয়ে যাবে, সেই আশঙ্কার কথা দলে ভেতরে-বাইরে জোরালো ভাষায় আলোচিত হচ্ছে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতি এখন মাঠে-ময়দানে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজধানী ঢাকার ঘরে বসে রাজনীতি করার সময় এখন নয়। সম্ভাব্য প্রার্থীরা চষে ফেলছেন নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকা। জনগণও আলাপে-আলোচনায় প্রস্তুতি নিচ্ছেন সামনের নির্বাচনের জন্য। এমতাবস্থায় জনগণের সামনে সুযোগ এসেছে নিজেদের দাবি-দাওয়া ও এজেন্ডা তুলে ধরার। কারণ, এক কাপ চা কিংবা পাঁচশ’ টাকা দিয়ে ভোট কিনে ফেলার অতীত আর নেই। মানুষের সচেতনতা এখন সর্বোচ্চ। তারা জানেন, একজন ভোটারের ক্ষমতায়ন মানে এক কাপ চা কিংবা পাঁচশ’ টাকা নয়। ডিজিটাল মিডিয়া, প্রিন্ট এবং অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের কারণে মানুষ প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষিত ও সচেতন হচ্ছে। কোনো অনিয়ম হলে মুহূর্তের মধ্যে সেটা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অরাজনৈতিক শক্তির কালো টাকা বা পেশী শক্তির দাপট দেখানোর সুযোগ খুবই সীমিত হয়ে গেছে মিডিয়া ও সচেতন মানুষের তৎপরতার কারণে। ফলে মানুষকেই এখন নির্ধারণ করে দিতে হবে সামনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আগামী নেতৃত্বের কাছে তাদের প্রত্যাশা কি?
হাওরের বন্যা ও দুর্যোগ মোকাবেলায় সংগ্রামশীল কৃষককে জানাতে হবে, তিনি কি প্রত্যাশা করেন। পদ্মা-যমুনার চরাঞ্চলের মানুষকে তুলে ধরতে হবে তাদের মনের কথা। পাহাড়, দ্বীপ, সমতলের বিস্তৃর্ণ বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদের মানুষকেই জানাতে হবে স্ব স্ব অধিকার ও উন্নয়নের দাবি। শহরের যে যুবক নিজের চাকরি বা ব্যবসাকে আরো এগিয়ে নিতে চান, তার জন্য কি কি সাহায্য-সহযোগিতা দরকার, সেটাও ঠিক করতে হবে। যে তরুণ দেশে বা বিদেশে পড়তে চায়, তার পড়ার সুযোগ উন্মুক্ত করতে হবে। চাকরির সম্ভাবনাকে ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশের আঞ্চলিক যোগাযোগ সুবিধা দ্রুতলয়ে বাড়ছে। ভারতের সঙ্গে বাস, ট্রেন যোগাযোগের মতো অন্যান্য প্রতিবেশীদের সঙ্গেও সংযোগ বাড়বে। এমতাবস্থায় জনগণের চাকরি, ব্যবসা, বিনোদন, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, জীবনমান উন্নয়নের দিকগুলোকে মানুষ স্পষ্টতরভাবে দেখতে চায় রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে। জনগণ সম্ভাবনাময় ও সুদূরপ্রসারী মানসিকতার নেতা ও রাজনীতি চায়। নির্বাচনে তেমনই ইতিবাচক ও আশাসঞ্চারী নেতা ও রাজনীতির উত্থান দেখতে চায় বাংলাদেশের উন্নয়ন-প্রত্যাশী মানুষ।
তাবৎ বিশ্বের অগ্রগতির দৌঁড়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সংঘাত, দ্বন্দ্বে আকীর্ণ হতে চায় না মানুষ। রিকশাচালক চায় না তার গাড়ি বন্ধ থাকুক। ব্যবসায়ী-দোকানদার চায় না তার প্রতিষ্ঠান সঙ্কটের আগুনে পুড়ে ছারখার হোক। চাকরিজীবী, ছাত্র, তরুণ, তরুণী, বৃদ্ধ, কেউই চায় না ভুল ও উগ্র রাজনীতির হাতে জিম্মি হতে। মানুষ রাজনীতির হাত ধরে মুক্ত ও বিকশিত হতে চায়; বন্দি, আক্রান্ত ও অবরুদ্ধ হতে চায় না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাজ মানুষকে এগিয়ে নেওয়া। মানুষকে চেপে রাখা কোনো রাজনীতি বা রাজনীতিবিদের কাজ হতেই পারে না।
রাজনীতি, সংলাপ, নির্বাচনের প্রাক্কালে জনগণকে তাই নিজ নিজ স্বার্থের এজেন্ডা প্রণয়ন করতে হবে এবং রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদেরকে জনগণের এজেন্ডাকে সম্মান ও মান্য করার জন্য বাধ্য করতে হবে। জনগণের কল্যাণ, উন্নয়ন ও নিরাপত্তার স্বার্থে জনগণ কতৃক প্রণীত জনগণের এজেন্ডাকে বাস্তবায়িত করতে জনগণের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণের এখনই সময়।
ড. মাহফুজ পারভেজ, কবি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানি। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৭ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৭
জেডএম/