ভাস্কর্যের বিষয়টি একটি বড় ক্যানভাসের এককোণে ছোট চিত্র মাত্র। ভাস্কর্য অপসারণ আর প্রতিস্থাপনের এ ঘটনাটিকে চলমান রাজনীতির বৃহত্তর ক্যানভাস থেকে আলাদা করে দেখার কোনো উপায় নেই।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরকারের ভেতরে থাকা বাম গণতান্ত্রিক দলগুলো এবং সরকারের বাইরে থাকা বাম দলগুলোর একটি ত্রিমুখী টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। সরকারের বাইরে থাকা বাম দলগুলো তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর মাধ্যমে প্রকাশ্য কর্মসূচি দিয়ে সরকারের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। সরকারের ভেতরে থাকা বাম দলগুলো প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে অস্বস্তি প্রকাশ করলেও সরাসরি বিরুদ্ধ অবস্থান নেয়নি বা নিতে পারেনি।
তবে এই আপাত বিপর্যয় বা পশ্চাদ্পসারণের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের অসাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপের প্রবণতা আগের মতোই দেখা যাচ্ছে। আমাদের রাজনীতিতে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির সংস্কৃতি একেবারেই অনুপস্থিত বলে ঢালাওভাবে পরস্পরকে দোষারোপ করে এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো যাবে বলে মনে হয় না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এখন কোনো কার্যকর ও সংগঠিত বিরোধী দল নেই। এ প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের দলীয় মনস্তত্ত্ব ও তার নীতিনির্ধারকদের রণকৌশল সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে এগোতে না পারলে তাদের ডান-বিচ্যুতির স্বরূপ নির্ণয় করে এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন বলেই মনে হয়।
দুই
মন্ত্রী পর্যায় থেকে যতোই বলা হোক না কেন যে, ভাস্কর্য অপসারণের এ সিদ্ধান্তটি প্রধান বিচারপতি বা সুপ্রিম কোর্টের এবং এর সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই, সাধারণ মানুষমাত্রই জানেন, যেদিন হেফাজতের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হয়েছে, সেদিনই ভাস্কর্যটির ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত এখানে রাবার স্ট্যাম্প মাত্র।
প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক মেধা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমি মনে করি, তিনি রাজনৈতিক মেধায় শুধু আমাদের দেশেরই নন, উপমহাদেশের অনেক রাষ্ট্রনায়ককেই ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি কোনো ধরনের হিসেব-নিকেশ কিংবা কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়া এমন ইঙ্গিত দেবেন- তা ভাবার কোনো কারণ নেই।
ভাস্কর্য প্রতিস্থাপনের বিষয়টি সে ধরনের একটি হিসেব-নিকেশের অংশ বলেই মনে হয়। এতে শেষ রক্ষা হবে কি-না- তা ভিন্ন বিতর্কের বিষয়।
২০০৮ সাল থেকে যারা আমাদের রাজনীতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন, তাদের অন্তত প্রধানমন্ত্রীর সাহসিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। এই প্রধানমন্ত্রীই শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতকে বিতাড়িত করেছিলেন অত্যন্ত সফলভাবে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, কোন হিসাব থেকে তিনি এ অবস্থান নিলেন? আর কোনো কারণে তার সাহসের জায়গাটি কি নড়বড়ে হয়ে গেছে?
এ দু’টি প্রশ্নই আমাদের কিছু রিয়্যালিটি চেকের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
তিন
আমাদের ফিরে যেতে হয় স্বাধিকার আন্দোলন আর স্বাধীনতা সংগ্রামের বছরগুলোতে। স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনালগ্নে আওয়ামী মুসলিম লীগের চারা থেকে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বৃক্ষে রূপান্তরিত করছিলেন। তিনি কাজটি করেছিলেন তার পর্বতপ্রমাণ কারিশমা আর অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার বাহনে।
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে একটি বিপ্লবী বা শ্রমজীবী মানুষের দল হিসেবে গড়ে তোলেননি। আওয়ামী লীগ গড়ে উঠেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে একটি মধ্যপন্থী উদার গণতন্ত্রী পেটিবুর্জোয়া দল হিসেবে। আওয়ামী লীগের সূচনা হয়েছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক অভিপ্রায় ও শ্রেণী চরিত্র থেকে তাই আওয়ামী লীগকে আলাদা করার উপায় নেই।
মুক্তিযুদ্ধের আগের সময়টুকুতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতাকামী শক্তিগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল মোজাফফর ন্যাপ আর কমিউনিস্ট পার্টি। সে সময় নীতি-আদর্শ আর কর্মসূচির সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে মোজাফফর ন্যাপ আর কমিউনিস্ট পার্টি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করেছে। অন্যান্য নিয়ামকের সঙ্গে এ বহিঃচাপ অনেক ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগকে ডান-বিচ্যুতি থেকে ফিরিয়েছে।
এ বহিঃচাপ আপাতদৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ অনাকাঙ্খিত মনে করলেও বঙ্গবন্ধু অনেক সময়ই তা রাজনৈতিক কৌশলে সফলতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছেন অভ্যন্তরীণ ডান প্রবণতা মোকাবেলায়। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির এ প্রভাব অব্যাহত ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্ব পর্যন্ত।
স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের সময় ন্যাপের শক্তি ক্ষয়ে এলেও কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ, বাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির মতো বাম দলগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পেরেছে। ব্যাপকভিত্তিক গণসংগঠন না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ের ছাত্র সংগঠনগুলোর শক্তিতে ভর করে তারা ১৫ দলীয় ও ৫ দলীয় জোটের মোড়কে কেবল আওয়ামী লীগেরই নয়, ৭ দলীয় জোটের আন্দোলন বিন্যাসও প্রভাবিত করতে পেরেছিল।
কিন্তু সেদিনগুলোতে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি বা জাসদ এককভাবে যে অবস্থানে ছিল, আজ সবগুলো বামদলের সম্মিলিত শক্তিও সে অবস্থানে নেই। তাছাড়া বাম দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অনৈক্য ও আস্থাহীনতা এ দুর্বলতাকে প্রকটতর করে তুলেছে। এর স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে কার্যকর চাপ প্রয়োগ করে আওয়ামী লীগকে প্রভাবিত করে না পারা। আর ঠিক এই সময়ে কার্যকর ও সংগঠিত বিরোধী দলবিহীন রাজনীতির মাঠে শক্তি প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছে হেফাজত। তারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বা বঙ্গবন্ধুর প্রতি কোনো কটূক্তি করছে না (যদিও মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গী জামায়াতের চেয়ে ভিন্ন বলে মনে করার কোনো কারণ নেই)। তাই তারাই এখন আওয়ামী লীগের ওপর এক্সটারনাল প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করছে। এর দৃশ্যমান ফলাফল হচ্ছে আওয়ামী লীগের ডান-বিচ্যুতি।
নিকট অতীতের দিকে তাকালে আমরা দেখবো, গণজাগরণ মঞ্চ যখন ঐক্যবদ্ধ থেকে রাজপথে ব্যাপক জনসমাগম ঘটিয়ে শক্তি প্রদর্শন করতে পেরেছে, তখন তারা যুদ্ধাপরাধীদের যথাযথ বিচারের ব্যাপারে সরকারকে সঠিক পথে থাকতে প্রভাবিত করতে পেরেছে কিংবা সঠিক পথে থাকতে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করেছে। সে সময় কিন্তু হেফাজত কার্ড খেলতে চেষ্টা করেও গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিরোধের মুখে মাহমুদুর রহমান ও তার সহযোগীরা পিঠটান দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
সুতরাং, আওয়ামী লীগের ডান-বিচ্যুতিই শেষ কথা, আওয়ামী লীগকে দিয়ে সঠিক কাজটি করানো যাবে না – এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং দূর ও নিকট অতীতের ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে যে, আওয়ামী লীগকে প্রভাবিত করতে নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ের কোনো বিকল্প নেই। আর কেউ যদি ভাবেন, তারা আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে, পাশ কাটিয়ে বা সরাসরি প্রতিপক্ষ বানিয়ে তাদের অভীষ্টে পৌঁছাতে পারবেন – তারা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন।
চার
যে হেফাজতকে কান ধরিয়ে শাপলা চত্ত্বর থেকে বিতাড়িত করেছিল সেই হেফাজতের সঙ্গেই আবার আওয়ামী লীগ এক টেবিলে বসেছে। শুধু তাই নয়, হেফাজতের দাবি-দাওয়ার প্রতি নমনীয় ভাব দেখাচ্ছে, আবার কিছু কিছু মেনেও নিচ্ছে (পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ইত্যাদি)। এর পেছনের কারণ হয়তো বহুবিধ। তবে দু’টি বিষয় এখানে লক্ষ্য করার মতো।
প্রথমতঃ হেফাজত তাদের দাবিগুলো একত্রিতভাবে ১৩ দফা দাবি আকারে পেশ করছে না। তারা একটি একটি করে দাবি সামনে নিয়ে আসছে। সুতরাং, সরকারের পক্ষে সবগুলো দাবিকে প্যাকেজ হিসেবে মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে না। বরং, প্রতিটিকে আলাদা আলাদাভাবে দেখতে হচ্ছে এবং আলাদা আলাদাভাবে কনসেশন দিতে হচ্ছে। দ্বিতীয়তঃ হেফাজত রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের মহড়া দিলেও কোনো লাগাতার সরকারবিরোধী কর্মসূচি না দিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে সেসব দাবি উত্থাপন করে দর কষাকষি করছে, কনফ্রন্টেশন অ্যাটিচিউড কমিয়ে আনছে।
আওয়ামী লীগ ও তার হাইকমান্ডের মনস্তত্ত্ব যারা বোঝেন, তাদের নতুন করে বলার নেই যে, কনফ্রন্টেশনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কিছু আদায় করা কঠিন। বরং তাদের কাছ থেকে আদায় করতে হলে নিজেদের অবস্থানে দৃঢ় থেকে ও তাদের প্রতি প্রাপ্য সম্মান দিয়ে সমঝোতা ও দর কষাকষি করেই আদায় করতে হবে। যারা দূর অতীত ভুলে গেছেন, তারা নিকট অতীতে হেফাজতের ‘মোডাস অপারান্ডি’ থেকে এ অভিজ্ঞতাটি নিতে পারেন বলেই আমার বিশ্বাস।
পাঁচ
এ রিয়্যালিটি চেক আমাদের কোথায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে? উত্তরটি সোজা হলেও তার বাস্তবায়ন কঠিন। তবে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সদিচ্ছা থাকলে তা একেবারে অসম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের মাধ্যমে দেশকে প্রগতিশীলতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে তার প্রথম পূর্বশর্ত হিসেবে বাম গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আর এই প্রক্রিয়ায় সরকারের ভেতরে এবং বাইরে থাকা অসাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে ন্যূনতম অভীষ্টের লক্ষ্যে সামিল হতে হবে।
সরকারের বাইরের এবং ভেতরের দলগুলোর এ ধরনের ঐকমত্য সম্ভব কি? কোনো আনুষ্ঠানিক জোট বা ঐক্য প্রক্রিয়ায় না গিয়েও কোনো দাবি নিয়ে যুগপৎ কর্মসূচি বা দাবিনামা পেশ করা মোটেও অসম্ভব নয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তিন জোটের যুগপৎ কর্মসূচির উদাহরণ তো আমাদের সামনে আছেই।
আওয়ামী লীগকে বাম গণতান্ত্রিক দলগুলোর সঙ্গে, বিশেষ করে যারা সরকারি জোটের বাইরে আছে তাদের সঙ্গে বসানো সম্ভব কি? যাদের কিছুদিন আগেই কান ধরিয়ে রাজপথ থেকে তাড়িয়েছে, তাদের সঙ্গে যদি আলোচনার টেবিলে বসতে পারে, তাহলে যাদের সঙ্গে একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগকে আলোচনার টেবিলে বসাতে না পারারও কোনো কারণ দেখি না। তবে এ প্রক্রিয়ায় দূতিয়ালির দায়িত্ব নিতে হবে সরকারের শরিক বাম দলগুলোকেই।
ছয়
সরকারের বামে দাঁড়িয়ে আমরা আওয়ামী লীগের যতোই বিরোধিতা করি না কেন, যতোই মুণ্ডুপাত করি না কেন, কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে হলে আমাদের তা করতে হবে আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই, আওয়ামী লীগের সঙ্গে দর কষাকষি ও সমঝোতা করেই। এটাই আজকের রাজনীতির বাস্তবতা।
এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করে আমাদের খুব একটা এগোনোর অবকাশ নেই। আর সে পথে হাঁটতে হলে কাঁদা ছোঁড়া-ছুঁড়ি বাদ দিয়ে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা ও আস্থার অবস্থা তৈরি করতে হবে, কর্মসূচি ভিত্তিক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এর ব্যত্যয় হওয়া মানেই, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পথে ফিরে আসার অঙ্গীকারে আমাদের ঘাটতি থাকা।
হেফাজতিরা ঐক্যবদ্ধ। অনৈক্য দিয়ে প্রগতিশীলরা কোনোদিনই তাদের মোকাবেলা করতে পারবেন না। তাদের মোকাবেলা করতে হবে আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়েই, আওয়ামী লীগকে দিয়েই।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৫ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০১৭
এএসআর