ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শোক-দুঃখ জয়ী এক মগ্ন সাধক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২০ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৭
শোক-দুঃখ জয়ী এক মগ্ন সাধক ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকার

নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত যদুনাথ সরকারই উপমহাদেশে বা অবিভক্ত বাংলায় আধুনিক ইতিহাস চর্চার প্রথম ব্যক্তি নন; কিন্ত তিনি অবশ্যই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। ইতিহাস চর্চা ও গবেষণায় তাঁর বিশিষ্টতার প্রধান কারণগুলো হলো: কাজের প্রতি ধ্যান, নিবেদন, একাগ্রতা, নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়।  শিক্ষা ও গবেষণায় এক সংগ্রামীর প্রতিচ্ছবি উদ্ভাসিত হয় তাঁর জীবনীর পরতে পরতে।

যদুনাথ সরকারের নামের আগে আচার্য এবং স্যার যুক্ত রয়েছে। এসব সম্মানসূচক উপাধি যথার্থ অর্থে তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

তিনি তাঁর দৃষ্টান্ত-স্থাপনকারী শ্রম, মেধা ও অধ্যবসায়ের বলে এগুলো অর্জন করেছিলেন। তাঁর জীবনের কিছু দিক আলোচনা করা হলে কাজের মাধ্যমে এই বিরল ইতিহাসবিদের বিশিষ্টতা এবং সম্মান অর্জন করার ইতিহাসটুকু জানা যাবে।

বেশ কয়েকটি ভাষার ওপর তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। সত্যনিষ্ঠ, তথ্যসমৃদ্ধ ও প্রামাণিক ইতিহাস রচনার জন্যই তিনি মূলত উর্দু, ফারসি, মারাঠি ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। ১৯২৯ সালে উপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার তাকে নাইট উপাধি দেয়। ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণার ক্ষেত্রে স্যার যদুনাথ সরকার ছিলেন পথিকৃৎ। এ কারণে তাকে আচার্য বলা হয়।

যদুনাথ সরকার ১৮৭০ সালের ১০ ডিসেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহী জেলার আত্রাই থানার কড়চমারিয়া গ্রামের ধনাঢ্য জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রাজকুমার সরকারের ছিল বিশাল গ্রন্থাগার। ফলে শৈশবেই দেশি-বিদেশি নানা শ্রেণীর বই পড়ার সুযোগ ঘটে তাঁর। অল্প বয়সেই তিনি পড়ে ফেলেছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড’। শৈশবেই পিতা রাজকুমার তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রুটার্ক রচিত প্রাচীন গ্রিক ও রোমান রাষ্ট্রনায়কদের জীবনী। মূলত পিতাই তাঁর কিশোরচিত্তে ইতিহাসের নেশা জাগিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রাথমিক পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় তাঁর গ্রামের স্কুলে। এরপর রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল। এ স্কুল থেকেই ১৮৮৭ সালে বোর্ডে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৮৮৯ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এফ.এ পাস করেন প্রথম বিভাগে দশম স্থান লাভ করে। এরপর ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি ও ইতিহাসে সম্মানসহ প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বি.এ এবং ১৮৯২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে ৯০ শতাংশ নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করে এম.এ পাস করেন। ১৮৯৭ সালে তৎকালের বিখ্যাত ‘প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ’ বৃত্তি স্বর্ণপদকসহ দশ হাজার টাকা বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে সবার বাঁয়ে স্যার যদুনাথ সরকার।  যদুনাথ সরকারের কর্মজীবন বর্ণবহুল। তিনি চাকরি জীবন শুরু করেন অধ্যাপনার মাধ্যমে। ১৮৯৩ সালে তিনি কলকাতা রিপন কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এখান থেকে পরে চলে যান মেট্রোপলিটন কলেজে। ১৮৯৮ সালে তিনি যোগদান করেন বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল এডুকেশন সার্ভিসে। সে বছরই তিনি চলে আসেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক হিসাবে। এক বছরের মাথায় বদলি হয়ে চলে যান পাটনা কলেজে। এ কলেজে তিনি দীর্ঘ কাল কাটান। ১৯১৭ সালে তিনি যোগদান করেন কাশি হিন্দু কলেজে। ১৯২৬ সাল পর্যন্ত চাকরি করে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তবে ওই বছরই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। তাঁর আগে কোনও বাঙালি অধ্যাপক উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন না।

মূলত অবসর জীবনেই তাঁর ইতিহাসচর্চার মৌলিক তৎপরতা পরিচালিত হয়। তাঁর অসাধারণ কর্মকীর্তির মধ্যে রয়েছে মির্জা নাথান রচিত ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবি’ পান্ডুলিপির পরিচিতি ঘটানো। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাগারে খুঁজে পাওয়া এই পাণ্ডুলিপি তিনি বিভিন্ন জার্নালে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় টিকা ও বিশ্লেষণসহ প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই তিনি কবির বহু কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তাঁর রচিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা পঁচিশ। এছাড়াও বারোটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কীর্তি বহু বছরে রচিত ও বহু খণ্ডে প্রকাশিত ‘হিস্ট্রি অব আওরঙ্গজেব’।  

১৯৫০-এর দশকে স্যার যদুনাথ সরকার মুঘল সম্রাট আকবরের বিশিষ্ট সভাসদ-পণ্ডিত আবুল ফজল প্রণীত ‘আইন-ই-আকবরি’র ব্লকম্যানকৃত অনুবাদের ওপর কাজ করে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির জন্য নতুন সংস্করণ তৈরি করছেন। ওঁর কাজে সাহায্য করার জন্য ইতিহাস জ্ঞানসম্পন্ন একজন লোক দরকার ছিল। সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজের ইতিহাস বিভাগের তরুণ শিক্ষক তপন রায় চৌধুরী এ কাজে নিযুক্ত হলেন; যিনি পরে অক্সফোর্ড ফেরত বিখ্যাত সামাজিক ইতিহাসকাররূপে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং ‘বাঙালনামা’সহ একাধিক মনোমুগ্ধকর গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
 
‘আইন-ই-আকবরি’র কাজ শেষ হওয়ার পর স্যার যদুনাথ মুঘল সাম্রাজ্যের পতন বিষয়ক তাঁর বিরাট গ্রন্থটির শেষ খণ্ডটি প্রেসে দেন। এই সময় প্রুফ দেখা ইত্যাদি ছোটোখাটো কাজে তপন রায় চৌধুরী তাঁকে সাহায্য করতেন। গ্যালি থেকে শুরু করে শেষ প্রুফ পর্যন্ত তিনবার তিনি নিজে প্রুফ দেখতেন। তপন রায় প্রত্যেকটা প্রুফই একবার দেখতেন। কিন্তু তাতে যদুনাথ সরকার নিশ্চিত হতে পারতেন না।

স্যার যদুনাথের সংগ্রহে তাঁর কাজে লাগতে পারে এ রকম যাবতীয় নথিপত্র হস্তলিপির কপি ছিল। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত আবিষ্কার প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত মুঘলদের বঙ্গবিজয়ের কাহিনী ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবি’র হস্তলিপি। পুঁথিটির মাইক্রোফিল্ম কপি আনিয়ে সেটার ফটোকপি করে কোনও ফারসি-জানা মৌলানাকে দিয়ে সুন্দর নাস্তালিক অক্ষরে অনুলিপি করিয়েছিলেন। তাঁর সংগৃহীত অনেক পুঁথি এবং দলিল-দস্তাবেজই ওইভাবে মাইক্রোফিল্ম থেকে কপি করা। উদ্দেশ্য ছিল, ব্যবহারের সময় যেন কোনও অসুবিধা না হয়। ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবি’র প্রতিলিপিটি পড়ার জন্য তপন বাবু স্যার যদুনাথ সরকারের বাড়িতে যেতেন। যদু বাবু তাঁর বাইরের ঘরটিই পড়ার ঘর হিসাবে ব্যবহার করতেন। হাতে লেখা বাধাঁনো বইটি এনে দিয়ে নিজেও আর কোনো কাজ নিয়ে জানালার ধারে বসে যেতেন। যদু বাবু অচ্ছেদ্য মনোযোগে নিজের কাজ করে যেতেন। মাঝে মাঝে এক-আধটা প্রশ্ন করতেন। সেগুলোও ইংরেজিতেই বলতেন: ‘উড ইউ লাইক সামথিং টু ডিঙ্ক?’ ‘শ্যাল আই টার্ন দ্য ফ্যান অন?’ ইত্যাদি সাধারণ কোনও কথা। কাজের অসুবিধা হবে, কাগজ-পত্র উল্টে যাবে, এজন্য তিনি বেশির ভাগ সময়েই  পাখা ব্যবহার করতেন না। প্রয়োজনের বাইরে কথা তো বলতেনই না। স্যার যদুনাথ সরকারের দ্য ফল অব দ্য মুঘল এমপায়ার গ্রন্থের প্রচ্ছদ।  তপন বাবুর পেশাগত-গবেষণা জীবনের প্রথম স্মরণীয় স্বীকৃতিও স্যার যদুনাথের কাছ থেকে পাওয়া। তরুণ সম্ভাবনাকে শনাক্ত করতে কখনোই ভ্রম হয় নি এই পণ্ডিতের। তপন বাবু জানিয়েছেন: বাহারিস্তান সেনাপতির লেখা যুদ্ধ আর রাজ্যজয়ের ইতিহাস। স্যার যদুনাথ ঠিকই বলেছিলেন, ‘এর ভিতরে সামাজিক ইতিহাসের মালমশলা পাওয়া যাবে না। ’ ঠিক, কিন্তু শতকরা এক শ’ ভাগ ঠিক নয়। যুদ্ধবিগ্রহের ধারাবিবরণীতে খুঁজলে জনজীবনে শাসনব্যবস্থা এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিণাম-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অনেক টুকরো টুকরো আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক তথ্যও পাওয়া সম্ভব। সেগুলো একত্র করলে যে ছবি ফুটে ওঠে, তা মুঘল সাম্রাজ্যের সুদূর রাজধানীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা বিবরণীর সঙ্গে সেটার মিল কমই। তপন বাবু এভাবে ছড়ানো-ছিটানো তথ্যগুলো একত্র করে বাংলায় মুঘল শাসন ব্যবস্থার একটি প্রাঞ্জল বিবরণী রচনা করেন।

স্যার যদুনাথ সেটি পড়ে এশিয়াটিক সোসাইটির সভ্যদের সামনে লেখাটি পড়ার প্রস্তাব পেশ করেন। সে সময় তপন বাবুর বয়স ২৫-২৬। সেই বয়েসি একটি অচেনা গবেষকের পক্ষে এ এক বিরল সম্মান। সেই রাতটি তপন বাবু উত্তেজনায় অনেকক্ষণ পর্যন্ত ঘুমাতে পারেন নি। ব্রিটিশ কলকাতার ইংরেজ ও স্থানীয় প্রবীণ পণ্ডিতদের আসর এশিয়াটিক সোসাইটির মতো একটি প্রাজ্ঞ সভায় যোগ্য বিবেচনা করায় একজন তরুণ গবেষককে তুল ধরতে যদুনাথ সরকার পিছ পা হন নি। পৃষ্ঠপোষকতার এমন সাহসী ও উদার নজির আসলেই বিরল।

স্যার যদুনাথ সরকারের জীবনে প্রতিটি পদক্ষেপ একটি বিশেষ উদ্দেশ্যকে লক্ষ করে গৃহীত হতে দেখা যায়। কুড়ি বছর বয়সে এমএ পাস করে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস বিষয়ে গবেষণা করবেন বলে মন স্থির করেন। তার পরবর্তী কুড়ি বছর তিনি গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় নানা ভাষা শেখা এবং তথ্য-উপাত্ত-উপাদান সংগ্রহে কাটিয়ে দেন। প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ স্কলারশিপের দশ হাজার টাকা দিয়ে তিনি তাঁর গবেষণার জন্য দরকারি মূল পুস্তকগুলোর  সংগ্রহটি প্রথম গড়ে তোলেন। তিনি তাঁর গবেষণাকে এক ধরনের ‘লিটারারি’ বা ‘সাহিত্যসৃজন’ বলে মনে করতেন। তাঁর গ্রন্থ-সংগ্রহে ইংরেজি এবং সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক বহু বই ছিল। তাঁর গবেষণাভিত্তিক লেখা প্রথম যখন বের হতে শুরু করে, তখন তাঁর বয়স চল্লিশ ছুঁয়েছে। চল্লিশ থেকে ষাট বছর বয়স অবধি ছয় খণ্ডে তিনি আওরঙ্গজেবের ইতিহাস রচনা করেন। সেটা শুধু আওরঙ্গজেবের ইতিহাস নয়, মুঘলদের জয় ও শাসনের অনুগামী হয়ে সারা ভারত পরিক্রমা, সমস্ত রাষ্ট্রশক্তির উত্থান-পতনের ইতিহাস। ষাট বছর বয়সে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস লিখতে শুরু করেন। শেষ করেন আশি বছর বয়সে। সেই সময়ে তিনি দিনের প্রতিটি প্রহর প্রতিটি কাজ ইত্যাদি সব কিছুকেই তাঁর জীবনের কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্যটির সঙ্গে বেঁধে রাখেন।

স্বাস্থ্য সম্বন্ধে তাঁর কিছু আশ্চর্যজনক ধারণা ছিল। মস্তিস্কের পক্ষে কিছু কিছু খাদ্য বিশেষ পুষ্টিকর বলে তিনি মনে করতেন। যথা কলা, ছোট মাছে মুড়ো এবং দই। রোজ নিজে বাজারে গিয়ে এই জিনিসগুলো কিনতেন। বলতেন, খাঁটি জিনিস খেতে হলে নিজে বাজারে যেতেই হবে। আশি বছর বয়স না হওয়া অবধি স্যার যদুনাথ রোজ আট ঘণ্টা কাজ করতেন। আট ঘণ্টা ঘুমাতেন। আশির বছরে পৌঁছে কাজের সময়টা ছয় ঘণ্টায় নামিয়ে আনেন। সকাল বিকাল ঘড়ি ধরে এক ঘণ্টা করে হাঁটতেন।

রুটিনবদ্ধ এই সব কাজের উদ্দেশ্য একটিই, শরীরটা ঠিক রাখতে হবে, যাতে একটি দিনও নষ্ট না হয়। স্যার যদুনাথ সরকারের দৃঢ ধারণা ছিল যে, বেশি গরমে আয়ুক্ষয় হয়। সেই জন্যই তিনি দার্জিলিঙে বাড়ি করেছিলেন। অনেক হিসাব করে বইপত্র ভাগ করে রেখেছিলেন। গ্রীষ্মে যা নিয়ে বা যে বিষয়ে কাজ করবেন, সেটার প্রয়োজনীয় সব বইপত্র দার্জিলিঙে রাখা ছিল। একটা বয়সের পর উঁচু জায়গা শরীরের পক্ষে অনুপযোগী মনে করে কাজের মাধ্যমে গ্রীষ্ম কাটানোর বিকল্প ব্যবস্থ করলেন তিনি। তাঁর মারাঠা ইতিহাস সংক্রান্ত যাবতীয় বইপত্র, দলিল-দস্তাবেজ তিনি মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত ঐতিহাসিক এবং তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধু সরদেশাইকে দিয়ে দেন। গ্রীষ্মের মাসগুলো তারপর থেকে তিনি পুনার কাছের একটি ছোট্ট শহরে ঐ বন্ধুর বাড়িতে পড়াশোনা ও গবেষণা করে কাটাতেন।

স্যার যদুনাথের ব্যক্তিগত জীবন সুখের ছিল না। একটার পর একটা মর্মান্তিক শোক তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। তাঁর এক জামাই নৌবাহিনীতে কাজ করতেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাহাজডুবি হয়ে মারা যান। তাঁর বড় ছেলে ছেচল্লিশ সালের দাঙ্গায় আততায়ীর হাতে নিহত হন। এক মেয়ে লন্ডনে পাঠাবস্থায় আত্মহত্যা করেন। শেষের ঘটনার খবর পেয়ে তাঁর বন্ধুস্থানীয় ঐতিহাসিকগণ, যথা রমেশচন্দ্র মজুমদার, নীহাররঞ্জন রায়, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ এঁরা সবাই দেখা করতে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন তিনি চিরকালের অভ্যাস অনুযায়ী জানালার পাশে বসে একটি বই পড়ছেন। রমেশবাবুদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। চোখে জিঞ্জাসু দৃষ্টি। তারপর বললেন, “ও, আপনারা খবর পেয়েছেন? হ্যাঁ, কাল মাঝরাতে টেলিগ্রাম এল। ” বলে একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “আচ্ছা, আপনারা তা হলে এখন আসুন। আমি কাজ করবো। ” ওঁরা দেখলেন, শোকতপ্ত মানুষটি অসীম দৃঢ়তায় নিজের কাজে ফিরে গেলেন।       

একদিন এক জ্যোতিষী স্যার যদুনাথের কাছে এক অনুরোধ নিয়ে আসে। সে লোকটি সব বিখ্যাত ব্যক্তিদের হাতের ছাপ নিয়ে সামুদ্রিকবিজ্ঞান অনুযায়ী তার বিচার করে একটি বই লিখছে। বিধান রায়, মেঘনাদ সাহা, সুনীতি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ সব জ্ঞানী-গুণী লোক সেই বই-এর জন্য হাতের ছাপ দিয়েছেন। এখন স্যার যদুনাথ যদি দেন তা হলে লোকটি বাধিত হবে। স্যার যদুনাথ লোকটিকে বকাবকি করে তাড়িয়ে দিলেন। কেউ একজন সাহস করে বললেন, “স্যার গরিব মানুষ, এই করে খায়। দিলেওবা পারতেন। ”

স্যার যদুনাথ এই প্রসঙ্গে অদ্ভুত এক কাহিনী শোনান: তাঁর যখন নিতান্তই অল্প বয়স তখন এক সন্ন্যাসী এসে তাঁদের বাড়ির অতিথিশালায় কিছুদিন থাকেন। যাবার সময় সন্ন্যাসীটি প্রসন্ন হয়ে যদুনাথের এক কুষ্ঠিবিচার করে তাঁর পিতার হাতে দিয়ে যান। যখন তাঁর জীবনে একটার পর একটা বিপর্যয় ঘটতে থাকে তখন তিনি প্রথম ওই নথিটি খোলেন। দেখলেন, তাঁর জীবনে যা যা ঘটেছে তা সবই ওতে লেখা আছে। এরপর তিনি আর কখনো জ্যোতিষী নিয়ে মাথা ঘামান নি। আগাম বিপদের ভয়ে তটস্থ না থেকে অবলীলায় কাজ করে গেছেন।

স্যার যদুনাথের জীবনে বিয়োগান্ত ঘটনার অভাব নেই। জীবনভর দুঃসংবাদ তাঁকে ঘিরে রেখেছে। তাঁর দুই নাতি ফৌজি প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর পরীক্ষা পাস করে ফুর্তি করতে বের হয়েছিল। জিপ উল্টে দু’জনেই মারা যায়। পরদিন সকালে কিছু কাজ নিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছিলেন তপন রায় চৌধুরী। এইদিন প্রথম তিনি নিজের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বললেন, “শুনেছ তো? আর যে ক’টা আছে তারাও কেউ থাকবে না। এটাই আমার ভাগ্যলিপি। ” এইসব দুঃখ-তাপ তাঁকে দমাতে পারে নি।

সুখের স্মৃতি সংখ্যায় কম হলেও ছিল অসামান্য:  যেদিন ‘ফল অব দ্য মুঘল এম্পায়ার’ গ্রন্থের শেষ ক’টি পৃষ্ঠার শেষ প্রুফ দেখা হয়ে গেছে, দীর্ঘ ষাট বছরের সাধনার সার্থক সমাপ্তির দিন সেদিন। বাইরে তখন অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছিল। ওইদিন তিনি কাজে বসেন নি। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বারান্দায় বসেছিলেন। এই প্রথম শোনা গেল তিনি গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজছেন। মনে হল সহস্র দুঃখের সমুদ্র পার হয়ে তিনি সার্থকতার কূলে পৌঁছেছেন।
 
না, কথাটা ঠিক হল না। স্যার যদুনাথ সরকারের জীবনের প্রতিটি মুর্হূতই তো সার্থকতায় ভরা। চেতনার যে স্তরে এই মহান অধ্যবসায়ী-পরিশ্রমী ঐতিহাসিক সর্বদাই স্থিতধী হয়ে বাস করতেন, যাতনা তো সেখানে পরাজিত। তিনি তো প্রকৃতই একজন শোক-দুঃখ জয়ী সাধক। ১৯ মে ১৯৫৮ সালে কলকাতায় মৃত্যুর পূর্ব-পর্যন্ত তিনি ছিলেন কাজের প্রতি নিষ্ঠা, একাগ্রতা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

লেখকড. মাহফুজ পারভেজ, কবি-লেখক-গবেষক, অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৩ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।