পুরুষকেন্দ্রিক বাংলাদেশী সমাজ ব্যবস্হার রাজনৈতিক নেতৃত্ব নারীদের হাতে। দুই শীর্ষ নেত্রীই সকল ক্ষমতার উৎস ও আধার।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দু’হাজার ছয় সালে চাংগে উঠৈছিলো এই দু’জনের গদি টানাটনিতে। শেষমেষ ’খাকি’ হাত ধরে ওয়ান ইলেভেন এসে ঝগড়া বিবাদে ছাই ঢালে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় দুই নেত্রীর ‘হাম বড়া’ রাজনীতিতে বিরক্ত ও বিব্রত নেতা-কর্মীরা ‘মাইনাস টু’ ফর্মূলা তুলেছিলেন। অভিযোগ আছে, এতে উৎসাহ দেয় ‘খাকিরা’। কিন্তু মাইনাস হবার বদলে দুই নেত্রিই মাল্টিপ্লাইয়ের ওপর ‘টু দ্য পাওয়ার টু’ হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী পরিবার ও মোসাহেব পরিবেষ্টিত। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পরিবার ও বন্ধুদের দখলে। ‘কানেকশন ধন্য’উপদেষ্টারা দেশ চালান বিনা স্বাক্ষরে। কোথাও উপদেষ্টাদের সই-স্বাক্ষর নেই। নেই আনুষ্ঠানিক দায়-দায়িত্ব। তবু তাদের অঙুলী হেলনে চলে মন্ত্রণালয় ও সরকার। উপদেষ্টারাই এখন ‘সুপার মিনিস্টার’। প্রধানমন্ত্রী নিজের পছন্দ ও সিদ্ধান্তের বিপরীতে কিছুই শুনতে ও মানতে রাজী নন। অভ্যস্তও নন। বাণিজ্যমন্ত্রীর ব্যর্থতা, নৌ-পরিবহন মন্ত্রী ঔদ্ধত্য, যোগাযোগমন্ত্রীর অযোগ্যতা, সাংসদ বদির মাস্তানী কিছুই প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসেনা। বিভিন্ন জনদূর্ভোগে সৃষ্ট জন-অশান্তিকেও আমলে নেননা তিনি। রাজপথের দল আওয়ামী লীগে আজ কোনো রাজনীতিবিদের সুদৃঢ় ঠাঁই নাই। দেশ, সরকার ও আওয়ামী লীগ চলে একক সিদ্ধান্তের নির্দেশনায় পারিবারিক গোষ্ঠির মহলের পরামর্শে। পাওয়ার ও দায়িত্ব শেয়ারিংয়ের কোনো বালাই নেই। দেশ পরিচালনার ভঙ্গি ও স্টাইলে তিনি প্রমান করেন, তিনি গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার।
প্রাইম মিনিস্টার-ইন-ওয়েটিং বেগম জিয়ার শেষ শাসনামলেও দেশবাশী দেখেছে একই দৃশ্য। তিনি ও তার পরিবার এবং `কানেকশন ধন্যরা`ই সব কিছুর নিয়ন্ত্রক ছিলেন। উনার ক্ষমতাসীন দল বিএনপি’র একক ক্ষমতা ছিলো উনার একক হাতেই। পরবর্তী নেতৃত্ব ছিলো ভাই ও সন্তানের হাতে। দেশ পরিচালিত হতো বিকল্প প্রশাসন হাওয়া ভবন থেকে। বেগম জিয়াও শেখ হাসিনার মতোই একগুঁয়ে। তার সমর্থকরা অবশ্য এই একগুঁয়েমীর কাব্যিক নাম দিয়েছেন আপোষহীন। সেদিন ঈদ পূনর্মিলনীর ছবিতে দেখলাম উনার জন্যে মোঘল সিংহাসনের আদলে কাঠের সিংহাসন আনা হয়েছে। অন্য কোনো চেয়ার বা সোফায় উনার সম্মান হানি ঘটে! চেয়ার আর সোফার মানদন্ডেই উনার স্বাতন্ত্র্য! ভারত-বিরোধী হিসেবে বেগম জিয়ার দেশব্যাপী একটি ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে। উনার দলের নেতারা অবিরাম চিৎকার দিয়ে জানাচ্ছেন, সরকার ভারতের কাছে দেশ বিক্রির চুক্তি করছে। ভারতকে সবকিছু উজাড় করে দিয়ে দেয়া হছে।
বেগম জিয়ার চেয়ে এই সত্য কেউ বেশী জানেনা যে, দেশ কিংবা দেশের স্বার্থ বিক্রি করতে আগ্রহীদের কোনো প্রকাশ্য চুক্তি করতে হয়না। নিজে উপস্হিত না-থেকে দূত পাঠিয়েও কাজটি সম্পন্ন হয়, গোপনেও দেশের স্বার্থ বিক্রি করা যায়, যেমনটা উনার সরকার করেছিলো একচেটিয়া ভাবে ভারতীয় পণ্যগুলোকে শুল্কমুক্ত সুবিধাদি দিয়ে। ভেবেছিলেন প্রতিবেশী বৃহৎ শক্তিকে সন্তুষ্ট করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চিরস্হায়ী করতে পারবেন। ব্যাটে-বলে হয়নি পরিকল্পনাটি। উনার স্বামী জিয়াও ক্ষমতার স্বার্থে দশ হাজার কিউসেক গংগার পানি ছেড়ে দিয়েছিলেন ভারতকে। বংগবন্ধু এনেছিলেন ৪৪ হাজার কিউসেক। জিয়া ৩৪ হাজারের দফা-রফা করেছিলেন। ভারতের সাথে ছিটমহলের সমস্যা তুলেননি তিনি। তিস্তার পানি বন্টন আলোচনা করে নিজের সংসদীয় এলাকার ফেণী নদীকে বাঁচানোর চেষ্টায় উদ্যোগী হননি। তবু তিনি আপোষহীন ও ভারত-বিরোধী? জানিনা, ভারতের সাথে কোন যৌথ সমস্যা সমাধান নিয়ে তিনি এবার আলোচনা করলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে? কেবল সংবাদ সম্মেলন করে একটি এজেন্ডা ধরিয়ে দিলেই হয়না। পুরো ব্যাপারটা খোলাসা করতে হয়।
তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি না-হওয়াতেই প্রধানমন্ত্রী ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর স্হগিত করেছেন, নাকি নেপথ্যে অন্য কোনো চাণক্য কুটনীতি আছে? ট্রানজিট বিষয়ে নেয়া প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত কী রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢতার উৎসরন বলেই ধরে নিচ্ছি। এবং সেটা হলেই খুশী হবো কারণ এই দৃঢতা প্রমাণ করে তিনি ‘শেখের বেটি’। প্রধানমন্ত্রীর পিতা বংগবন্ধু এক অঙুলী হেলনে ভারতীয় সৈন্যদের বাহাত্তরে দেশে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। অসাধ্য কাজটি একমাত্র বঙ্গবন্ধুর মতো দৃঢ়চেতা মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিলো। প্রতিবেশী দাদাদের প্রকাশ্যে না বলার জন্যে লাগে অনেক বড় মানসিক শক্তি। কারণ ক্ষমতার ঘাড়ের ওপর খালেদা জিয়ার নিঃশ্বাস। মুখে যাই বলুক, বিএনপি ক্ষমতার স্বার্থে ভারত-পূজোয় যে কোনো ভোগ দিতেও সদা প্রস্তুত।
ইমেলঃ [email protected]