গত ১১ মে ক্রেডিট কার্ড সেবা সংক্রান্ত এ নীতিমালাটি জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যাংকগুলো এখনো নীতিমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি বলে জানা গেছে।
নীতিমালা নিয়ে ইতোমধ্যে আপত্তি জানিয়েছে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। ক্রেডিট কার্ড সংক্রান্ত নীতিমালাটি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে গভর্নর বরাবরে আবেদন করেছে তারা।
ক্রেডিট কার্ড বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা খুব বেশি দিনের নয়। মাঝে-মধ্যে শুনতাম যে, নানা প্রয়োজনে তা ব্যবহার করা যায়। কিন্তু ক্রেডিট কার্ড করার তাগিদ খুব একটা অনুভূত হয়নি। এভাবে ক্রেডিট কার্ড ছাড়াই আমার দিন, মাস, বছর কাটছিল। এক সময় আমি ক্রেডিট কার্ডের মায়াজালে জড়িয়ে গেলাম।
বাস্তবে আমি একজনের একটু উপকার করতে গিয়ে ক্রেডিট কার্ডের সঙ্গে জড়িয়ে যাই। অনেকটা বাধ্য হয়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড করে ফেলি।
২০০৯ সালের কোনো একদিন আমার পরিচিত একজন এসে বললেন, ‘ভাই, একটি বেসরকারি ব্যাংকে আমার চাকরি হয়েছে। আপনাকে ওই ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক হতে হবে’।
ওই পরিচিতজনকে সহায়তা করতে মূলত আমি ক্রেডিট কার্ড করি।
কার্ডটি করার পর আমার মধ্যে একটু পরিবর্তন এলো। আগে যে মাসিক বেতন পেতাম, তা দিয়ে আমার চলে যেতো। এখন নিজেকে একটু ‘বড়লোক’ ভাবা শুরু করে দিলাম। এর কারণ হলো, মাসিক বেতনের সঙ্গে ক্রেডিট কার্ডের লিমিট ৫০ হাজার টাকাকেও নিজের টাকা হিসেবে ধরে নেই।
পরবর্তীতে দেখা গেল, মাস শেষে বেতনের টাকা শেষ হয়ে ক্রেডিট কার্ড থেকেও অনেক টাকা চলে যাচ্ছে। কি আর করা, কোনোভাবে সংগ্রহ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকা জমা দিতাম। কিন্তু সমস্যা হলো, ব্যাংকের টাকা জমা দেওয়া মাত্রই আবার টাকার অভাব শুরু হয়। কারণ, বেতন পাওয়া মাত্রই বেতনের অর্ধেক টাকা এজন্য অগ্রিম চলে যায়। তারপর বাড়িভাড়া, সংসারের মাসিক ব্যয়! আমি যেন কোনোভাবেই ক্রেডিট কার্ডের এ মায়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে পারছিলাম না।
আবার পড়ে গেলাম অন্য রকম সমস্যায়। পরিচিত দু’একজনও জেনে গেলেন, আমার কাছে ‘বাড়তি’ টাকা আছে। আমার কাছের একজন বন্ধু ভাগিনা ফোন করে কিছু টাকা ঋণ দেওয়ার অনুরোধ জানালেন।
আমি কি করবো? বুঝিয়ে বলি, ‘ভাগিনা বেতনের টাকা প্রায় শেষ’।
তিনি বলেন, ‘কেন মামা, ক্রেডিট কার্ড দিয়ে টাকা তুলে দিলেও পারো’।
ভাবলাম, তাইতো টাকা তো আছে, হোক না তা ক্রেডিট কার্ডের। আলাপ মতো কিছু টাকা ভাগিনাকে দিয়ে দিলাম। তিনিও সময়মতো পুরো টাকা ফেরত দিলেন।
হাতে এল বেশ টাকা। আমার স্ত্রীকে নিয়ে মার্কেটে গেলাম। কিছু কেনা-কাটা করি। ভাবলাম, নির্ধারিত সময় তো এখনো আছে, ক্রেডিট কার্ডের টাকা জমা দেওয়া যাবে। কিন্তু বিধিবাম, পড়ে যাই ঝামেলায়। মেয়াদ শেষ হয়ে কয়েকদিন চলে গেল। বেতনের টাকা পেয়ে ক্রেডিট কার্ডের টাকা জমা দেব বলে ব্যাংকে ছুটি। গিয়ে দেখি, সুদাসলসহ বেশ টাকা আমাকে দিতে হবে। কি আর করা, যেহেতু নির্ধারিত সময় ৪৫ দিন চলে যাওয়ায় কিছু টাকা সুদ হিসেবে গুণতে হবে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে টাকা জমা দিয়ে বাসায় চলে আসি।
বাসায় এসে বিষয়টি স্ত্রীর সঙ্গে শেয়ার করি। আসলে গণতন্ত্র সব জায়গায় প্রয়োজন। আমাদের পরিবারে এ ধারা বহাল থাকায় স্বামী-স্ত্রী মিলে সিদ্ধান্ত নেই, যা হওয়ার হয়েছে, আর নয়। ক্রেডিট কার্ডের অ্যাকাউন্টটি ক্লোজ করা দরকার।
সিদ্ধান্ত অনুসারে ব্যাংকে যাই। আবার শুরু হলো ব্যাংকের মায়ার বেড়াজাল। ক্রেডিট কার্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ভদ্রলোক মানুষ। তিনি অনেকভাবে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আমার দৃঢ় অবস্থানের কারণে এক পর্যায়ে অ্যাকাউন্টটি ক্লোজ করতে রাজি হলেন।
ক্রেডিট কার্ডের জন্য ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও শাখা আয়ের কোনো অংশ পান কি-না- আমি জানি না। তবে তাদের পরিশ্রম দেখে আমার মনে হয়, এ খাতে বোনাস দেওয়া প্রয়োজন। ফরম নিয়ে তাতে স্বাক্ষর করে বাসায় চলে আসি।
বাসায় আসার পর ঘটে আরও এক ঘটনা। প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট শাখা থেকে এবার আসে ফোন। ফোন করেন খুবই দক্ষ এক নারী কর্মকর্তা। তিনি আমাকে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে খুবই ভদ্র ও আন্তরিক ভাষায় জানতে চান, কেন আমি ক্রেডিট কার্ড স্যারেন্ডার করতে চাচ্ছি। কোনো অভিযোগ আছে কি-না- তাও জানতে চান। আমি তখন অভিযোগ না থাকার কথা বলি। ব্যাংক কর্মকর্তারা অতি ভদ্র, তাদের আচরণে ক্ষুব্ধ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমার কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে ফোনটা রেখে দিতে চাইলেন।
তখন ভদ্রতা করে কথা দিলাম, ‘যদি আবার ক্রেডিট কার্ড করি, তাহলে আপনাদের ব্যাংকেই করবো, অন্য কোথাও নয়’।
কিন্তু আমি বুঝতে পারি, তিনি আমার কথায় খুশি হতে পারেননি।
ব্যাংকের অবশিষ্ট টাকা জমা দিয়ে ক্রেডিট কার্ড স্যারেন্ডার করে অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করা হয়। আমি খুশি মনে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে আসি। দু’একদিন আমার সময় ভালোই কাটে। এই ক্রেডিট কার্ডের দুশ্চিন্তা থাকে না।
কিন্তু শুরু হলো অন্য ব্যাংক থেকে আসা লোভনীয় নতুন প্রস্তাব। একটি ব্যাংক থেকে আমার একটি ক্রেডিট কার্ডের লিমিট এক লাখ টাকা করে দেওয়ার প্রস্তাব পাই। তাছাড়া রয়েছে আরও হরেক রকমের সুবিধা। অনেক বুঝিয়ে বলার পর মোবাইলে আলাপরত ব্যাংকের কর্মকর্তা শান্ত হন।
আমার পরিচিত অনেকেই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে থাকেন। ব্যাংকগুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রাহকও ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা নিয়ে থাকেন। ঈদ ও বিভিন্ন উৎসবে কার্ডধারীরা বাড়তি সুবিধা ভোগ করেন। ব্র্যান্ডের বিভিন্ন শো’রুমে কেনাকাটায় এসব ছাড় মেলে। এটা ভালো কথা। আর বিদেশে তো ক্রেডিট কার্ড খুবই জনপ্রিয়। ব্যাংকে অনেক সময় জমানো টাকা থাকে না। তাই মানুষ ক্রেডিট কার্ড নির্ভর।
বর্তমানে দেশের অর্থনীতির সব সূচকই ভালো অবস্থানে আছে। সরকার আশা করছে, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ হবে। আর মূল্যস্ফীতির হারও সহনশীল। দারিদ্র্য বিমোচনেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। দারিদ্র্যের হার ২৩ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থার (আঙ্কটাড) রিপোর্ট অনুসারে, ২০২৪ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। সুতরাং, উন্নয়ন আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার।
বর্তমানে ব্যাংকের জমার বিপরীতে সুদের হার অনেক কম। ডিপিএসের সুদ ৫ থেকে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্টে সুদের হার ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ। আর বেশি টাকা মেয়াদী আমানত রাখলে সুদের হার ৫ থেকে ৭ শতাংশ। এ সুদের ওপর আবার আবগারি শুল্ক ও অন্যান্য সার্ভিস চার্জ কেটে নেওয়া হয়।
কিন্তু বর্তমানে ব্যাংক ঋণের গড় সুদ ১০ শতাংশ আর ক্রেডিট কার্ডে প্রায় ৩০ শতাংশ। বিষয়টি ভাবা দরকার। ক্রেডিট কার্ডে সুদের হার সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১১ মে নীতিমালা জারি করলেও ব্যাংকগুলো তা এখনো কার্যকরের উদ্যোগ নেয়নি বলে পত্রিকার সংবাদে জানা গেছে।
বর্তমানে দেশে ৯ লাখ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী রয়েছেন। প্রতিনিয়ত বাড়ছে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার। গত জানুয়ারি মাসেই ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ৭৩৫ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন গ্রাহকরা (সূত্র: দৈনিক প্রথম অলো, ২০ মে-২০১৭)।
ঋণ সুবিধায় ব্যক্তি পর্যায়ে কেনাকাটা ও নগদ অর্থের তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটাতে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ক্রেডিট কার্ড। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও সেবাটির চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে দেশের প্রায় সবক’টি বেসরকারি ব্যাংকই ক্রেডিট কার্ডে ঋণ সুবিধা দিচ্ছে।
নীতিমালার বিষয়ে ব্যাংকগুলোর আবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শভঙ্কর সাহা বলেন, ‘ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকদের অভিযোগ ও প্রত্যাশার বিষয়টি গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডের জন্য নীতিমালা জারি করেছে। এরপরও কারো কোনো অভিযোগ থাকলে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ পর্যালোচনা করবে (সূত্র: বণিক বার্তা, ১ জুন-২০১৭)।
ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার সহনশীল হলে এর চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে। তবে সবার আগে প্রয়োজন ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ। এ বিষয়ে ক্রেডিট কার্ড সেবা প্রদানকারী ব্যাংকগুলো ও বাংলাদেশ ব্যাংককেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সৈয়দ ছলিম মোহাম্মদ আব্দুল কাদির: অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৩ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৭
এএসআর