আমাদের বোধের ঘরের আঁধার যে কত গভীর তা উপলব্ধি করতে গেলে যে কোন বিবেকসম্পন্ন মানুষই চমকে উঠবেন। আর এ আঁধার দেখবার কিংবা মাপবার জন্য বিশেষ কোন যন্ত্র কিংবা গবেষণার প্রয়োজন নেই।
যে দুঃসহ দুর্ঘটনা, যে অপঘাত মৃত্যু ৫৬ হাজার বর্গমাইলকে বিষন্নতা আর বেদনার চাদরে ঢেকেছিল সেই মৃত্যু পরবর্তী তিরিশটি দিনে বাংলাদেশ কি বদলেছে? বাংলাদেশকে বদলাবার দায়িত্ব যাদের ঘাড়ে তাঁরা কি বদলেছেন? নিদেন পক্ষে বদলেছে কি মৃত্যুফাঁদ বলে খ্যাত ঢাকা-আরিচা মহাসড়কটির বীভৎস চরিত্র? এমন প্রশ্নের একটিই মাত্র সাফ জবাব, কোনও কিছুই বিন্দুমাত্র বদলায়নি। উল্টো বেয়াড়া ষাঁড়ের মত গো ধরেছে বদলাবে না বলে।
আমরা, সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র, বিকল্পধারার প্রগতিবাদী চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, শিক্ষক, সাংবাদিক মিশুক মুনীরকে গত ১৩ আগস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বলি দিয়েছি। ১৩ তারিখ দুপুর থেকে শুরু করে শেষ বিদায়ের ক্ষণটি পর্যন্ত আমাদের টেলিভিশন, আমাদের টক-শো, পত্রপত্রিকা, আলোচনা, সেমিনার, শোকসভা এমনকি শহীদ মিনারে পাদদেশে রাখা নিহত নক্ষত্রদের কফিনের সামনে দাঁড়িয়েও আমাদের সমাজ-রাজনীতির প্রভুরা, মন্ত্রী এবং এমপি বাহাদুরেরা, সাধু কিংবা দুর্বৃত্ত রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ, সুশীল সমাজ এমনকি দলবাজ আমলাকেও বলতে শুনেছি ‘এমন মৃত্যুর ইতি যেন এখানেই ঘটে, আমরা আর কোন মিশুক মুনীর, আর কোন তারেক মাসুদকে এভাবে হারাতে চাই না’। আমরা সে সব উপলব্ধিকে বিশ্বাস করে অনেক বড় আশায় বুক বেঁধেছিলাম। ভেবেছিলাম এবারই হয়তো শেষ। মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদসহ ৫টি প্রাণের আত্মত্যাগের বিনিময়ে সড়কপথের বিরামহীন অপমৃত্যুর মিছিলটা অন্ততঃ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হবে, কিন্তু না তা হয়নি। সহসা হবে বলে বিশ্বাস করবার মত একটি নির্বোধকেও এই মুহুর্তে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য যাই বলি না কেন আমার পৈত্রিক ভিটে বাড়ি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যাণ্ড থেকে মাত্র ৫ মিনিটের দূরত্বে। শৈশবের অনেক স্মৃতি ভুলে গেছি, কিন্তু পাগলা ঘণ্টি বাজিয়ে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে ফায়ার বিগ্রেডের লাল রঙের গাড়ি ছুটে যাবার দৃশ্য আজও ভুলিনি। কদাচিৎ নয়, লাল গাড়ির ঘণ্টা বাজিয়ে ছুটে চলা দেখতাম প্রায় প্রতিদিন। আগুন নেভাতে নয় ওগুলো ছুটতো ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত কিংবা নিহতদের উদ্ধার করে মর্গ কিংবা হাসপাতালে পৌঁছে দিতে। সে সময়ের দৈনিক বাংলার মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা জালাল ভাই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের এক্সিডেন্ট রিপোর্ট লিখতে লিখতে দেশজুড়ে ‘এক্সিডেন্ট রিপোর্টার’র খ্যাতি পেয়েছিলেন। সেই খ্যাতি তাঁকে সে সময়ের জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক বাংলার সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টারের পদ পর্যন্ত টেনে নিয়েছিল। সেই জালাল ভাই আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। আমিও কৈশোর থেকে ৫০ ছুঁয়েছি। অথচ আজও সেই লাল রঙা গাড়ি এখনও তেমনি করে আমাদের বড়ির পাশ দিয়ে একই ব্যস্ততায় ছুটে যায়। পার্থক্য শুধু একটাই--- সে সময়ের সেই লাল গাড়ি হাতে ঘণ্টা বাজিয়ে ছুটতো, এখন ছোটে সাইরেনের তীব্র চিৎকার তুলে। মিশুক মুনীররা যেদিন নিহত হলেন সেদিনও আমি সেই লাল গাড়িকে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে জোঁকার দিকে ছুটে যেতে দেখেছি।
১৪ সেপ্টেম্বর, দিন পেড়িয়ে রাত ১টা ৩০ মিনিট, এ লেখাটি যখন একটু একটু করে স্ফীত হচ্ছে ঠিক তখনও সেই লাল গাড়ির সাইরেনের শব্দে আঁতকে উঠলাম। আবার হয়তো সড়ক দুর্ঘটনা, আবারও কোন মায়ের বুক খালি করে চলে যাওয়া, আবারও নিষ্ফল অশ্রুপাত। ফায়ার ব্রিগেডের ৬১২২২ নাম্বারে ফোন করে জানলাম, ঢাকা আরিচা মহাসড়কের জাগিরে গাড়িতে আগুন লেগেছে, দমকলের গাড়ি স্পট থেকে না ফেরা পর্যন্ত বিস্তারিত জানা যাবে না। শুধু এ রাতই নয়। মিশুক মুনীররা নিহত হবার পর গত তিরিশটি দিনে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাটুরিয়া থেকে ঢাকার ধামরাই পর্যন্ত অংশে অন্ততঃ হাফ ডজন সড়ক দুর্ঘটনার খবর আমার মত নন্দলাল মানুষটিও জেনেছে। এসব দুর্ঘটনায় অন্ততঃ ১শ জন আহত, ৬ জন নিহত হয়েছেন। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে আধা কিলোমিটার দুরের খালপাড় এলাকায় অটোবাইকের ধাক্কায় গুরুতর আহত মানিকগঞ্জ সদর থানার ওসি আবু তাহের মিয়াও মরে গেলেন এরই মধ্যে। যে মানিকগঞ্জে মিশুক মুনীর নিহত হয়েছিলেন সেই মানিকগঞ্জের অবস্থাই যেখানে এমন বীভৎস দেশের অন্যসব জায়গার বাড়তি খবর নেবার কোন প্রয়োজন নেই। পত্রিকা পড়ে টিভি দেখে যতটুকু মনে রাখতে পেরেছি তাতে কেবল ঈদের আগে এবং ঈদের পরের সাতদিনে সারাদেশের সড়ক দুর্ঘটনায় মরে গেছেন অর্ধ শতাধিক মানুষ।
কি বিচিত্র এই দেশ! সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই কত অবলীলায় আমরা সব ভুলে যাই। কত নির্বোধ, নির্বিকার আর নপুংসক আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র। হয় এ রাষ্ট্রব্যবস্থা কিংবা তাদের নিয়ন্তাদের কোন কিছুই করবার ক্ষমতা নেই। নয়তোবা কিছু একটা করবার বিন্দুমাত্র তাগিদও ভেতর থেকে জাগে না । যদি জাগতোই তাহলে গত সপ্তাহেই এই ঢাকা আরিচা মহাসড়কে একটি যাত্রী বোঝাই কোচ ওভারটেকের নেশায় আরেকটি যাত্রী বোঝাই কোচের উপর উন্মাদের মত আছড়ে পড়তো না।
রাষ্ট্রযন্ত্রের যদি ক্ষমতাই থাকতো তা হলে মাতাল ট্রাক যাত্রীবাহী বাসকে রাস্তার শেষ প্রান্তে দণ্ডায়মান বৃক্ষের সাথে পিষে দিতো না। ডিউটিরত অবস্থায় সদর থানার ওসি আবু তাহেরকে অসময়ে চলে যেতে হত না।
খাস রাজদরবারী প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ এবং এআরআই’র তথ্য মতেই ঢাকা থেকে আরিচা পর্যন্ত মাত্র ৮৮ কিলোমিটার পথে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান ১৪৫ জন মানুষ। এ তথ্য সত্য থেকে বহুদূরে। প্রকৃত সংখ্যা কমপক্ষে দ্বিগুণ। মৃত্যুর এ সংখ্যা হয়তো হাসপাতাল, থানায় লিপিভূক্ত নথিরই কার্বন কপি। প্রভাবশালীদের সাঁড়াশি শাসন টাকার জোরে মিটিয়ে ফেলা দুর্ঘটনার খবর কেউ নিশ্চয়ই নথিভূক্ত করেনি। এ হিসাবে নিশ্চয়ই ৮৮ কিলোমিটার পথে যন্ত্রদানবদের চাকায় প্রতিনিয়ত পিষ্ট অসহায় পথচারীদের নাম নেই। থাকবার কথাও নয়।
সওজ এবং সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণাকেন্দ্রের হিসেব মতে সারা দেশের ২১৬ টি ব্ল্যাক স্পটের মধ্যে মানিকগঞ্জের আরিচা থেকে ঢাকার নবীনগরের মধ্যবর্তী মাত্র ৫৫ কিলোমিটার পথেই আছে ২২টি বিপজ্জনক স্পট। ২২টি বিপজ্জনক স্পট বাদ দিলাম, মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ ঢাকা আরিচা মহাসড়কের যে স্পটে নিহত হয়েছিলেন সেই ব্ল্যাক স্পটটিতেও গত ১ মাসে একটি ডিভাইডার নির্মাণ করতে পারেনি আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের চালকরা। এমন মৃত্যুও তাঁদের কাছে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’।
মিশুক মুনির তারেক মাসুদের দেশ কাঁপানো মৃত্যুর পরও এই মহাসড়কে ওভার টেকিং একচুলও কমেনি, গতিসীমা নির্দেশক বোর্ডগুলোতে থুতু ছিটিয়ে, ট্রাফিক আইনকে বুড়ো আঙুলে নাচিয়ে গাড়ি ছুটছে আর সুযোগ পেলেই হুটহাট একে অন্যের গর্দানে আছড়ে পড়ছে। রাতের আঁধারে হেডলাইটকে সার্চ লাইটের মত গণগনে করে এক অন্যের চোখ ধাঁধিয়ে দৌঁড়াচ্ছে। যখন যেখানে খুশি থামছে, রাস্তা আগলে পানবিড়ি ফুঁকছে। দেখবার কেউ নেই, বলবারও নেই।
এতবড় একটি বিপর্যয়ের চোখে দেখবার পরও গত একটি মাসে বেপরোয়া গাড়ি চালনা বন্ধ করবার কোন আয়োজন কোথাও চোখে পড়েনি। একটি কানা পয়সার জরিমানাও কোন উন্মাদ ড্রাইভারকে গুনতে হয়নি। বিধি ভঙ্গকারী একজন চালক কিংবা একটি গাড়িকে আটকানোর আকাঙ্ক্ষাও দেখিনি হাইওয়ে পুলিশ কিংবা থানার কোন দাপুটে দারোগার মাঝে। অথচ আমাদের জেলা প্রশাসনকে ঈদের আগে আড়ং এর পোশাক নির্মাণ কারখানা ব্র্যাকের আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনে বীরের মত অভিযান চালাতে দেখেছি, পলিথিন উদ্ধারের নামে বাজারের মুদি দোকানে হামলে পড়তে দেখেছি। কিন্তু এই মহাসড়কের ফিটনেসবিহীন শত শত যন্ত্রদানব দাপিয়ে চললেও গত এক মাসে কোনও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখিনি মোবাইল কোর্ট নিয়ে মহাসড়কে ছুটতে। এইসব মহাসড়ক `সম্রাট শাজাহানের সাম্রাজ্য` বলেই হয়তো মোবাইল কোর্ট ও পথ মাড়ায় না। সত্যিই তো কার ঘাড়ে কটি মাথা সম্রাটের সৈন্য-সামন্ত ঘাঁটায়! ডিসি সাহেব ঘাঁটাবে না, এসপি সাহেব ঘাঁটাবে না, মন্ত্রী বাহাদুরেরা সদা সহাস্য বদনে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত শুধুই দেখবেন আর দেখবেন এবং একসময়ে বলবেন ‘ঝুইল্যা পড়তে ক আমি তো আছিই’। আর পরের বৈঠকখানায় গলা বাড়িয়ে ‘গরু ছাগল চিনতে পারলেই লাইসেন্স দেওয়া যায়’ বলতে পারার মত মন্ত্রী যদি থাকেন যন্ত্রদানবদের প্রভু হয়ে তাহলে তো কথাই নেই।
অথচ ভিন্ন এক চিত্র দেখেছিলাম ২০১০ সালের ৩১ জুলাইয়ে উথলীর মোড়ে সংঘটিত আরেকটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার পর। ঐ দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব রাজিয়া সুলতানা এবং বিসিকের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান। সে দুর্ঘটনার পর মোবাইল কোর্ট আতঙ্কে বেশ কিছুদিন গাড়ির ড্রাইভাররা সোজা হয়ে চলেছেন, ১৫ দিনের মধ্যে ঐ পাটুরিয়ার মোড়ের দুই পাশে স্পিড ব্রেকার হয়েছে, বাঁকের আশপাশের সব বিল বোর্ড উপড়ে গাছ কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। এরপর থেকে ঐ স্পটে আর বড় কোন দুর্ঘটনাও দেখিনি। অথচ এবার যেন ভিন্ন মেজাজ। ঐ মৃত্যুতেও দেশজুড়ে গভীর শোক ছিল কিন্তু সরব প্রতিবাদ ছিল না। সড়কহত্যা বন্ধ কর বলে গণ মানুষের আওয়াজ ছিল না। এবারের নিস্পৃহতা প্রতিবাদের বিপরীতে বেয়ারা ষাঁড়ের মত গোঁ ধরে থাকা কিনা জানি না, তবে এটুকু জানি, অনেক কিছুই করার ছিল, করা হয়নি হয়তো হবেও না।
এমন করেই হয়তো চলবে। বিবেকের দাসত্ব যারা করেন তারা প্রতিবাদ করে যাবেন। শহীদ মিনার সরব হবে, দাবি উঠবে। একই সাথে মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদের মত নক্ষত্রেরা এমনি করে টুপটাপ ঝরে যাবেন। নিঃসঙ্গ বিবেক বোবার মত গুমরে গুমরে কাঁদবে। সম্ভাবনার মিছিল নেতৃত্ব শূন্য হয়ে অন্ধগলিতে সেঁধিয়ে যাবে। সব বাতি এক এক করে নিভে যাবে, সব কিছু বন্ধ হবে। স্বপ্নের এই দেশে বিবেককে পায়ে পিষে শুধু ক্ষমতার চাষই হবে-- অন্য কিছু নয়!
ই-মেইল : [email protected]
বাংলাদেশ সময় ১২২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১১